Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

একটি বেওয়ারিশ জাহাজের গল্প

Icon

আহসান হাবীব

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:১৩

একটি বেওয়ারিশ জাহাজের গল্প

গল্প। প্রতীকী ছবি

মহিউদ্দীন আকন্দ একজন আদার ব্যাপারী। ব্যবসা তার ভালোই চলছিল; কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি ধরা খেলেন। একটা পাঁচ টনের ট্রাকে তিনি ছয় টন আদা পঞ্চগড় থেকে ঢাকায় বুক করেছিলেন। সেই ট্রাক রাত আটটার মধ্যে ঢাকার কাওরানবাজারে পৌঁছার কথা ছিল; কিন্তু আজ আট মাস হলো সেই ট্রাক এখনো পৌঁছায়নি। 

ওই দিন রাস্তায় নাকি যমুনা ব্রিজের ধারে কাছে দুই থেকে তিন কিলোমিটার পর্যন্ত জ্যাম ছিল... তাই বলে আট মাস জ্যামে আটকা থাকবে তার ট্রাক? মহিউদ্দীন আকন্দের ঠিক বিশ্বাস হয় না। ট্রাকের লোকজন তার আদা নিয়ে ভেগে যাবে এটাও মহিউদ্দীন আকন্দের বিশ্বাস হয় না। 

তার বন্ধুরা বলে, ‘ওহে মহি, তুই বরং অন্য ব্যবসা ধর। তোর এই ট্রাক আর আসবে না।’ 

মহিউদ্দীন আশা ছাড়েন না। অপেক্ষা করেন। নতুন আর কী ব্যবসায় যাবেন, ব্যবসা তিনি একটাই বোঝেন সেটা আদার ব্যবসা এবং সবাই জানে তিনি আদার ব্যাপারী, বাপ-দাদার ব্যবসা ছেড়ে এখন নতুন করে কোন ব্যবসায় যাবেন? 

ঠিক এই সময় সিত্রাং ঝড় হামলা করল। দেশটাকে যেন লণ্ডভণ্ড-পণ্ড করে দিল। পরদিন খবরটা চোখে পড়ল মহিউদ্দীন আকন্দের। 

‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ঝড়ের তোড়ে একটি বেওয়ারিশ পুরনো জাহাজ এসে আটকা পড়েছে ... যার ভেতরে কিছু নেই, আবার কেউ কেউ বলছে জাহাজের ভেতরে একটা কন্টেইনার আছে; তবে কন্টেইনারের ভেতর কী আছে কেউ জানে না। আসলে ভয়ে কেউ ওই ভুতুড়ে জাহাজের কাছেধারে যাচ্ছেও না।’

তখনই মহিউদ্দীনের মাথায় চিন্তাটা এলো। আচ্ছা তার ছয় টন আদা ওই কন্টেইনারের ভেতর নেই তো? ট্রাকের লোকজন কোনো রহস্যময় কারণে ট্রাকে আদা পাঠাতে না পেরে ওই বেওয়ারিশ জাহাজে করে সমুদ্রপথে ... বিষয়টা তিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরমানকে কী মনে করে বলেও ফেললেন।

আরমান হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার বাল্যবন্ধুর দিকে। তারপর বলল-

- ওরে মহি, তোর ব্রেন এখন আর হাঁটুতে নেইরে ... স্ট্রেট চলে গেছে পায়ের নলিতে, তুই টের পাচ্ছিস? তুই জলদি ডাক্তার দেখা... আমার পরিচিত নিউরোলজির ভালো ডাক্তার আছে...! 

সেই রাতেই মহিউদ্দীন আকন্দ অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি সমুদ্র তীরে বসে আছেন। সম্ভবত সেন্ট মার্টিনের সমুদ্র তীরেই। তার সামনেই সেই বিশাল জাহাজটা দাঁড়িয়ে... এই সময় কে একজন তার সামনে এসে হাজির হলো। 

- আপনি মহিউদ্দীন আকন্দ?

- জি।

- আদার ব্যবসা করেন?

- জি।

- আপনার ছয় টন আদা নিয়ে এসেছি আমরা। কন্টেইনারটা নামাতে হবে।

- আপনি কে?

- আমি এই জাহাজের ক্যাপ্টেন।

- আচ্ছা আমার একটা প্রশ্ন ছিল।

- কী প্রশ্ন?

- আমার ছয় টন আদা ট্রাকে না এসে জাহাজে কেন এলো? 

- দেখুন আপনি আদার ব্যাপারী আপনার জাহাজের খবর রাখার তো দরকার নেই। আপনি বরং আপনার আদা ডেলিভারি নেওয়ার ব্যবস্থা করুন জলদি জলদি। 

- কিন্তু ডেলিভারি তো হওয়ার কথা কাওরানবাজারে। এখানে ডেলিভারি নিয়ে কী করব? এই জাহাজ কি হাতিরঝিলের দিকে একটা ট্রিপ দিতে পারে? ওখান থেকে কাওরানবাজার তবু একটু কাছেধারে হবে...

