Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

শহীদ মমিনের খোঁজে

Icon

গাজী মুনছুর আজিজ

প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২৩, ১১:২৮

শহীদ মমিনের খোঁজে

মুক্তিযোদ্ধা শহীদ মমিনের কবর। ছবি: লেখক

মুক্তিযুদ্ধের সময় বীর প্রতীক শহীদ আবদুল মমিনের বয়স ছিল ১৯ বা ২০ বছর। ছিলেন চঞ্চল ও সাহসী। ছাত্র হিসেবেও ছিলেন মেধাবী। সেই সাহস আর মেধা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। শত্রুকে আক্রমণ করতে সবার আগে থাকতেন তিনি। জীবনবাজি রেখে করেছেন একাধিক সম্মুখযুদ্ধ।

কিন্তু শেষ যুদ্ধ থেকে তিনি আর ফিরতে পারেননি মায়ের কোলে। শত্রুর বুলেট তার মাথায় এসে লাগে। চলে যান না ফেরার দেশে। কুমিল্লার দাউদকান্দির ইলিয়টগঞ্জ অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে তিনি শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাকে মরণোত্তর বীর প্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তার খেতাব প্রাপ্তির নম্বর-৩২৭।

শহীদ মমিনের সহযোদ্ধা ছিলেন চান্দিনার সুহিলপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. আলী আকবর দর্জি (প্রয়াত)। তিনি ছিলেন এ যুদ্ধের গ্রুপ কমান্ডার। তিনি (বেঁচে থাকার সময় কথা হয়) বলেন, ইলিয়টগঞ্জ রাজেন্দ্র বিশ্বনাথ উচ্চবিদ্যালয় ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটি। এ ঘাঁটি শত্রুমুক্ত করতে আমরা ১১ বার আক্রমণ করেছিলাম। অবশেষে সফল হই। এ যুদ্ধে আমাদের কমান্ডার ছিলেন চান্দিনার পিপুইয়া গ্রামের আবদুল মমিন।

শহীদ মমিনের আরেক সহযোদ্ধা ও ইলিয়টগঞ্জ মুক্ত করার যুদ্ধের সহকারী কমান্ডার ছিলেন আমির হোসেন দর্জি (প্রয়াত)। তিনি (বেঁচে থাকার সময় কথা হয়) বলেন, আমরা চারটি গ্রুপের ৪৫ জন বাঙালি মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিই এ যুদ্ধে।

এ ছাড়া এ যুদ্ধে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এক থেকে দুই প্লাটুন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্য। ইলিয়টগঞ্জ আক্রমণের পরিকল্পনা আমাদের আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সে পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা ৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে ইলিয়টগঞ্জ রাজেন্দ্র বিশ্বনাথ উচ্চবিদ্যালয়ে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের ঘাঁটির চারপাশে অবস্থান নিই।

তখন তাদের ঘাঁটিতে কয়েকশ পাকিস্তানি সেনা ছিল। আমরা যে যার মতো অবস্থান নিই। আর মমিন অবস্থান নিয়েছিল একটি পুকুরের পাড়ে। যুদ্ধ শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই দূর থেকে শত্রুদের একটি গুলি এসে লাগে তার শরীরে। সঙ্গে সঙ্গে সে গড়িয়ে পড়ে পুকুরের পানিতে। যুদ্ধ চলে ভোররাত পর্যন্ত। পরের দিন ৬ ডিসেম্বর বিকেলে মমিনের লাশ আমরা উদ্ধার করি সেই পুকুর থেকে।

এরপর তাকে দাফন করা হয় তার গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে। এ যুদ্ধে আমাদের আরেক সহযোদ্ধা মোহাম্মদ শাহজাহানের গায়ে গুলি লাগে এবং তিনি আহত হন। এ ছাড়া এ যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর তিন সদস্য মারা যায় এবং শত্রুদের ১১ জন মারা যায় ও আত্মসমর্পণ করে আরও সাতজন। বাকি পাকিস্তানি সেনারা শেষ মুহূর্তে পালিয়ে যায়।

শহীদ মমিনের আরেক সহযোদ্ধা মো. কবির হোসেন সরকার। তিনি বলেন, এ যুদ্ধে একটিমাত্র মেশিনগান ব্যবহার করা হয় এবং সেটি চালিয়েছি আমি। শহীদ মমিন ছিল আমাদের কাছের মানুষ। 

শহীদ আবদুল মমিনের বড় ভাই ও কুমিল্লা জিলা স্কুলের সাবেক সহকারী প্রধান শিক্ষক আবদুল মান্নান বলেন, ছোটবেলা থেকেই মমিন ছিল খুব সাহসী। পড়াশোনায়ও সে ভালো। যুদ্ধের সময় সে ছিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। যুদ্ধ শুরু হলে সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। ভারতে প্রশিক্ষণও নিয়েছে। এরপর বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। আর সে শহীদ হয় ৫ ডিসেম্বরের ইলিয়টগঞ্জের যুদ্ধে।

শহীদ মমিনের কবরে গিয়ে দেখা গেল তার কবরটির চারপাশের দেওয়ালে সাদা রঙ দেওয়া হয়েছে। কবরের সামনে ছোট্ট একটি সাইনবোর্ডে দেওয়া আছে মমিনের নাম। 

শহীদ আবদুল মমিনের বড় ভাই আবদুল মান্নান বলেন, আমার ছোট ভাই দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। বীর প্রতীক খেতাবও পেয়েছেন। আমরা চাই ইলিয়টগঞ্জ থেকে মমিনের কবর পর্যন্ত সড়কটি সরকার মমিনের নামে ঘোষণা করুক। এ ছাড়া তার নামে সেখানে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জাদুঘর বা পাঠাগার স্থাপন করুক সরকার।

যুদ্ধের সময় আলী আকবর দর্জি ও আমির হোসেন দর্জি ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের বাণিজ্য বিভাগের ছাত্র। তারা আপন দুই ভাই। যুদ্ধ শুরু হলে তারা অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে। তাদের মধ্যে আলী আকবর দর্জি প্রশিক্ষণ নেন ভারতের পালাটনা ক্যাম্পে। আর আমির হোসন দর্জি প্রশিক্ষণ নেন ভারতের ওম্পিতে। তারা প্রায় দুই মাস প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিজেদের গ্রামে ফিরে আসেন এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন ও শত্রু পক্ষের পথ রোধ করতে ইলিয়টগঞ্জ সেতু, ইলিয়টগঞ্জ পূর্বদিকের কালভার্ট, ভাটেরচর সেতু, ছাগলনাইয়ার রেলওয়ে সেতুসহ বিভিন্ন সেতু ভাঙেন। 

আলী আকবর দর্জি বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চান্দিনা উপজেলা কমান্ডের সহকারী কমান্ডার ছিলেন। তিনি বলেন, আবদুল মমিন দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। তার সহযোদ্ধা হিসেবে নিজেদের গর্ববোধ করি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