Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বরেণ্য ভাস্কর শামীম শিকদার স্মরণে

Icon

জাহিদ মুস্তাফা

প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৩, ১০:৪৮

বরেণ্য ভাস্কর শামীম শিকদার স্মরণে

শামীম শিকদার। ছবি: সংগৃহীত

প্রখ্যাত ভাস্কর শামীম শিকদার গত ২১ মার্চ, ২০২৩ মঙ্গলবার অপরাহ্ণে চলে গেলেন অপরলোকে। ইচ্ছে ছিল তাঁর অসম্পূর্ণ কাজগুলো এবার সম্পন্ন করবেন; কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুতে তাঁর স্বপ্নপূরণ সম্পূর্ণ হলো না!

শামীম শিকদারের জন্ম ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর চিঙ্গিশপুর মহাস্তানগড় বগুড়ায়। ভাস্কর নভেরার পর তিনি আরেক সাহসী নারী ভাস্কর। সৃজন ও ব্যক্তিজীবনের নানা কর্মকাণ্ডে আলোচিত ও আলোকিত এক নারী তিনি এদেশে। চারুকলায় পড়তে এসেছিলেন রাজনীতির ডামাডোলে উত্তাল ১৯৬৯ সালে। দীর্ঘদিন প্রবাসে কাটিয়ে মাসকয়েক আগে দেশে ফিরে এসেছিলেন। সম্প্রতি একবার শিল্পকলা একাডেমিতে ও আরেকবার আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান চারুকলা অনুষদে দেখা হলো, কুশল বিনিময় হলো। হাত বাড়িয়ে দিলেন, করমর্দন শেষে জিজ্ঞাসা করলাম,

-কেমন আছেন আপা?

মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বললেন,

-ভালো আছি।

তারপর স্বভাবসুলভভাবেই বললেন নানা শারীরিক অসুস্থতায় জেরবার তিনি। হার্ট ও কিডনির সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কর্কটরোগের উপসর্গ। গত চার মাস ধরে ঢাকায় তাঁর চিকিৎসা চলছিল। বেশি অসুস্থতা নিয়ে ছয় দিন আগে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন, সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করলেন বরেণ্য এই ভাস্কর।

চারুকলার শিক্ষাজীবনেই শামীম শিকদার আলোচিত তাঁর প্রতিবাদী জীবনযাপন ও ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার মতো দৃঢ় মনোভাবের জন্য। এই মনোভাব ও আদর্শ থেকে তিনি কখনোই বিচ্যুত হননি! বিরুদ্ধ পরিবেশে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর ব্যক্তিগত সাহসী ভূমিকা অনেক নারীকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরাও নানা গল্প শুনে তাঁকে চিনেছি!

১৯৭১ সালে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের ‘স্বাধীনতা’ মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন সে সময়ের শিক্ষার্থী শামীম শিকদার। ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বঙ্গবন্ধুর কারান্তরীণ সংগ্রাম স্মরণে তাঁর একটি ভাস্কর্য গড়েন। সত্তর দশকে বরেণ্য লেখক আহমদ ছফার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল, তিনি তাঁকে বেশ পছন্দ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক সূত্রে জানা যায়ছফা তাঁকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন! তবে তিনি বিয়ে করেছিলেন সিলেটের জাকারিয়া চৌধুরীকে। তাঁদের একজন কন্যাসন্তান আছে। পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা বিপ্লবী সিরাজ শিকদার ছিলেন তাঁর বড় ভাই।

শামীম শিকদার চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে বদলি হয়ে আসেন ১৯৮০ সালে। যোগ দেন মডেলিং ও ভাস্কর্য বিভাগে। এ সময় আমি চারুকলায় দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সেবারই তাঁর সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়। এর আগে তিনি ছিলেন সরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের প্রভাষক। শিক্ষার্থীদের দাবিতে সরকার চারুকলা মহাবিদ্যালয়টিকে ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট হিসেবে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়, এতে শিক্ষক-কর্মচারী-শিক্ষার্থী সবাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অধীনস্থ হন।

