রুশ সমাজতন্ত্রের পতন
একটি সংক্ষিপ্ত সমীক্ষা

রইস উদ্দিন আরিফ
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৫৪

প্রতীকী ছবি
আজ থেকে এক শতাব্দীরও বেশি আগে (১৯১৭ সালে) সংঘটিত অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত রাশিয়ায় যে ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, সেই সমাজতন্ত্র এক সময় হয়ে উঠেছিল দুনিয়ার শোষিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির স্বপ্ন।
সব মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক অভূতপূর্ব বিপ্লবী উন্মাদনা; কিন্তু বিশ্বের মানুষকে হতভম্ব করে দিয়ে সেই সমাজতন্ত্রের যখন পতন ঘটল এবং পতনের পর চার দশকেও যখন তার পুনরাবির্ভাবের কোনোই লক্ষণ দেখা গেল না, তখন সবার মনে বড় আকারে প্রশ্ন দেখা দিলো-রুশ সমাজতন্ত্রের এই করুণ পরিণতি ঘটেছিল কী কারণে?
এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য এ যাবৎ বহু আলোচনা-পর্যালোচনা ও বিতর্ক হয়েছে, বহু লেখালেখি হয়েছে; কিন্তু এর যথাযথ জবাব পাওয়া গেছে কিনা তা নিয়ে অনেকের মনেই এখনো সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে বলে মনে হয়। লেখকের বক্ষ্যমাণ নিবন্ধের অবতারণা সেই প্রেক্ষাপটেই।
এক
লেখার মূল প্রতিপাদ্যে যাওয়ার আগে প্রাসঙ্গিক বিষয়ের পূর্বাভাস হিসেবে কিছু কথা বলে নিলে আলোচনায় সুবিধা হবে। ২০২০ সালে প্রকাশিত আমার ‘আধ্যাত্মিক মার্কস’ বইটির এক জায়গায় প্রসঙ্গক্রমে অক্টোবর বিপ্লব ও লেনিনের কথা উঠলে, লেনিন সম্পর্কে তথ্যভিত্তিক কিছু মন্তব্য করেছিলাম। মন্তব্যটি ছিল এমন-‘মার্কসের প্রথম জীবনে লেখা দর্শন-সমাজ-অর্থনীতিবিষয়ক অতিগুরুত্বপূর্ণ মৌলিক রচনাগুলো লেনিন পাঠ করার সুযোগ পাননি এবং সে কারণে মার্কসকে পুরোপুরি বোঝার ক্ষেত্রে তার একটি সীমাবদ্ধতা ছিল।’
এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় অনেক পাঠকের মধ্যে বিরূপ মনোভাব লক্ষ করা যায়। তাদের কেউ কেউ বইটি পড়ার পর লিখিতভাবে না হলেও মৌখিকভাবে টেলিফোনে বা সরাসরি সাক্ষাতে আমার বক্তব্যকে মিথ্যা, বানোয়াট ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বলে সাব্যস্ত করেন। তাদের ভাষা ছিল তিরস্কারের পর্যায়ের।
এর কারণ হিসেবে অনুমান করি, হয়তো তারা মনে করেছেন যে, আমি মিথ্যাচার করে অক্টোবর বিপ্লবের মহান নেতা লেনিনকে ‘হেয়’ করার চেষ্টা করেছি। অথবা অনুমান করি, তাদের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়ার কারণ সম্ভবত এই যে, তারা লেনিনকে সর্বজ্ঞ মনে করেন এবং তার তত্ত্বকে স্বতঃসিদ্ধ ও চিরন্তন কিছু মনে করেন।
এসব প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমার প্রথম কথা হলো-অক্টোবর বিপ্লবের নেতা লেনিন ছিলেন একজন বিচক্ষণ ও বিরল প্রতিভাসম্পন্ন বিপ্লবী নেতা। তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক, নয়া-ঔপনিবেশিক ও সামন্ততান্ত্রিক দেশগুলোর জাতীয় ও গণতান্ত্রিক মুক্তির বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির পার্টির নেতৃত্বের অপরিহার্যতার কথা তিনিই প্রথম সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেন। তদুপরি কমিউনিস্ট