এই পযায়ে এসে তার স্বপ্নটা ভেঙে যায়। তিনি বিছানায় উঠে বসেন। কাওরানবাজারের কাছে তিনি একটা মেসে আপাতত আছেন। আট মাস ধরেই আছেন। কী মনে করে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালেন। সিত্রাং ঝড় গতকালই বিদায় নিয়েছে। আবহাওয়া এখন মোটামুটি ভালো। তবে মেসের সামনের বড় নিম গাছটা এখনো হাত-পা ভেঙে রাস্তার উপর পড়ে আছে, খুব শিগগিরই সিটি করপোরেশন এর কোনো ব্যবস্থা নেবে বলে মনে হচ্ছে না। গাছেদের জন্য কোনো আঞ্জুমান মফিদুল টাইপের প্রতিষ্ঠান থাকলে বোধহয় ভালো হতো। মহিউদ্দীন আকন্দ মেস থেকে নেমে গিয়ে নিম গাছটার সামনে এসে দাঁড়ালেন, একটা কচি ডাল ভেঙে দাঁত মাজতে শুরু করলেন। বহুদিন তিনি নিম গাছের ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন না। রাতে ঘুমানোর আগে দাঁত মাজা উত্তম কাজ। আজকাল এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। 

তখনই তিনি খেয়াল করলেন তিনি একা নন। অনেকেই নিম গাছের ডাল ভেঙে এই রাত-বিরেতে দাঁত মাজছে। যেন হঠাৎ করে তারা সবাই এই গভীর রাতে আচমকা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা টের পেয়েছে এবং আশ্চর্যের ব্যাপার তারা সবাই নিম গাছের ডাল দিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে সেই বেওয়ারিশ জাহাজটা নিয়ে আলোচনা করছিল। আলোচনাটা অবশ্য খুব অদ্ভুত ঠেকছিল মহিউদ্দীনের কাছে!

- জাহাজের কন্টেইনারে কী আছে মনে হয় আপনাদের?

- খুব সম্ভব এক গাদা মেরুদণ্ড, এই জাতির কারও কারও শক্ত মেরুদণ্ড দরকার তাই কেউ দয়াপরবশ হয়ে ...

- না না আমার মনে হয় খুব সম্ভব একটা বিড়াল।

- বিড়াল? 

- হ্যাঁ শ্রডিঙ্গার সাহেবের বিড়াল। 

- ওহ বুঝতে পেরেছি তার মানে ওই লোহার বাক্সের ভেতর আছে একইসঙ্গে দুটা বিড়াল। একটা জীবিত আর একটা মৃত। বিজ্ঞানের ওই প্যারাডক্সটা আমার জানা আছে। 

- আচ্ছা ওই লোহার বাক্সের বাইরে আমরা মানুষরা কি জীবিত না মৃত? দ্বিতীয় আরেকজন প্রশ্নটা করে। 

- যদি বাক্সের ভেতরে বিড়াল না থেকে থাকে পারমাণবিক বর্জ্য, তাহলে বাইরে আমরা সব মৃত। সবাই দাঁত মাজা বন্ধ করে চমকে লোকটার দিকে তাকাল। কী বলছে এই লোকটা!

- অবাক হওয়ার কিছু নেই। অনেক উন্নত দেশই এসব করে। তাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার পারমাণবিক বর্জ্য ২৪ ফুট সলিড কংক্রিটের নিচে কবর না দিয়ে কোনো কন্টেইনারে করে ভাসিয়ে দেয় সমুদ্রে জাহাজে করে... হতেই পারে এমনটা!

- হ্যাঁ হতেই পারে ... আরও দু-একজন সায় দেয়।

- তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই বাক্সে মানে কন্টেইনারে আসলে কিছুই নেই, নাথিং... শূন্য ফাঁকা...। সবচে বয়স্ক লোকটা বলে এবার। 

- এটা মনে হওয়ার কারণ? 

- কারণ পৃথিবীটা এখন উল্টো চলছে। মনে আছে নিশ্চয়ই আপনাদের; সংখ্যা আবিষ্কারের পর শূন্য আবিষ্কার হয়েছিল... অবশ্য শূন্যও একটা সংখ্যা বটে। সামথিং ইনভেন্টেড বিফোর নাথিং! আর এখন নাথিং ইনভেন্টেড বিফোর সামথিং!

এই উচ্চ আলোচনায় মহিউদ্দীন আকন্দ হঠাৎ টের পেলেন তার কেমন যেন চুয়া ঢেঁকুর উঠছে। জরুরি ভিত্তিতে তার এক কাপ আদা চা খাওয়া দরকার এখনই। তিনি এদিক ওদিক তাকালেন আদা চায়ের সন্ধানে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