১৯৮১ সালে তাঁর একক ভাস্কর্য প্রদর্শনীর আয়োজন হয় চারুকলার জয়নুল গ্যালারি ও উন্মুক্ত স্থানে। প্রদর্শনীটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রক্তপাতহীন এক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৮২ সালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে নেন। এই সেনাশাসকের সঙ্গে শামীম শিকদারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও আনুগত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক ও প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের আহত করে। এর সঙ্গে আরও দু-একটা ঘটনা মিলিয়ে চারুকলার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ভাস্কর শামীম শিকদার পাঁচ বছরের জন্য ক্লাস ও পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান। বলাই বাহুল্য, অনাকাক্সিক্ষত এই পরিস্থিতি তাঁর ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর হয়েছিল!

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য (পরে উপাচার্য) অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ চারুকলায় এসে নেতৃস্থানীয়দের সঙ্গে সভায় বসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের কোনো ক্ষতি না করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সমাধানের ফর্মুলা পেশ করেন। আমি সেই বৈঠকে ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম ও ফায়েজ স্যারের যৌক্তিক সমাধান প্রস্তাব মেনে নিতে অন্যান্য প্রতিনিধির সম্মতি আদায়ে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিলাম। ফলে চারুকলা শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে সেই আন্দোলন সেদিনই প্রত্যাহার করা সম্ভব হয়েছিল।

পাঁচ বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ভাস্কর শামীম শিকদার পরে শিক্ষক হিসেবে তাঁর কর্তব্য পালন করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় চারুকলার বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী গণচীনসহ নানা দেশে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন। পাশাপাশি একজন সৃজনশীল ভাস্কর হিসেবে নিজের মেধা ও শ্রম দিয়ে তিনি অনেক ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সৃজন হলোঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র সংলগ্ন সড়কদ্বীপে স্থাপনকৃত ম্যুরাল ও ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্যের সমন্বয়ে করা মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকেন্দ্রিক ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’। এই ভাস্কর্যে তিনি রূপায়িত করেছেন- বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র জনতা ও মেহনতি মানুষের সংগ্রামকে।

১৯৯৯ সালে সলিমুল্লাহ ও জগন্নাথ হলের পাশের সড়কদ্বীপে তিনি স্থাপন করেন ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ নামে গুচ্ছ ভাস্কর্য। স্বাধীনতা যে বাঙালির দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল ও এর প্রতিটি ধাপে নানা নেতৃবর্গের অবদান চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে, সেটি যথার্থরূপেই তুলে ধরেছেন ভাস্কর শামীম শিকদার। এ ছাড়াও জগন্নাথ হল অভ্যন্তরে স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য তাঁর গড়া। চারুকলা প্রাঙ্গণেও তাঁর গড়া কতিপয় ভাস্কর্য রয়েছে। ভাস্কর্য সৃজন নিয়ে তিনি প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। আশির দশকে তিনি আধুনিক ফর্মে মানুষের ফিগার নিয়ে কিছু ভাস্কর্য গড়েন- যা এদেশে সমাদৃত হয়নি। ফলে তিনি ফিরে আসেন বাস্তবানুগ ভাস্কর্যে।

‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ভাস্কর্য যেখানে, সেখানে তিনি বহু স্মরণীয় বাঙালির আবক্ষ ভাস্কর্য গড়েছেন। সেখানে আছেনজাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চারনেতা, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতা সুভাষ বসু, সূর্যসেন, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম, শিল্পাচার্য জয়নুল, পল্লীকবি জসীমউদ্দীন, ইস্টবেঙ্গল রাইফেলসের প্রতিষ্ঠাতা মেজর গণি, বাংলার বাউল সাধকসহ অনেক কৃতী বাঙালির প্রতিকৃতি- যাঁরা বাঙালির স্বাধিকার অর্জনে নানাভাবে যুক্ত।

ভাস্কর্যশিল্পে তাঁর সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।  

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