আন্দোলনের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে গৃহীত যান্ত্রিক মার্কসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে মার্কসবাদী বিপ্লবের ধারায় নতুন গতি সঞ্চারের কাজে লেনিন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। (যদিও রাশিয়ায় অক্টোবর বিপ্লবের পর গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কালে রুশ বলশেভিকদের ঘাড়ে সেই যান্ত্রিক মার্কসবাদই চেপে বসেছিল।) দ্বিতীয় কথা হলো- লেনিন সম্পর্কে আমার উপরোক্ত বক্তব্য মিথ্যা বা বানোয়াট ছিল না, লেনিনকে ‘হেয়’ করার উদ্দেশ্যও ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল, লেনিন এবং অপরাপর বলশেভিক নেতাদের মার্কস পাঠে সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরা।
আর তৃতীয় কথা হলো, কোনো মানুষই সর্বজ্ঞ নন এবং কোনো তত্ত্বই স্বতঃসিদ্ধ বা চিরন্তন নয়। মার্কসের তত্ত্বও কোনো স্বতঃসিদ্ধ চিরন্তন ব্যাপার নয়। এ ক্ষেত্রে মার্কস পাঠে লেনিন ও তার সমসাময়িক বলশেভিক নেতাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘাটতির বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য এখানে আরও কিছু কথা বলে নিই। বাস্তব ঘটনা হলো কার্ল মার্কসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক চারটি গ্রন্থ-‘গ্রুন্ডিস’, ‘জার্মান ইডিওলোজি’, ‘ইকোনোমিক অ্যান্ড ফিলোসফিক্যাল ম্যানুসক্রিপটস’ এবং ‘ক্যাপিটাল’-এর মধ্যে প্রথম তিনটি গ্রন্থই জার্মান ভাষায় প্রকাশ হয়েছে অক্টোবর বিপ্লবের পর এবং ইংরেজি ও রুশ ভাষায় প্রকাশ হয়েছে লেনিনের মৃত্যুর পর। সেই পরিপ্রেক্ষিতে মার্কস পাঠে লেনিন ও তার সহ-কমরেডদের মার্কসকে পুরোপুরি বোঝার ঘাটতি বা সীমাবদ্ধতার বিষয়টি ছিল খুবই স্বাভাবিক।
এর জন্য অবশ্যই তারা কেউই দায়ী ছিলেন না। এর দায় সময় বা কালের ফেরের। তবে মার্কসের লেখা উল্লিখিত তিনটি গ্রন্থ এত দীর্ঘ সময় অপ্রকাশিত থাকার ব্যাপারটি শুধু অনাকাঙ্ক্ষিতই ছিল না, বেদনাদায়কও বটে। এই বেদনার কথা মার্কস নিজেই খানিকটা ব্যক্ত করেছেন তার ‘পুঁজি’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের প্রথম অংশে দ্বিতীয় জার্মান সংস্করণের উত্তরভাষে। তিনি বলেছেন, ‘জার্মান বুর্জোয়াদের শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ধ্বজাধারীরা পুঁজি গ্রন্থটিকে হত্যা করতে চেয়েছিল, যেমনটি তারা করেছিল আমার আগের লেখাগুলোর বেলায়।’
রুশ বলশেভিক নেতাদের মার্কস পাঠে সীমাবদ্ধতার প্রেক্ষাপটে বোদ্ধা মার্কস চর্চাকারীদের মধ্যে এরকম একটি প্রশ্ন জাগ্রত হতেই পারে যে, রুশ বিপ্লবের ক্ষেত্রে মার্কসকে আধাআধি বুঝে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করা তো দূরের কথা, তা শুরুই বা করা যায় কীভাবে? কিন্তু মার্কসবাদীদের দাবি অনুযায়ী, লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বলশেভিকরা দুনিয়া কাঁপিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু শুরুই করেননি, সেই বিপ্লবে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠাও করে ফেলেছিলেন। তবে এখন বলা যায়, পুরো বিশ্বের মানুষকে হতভম্ব করে দিয়ে সেই সমাজতন্ত্রের নির্মম পরিণতি ঘটেছে কথিত রুশ সমাজতন্ত্রের কারণেই।
