Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

আমাদের বাতিঘর

Icon

হেনা সুলতানা

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৫৮

আমাদের বাতিঘর

প্রতীকী ছবি

এই সেই অগ্নিঝরা মার্চ, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল ধু-ধু মাঠের সুবাসে। ঢাকার হৃদয়, বুকখানি রেসকোর্সের ময়দানে। অপেক্ষা করছিল বিদ্রোহী জনতা। একটি কবিতা পড়া হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে উন্মত্ত অধীর শ্রোতা বসে ছিল ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে। কখন আসবে কবি? এই সেই মার্চ যেখানে উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল শ্রোতা মুহূর্তে মুহূর্তে স্লোগান দিচ্ছিল। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’।

১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠ নিঃসৃত বক্তব্য শোনার জন্য তারা অপেক্ষা করছিল। তারা শুনতে চায় রেসকোর্সের মাঠে এসে তিনি কী নির্দেশ দেন, কী আশার বাণী শোনান। 

কারণ পাকিস্তানি শাসকরা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিজয়কে নস্যাৎ করার সমস্ত পরিকল্পনার ছক তৈরি করে বসেছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির বিজয়কে পাকিস্তানিরা স্বীকার করে নিতে পারেনি।

পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রকারীদের সামরিক প্রতিভূ ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ১লা মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ আসহযোগ আন্দোলন। বাংলাদেশ হয়ে ওঠে গণমানুষের আন্দোলনে টালমাটাল। ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে তাদের অকৃত্রিম বন্ধু, প্রাণের মানুষ, কোটি মানুষের নেতা শেখ মুজিবের দিকে। সে দিনের প্রত্যেক শ্রোতাই যেন এক একজন বিদ্রোহী। এ বিদ্রোহ ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ও সামরিকতন্ত্রের এবং অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে।

মার্চের প্রথম দিন থেকেই সারা দেশ অগ্নিগর্ভ। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এই দিনে বেতার ভাষণে ৩রা মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রধান দল পিপলস পার্টি এবং অন্য কয়েকটি দল ৩রা মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বেতারে এ ঘোষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী ঢাকা প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সে সময় তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে দর্শক খেলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে হাজারো মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। এই মার্চ থেকেই তো-সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।

বাংলায় প্রথম যুদ্ধের স্লোগান উঠেছিল এই মার্চ থেকেই। ক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেদিন প্রথমবারের মতো স্লোগান দেয়, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।” ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে কর্মসূচি ঘোষণার দাবি করে। বিক্ষোভ-স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ গোটা দেশ।

এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তিনি ২রা ও ৩রা মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন এবং ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। সেই শুরু।

অগ্নিঝরা মার্চের দিনগুলো যতই এগোচ্ছিল ততই এক দফা দাবি অর্থাৎ স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার তীব্রতা বাড়ছিল। ৪ মার্চ ছিল দেশব্যাপী লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন। গণবিক্ষোভে টালমাটাল ছিল এ দিনটি’ ফলে ঢাকাসহ সারাদেশ অচল হয়ে পড়ে। এই দিনই সামরিক জান্তার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে রাজপথে নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ।

এই দিনেই রেডিও পাকিস্তান, ঢাকার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। এই নাম পরিবর্তন সেই চলমান আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। যা বাংলাদেশ মুক্তির পথকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়।

৪ মার্চের আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা- খুলনায় বাঙালি অবাঙালিদের মাঝে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। একই সঙ্গে সেদিন পূর্ব পাকিস্তান মহিলা পরিষদের নেত্রী কবি সুফিয়া কামাল ও মালেকা বেগম যৌথ বিবৃতিতে ৬ই মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের আহ্বান জানান।

এই যে এত সব প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছিল তা দেখে পাকিস্তান বাহিনী কার্ফু দিয়ে ও সাহসী বীর বাঙালিদের ঘরে আটকে রাখতে পারছিল না। তাই গোপনে পরিকল্পনা আঁটতে থাকে বাঙালি নিধনের। এরই মাঝে আন্দোলনের পাশাপাশি চলতে থাকে ৭ মার্চের জনসভা সফল করার চেষ্টা। চলতে থাকে প্রস্তুতি। অন্যদিকে আওয়ামী লিগের যুব ও ছাত্র নেতারা গোপন নানা স্থানে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযান চালাতে থাকে জোরেশোরে।

দীর্ঘদিনের শোষিত, নিপীড়িত, অধিকার বঞ্চিত মানুষের বিদ্রোহকে দমন করা এত সহজ ছিল না। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ছিল বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষার এক একটি মাইলফলক।

বঙ্গবন্ধু চিনেছিলেন সাত কোটি বাঙালির হৃদয়। তাই তো তিনি দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন জনতার মঞ্চে। ৭ মার্চে গর্জে উঠল বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ। সে কণ্ঠ রোধ করার ক্ষমতা কারও ছিল না। গণ-সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে রাজনীতির কবি, গণ-মানুষের হৃদয়ের নেতা শোনালেন ‘তাঁর অমর কবিতাখানি ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হলো। সাত কোটি জনতা যেন প্রাণ ফিরে পেল। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে বলেছিলেন বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। তা সত্যে পরিণত হয়েছিল গোটা নয় মাস জুড়ে।

২৫ মার্চ কালরাতে হাজার হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেও দমিয়ে রাখতে পারেনি বাঙালিকে। লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করেও তাদের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে দমাতে পারেনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। শত্রু পরাজিত হয়। আমরা ফিরে পাই আমাদের বাংলাদেশকে। তাই তো আমার পরিচয় আমি বাঙালি। আমার চেতনায় বঙ্গবন্ধু। অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের বাতিঘর।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