আর সেটি ঘটেছে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের হাতে নয়, কমিউনিস্ট একনায়কতান্ত্রিক আমলাতন্ত্রের হাতে। আরও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে-কথিত রুশ সমাজতন্ত্রের পতনটা ঘটেছে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক বিপ্লবটাকেও ধ্বংস করে দিয়ে। রুশ বিপ্লবের ব্যর্থতার কার্যকারণ নিয়ে যত রকমের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণই করা হোক না কেন, ব্যর্থতার অন্তর্নিহিত কারণ বোঝা যাবে না, যদি আমরা রুশ বলশেভিক নেতাদের মার্কস পাঠে সীমাবদ্ধতার বিপদটাকে গুরুত্ব না দেই।
এ কথা ঠিক যে, মার্কসীয় ধারার বিপ্লব করার জন্য ‘পুঁজি’ গ্রন্থ পাঠ অবশ্যই জরুরি। তবে এক্ষেত্রে মার্কসের ‘পুঁজি’ বোঝা যতটা জরুরি, ঠিক ততটাই জরুরি তার সামগ্রিক দর্শনটা বোঝা। আবার একথাও ঠিক, মার্কসের প্রথম জীবনের মৌলিক গ্রন্থগুলো পাঠ না করলে মার্কসীয় দর্শনের সামগ্রিকতা বোঝা সম্ভব নয়। আর এখন বোঝা যায়, বিপ্লব করতে নেমে লেনিনসহ বলশেভিক নেতাদের একটা সীমাবদ্ধতা ছিল মার্কসের সামগ্রিক দর্শন বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে।
দুই
মার্কস শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেছেন; কিন্তু শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কে তার ধারণা-মার্কসবাদীদের ধারণার মতো ছকে বাঁধা সরলরৈখিক ছিল না। ভবিষ্যতের সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজমের ভাবনা মাথায় রেখে মার্কস শুধু শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির কথাই ভাবেননি, সমগ্র মানুষের মুক্তির কথাও ভেবেছেন। মার্কস বলেন, ‘প্রোলেতারিয়েত শ্রেণি শুধু নিজেকে মুক্ত করে না, অন্যান্য নির্বিত্ত শ্রেণিকেও মুক্ত করে।’
আবার মার্কস যখন সমগ্র মানুষের মুক্তির কথা বলেন, তখন প্রোলেতারিয়েতকেও সব মানুষের মুক্তির কথা ভাবতে হয়। তা হলে মার্কস নিশ্চয়ই প্রোলেতারিয়েত বলতে অবিকশিত নিম্ন সাংস্কৃতিক মানসম্পন্ন কোনো শ্রেণিকে বোঝেননি। বুঝেছেন চিন্তায়, চেতনায়, বুদ্ধিমত্তায় অতি উচ্চমানের শ্রেণিকে। মার্কসীয় দর্শনমতে প্রোলেতারিয়েতকে শুধু শ্রেণিসংগ্রামের রাজনীতি বুঝলেই চলবে না; তার চিন্তায় বিজ্ঞান, দর্শন, মানবিকতা, মানবপ্রেম-এই সবকিছুই থাকতে হবে, এমনকি থাকতে হবে দর্শন ও ধর্মবোধও।
মার্কস প্রোলেতারিয়েতের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবে মোষের কাঁধে বিপ্লবের জোয়াল চাপিয়ে বিপ্লব করার কথা ভাবেননি। সুতরাং প্রোলেতারিয়েত বিপ্লব বোঝার জন্যও মার্কসের সামগ্রিক দর্শন বোঝা জরুরি।
মানুষ, জগৎ ও সমাজ সম্পর্কে মার্কসের সামগ্রিক ধারণাগুলো অনুধাবন করলে এবং তার সারা জীবনের অধ্যয়ন ও চিন্তাচর্চার বৈচিত্র্যের দিকগুলো লক্ষ করলে বোঝা যায়-তার চিন্তা শুধু শ্রেণিশোষণ ও শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যেই সীমিত থাকেনি। ধর্ম, দর্শন, মিথ, লোককথা, কাব্যিকতা, স্পিরিচুয়ালিটি-এমন আরও বহু অনুষঙ্গ তার চিন্তাচর্চার অন্তর্গত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
এই সবকিছুই তার সমগ্র জীবনের অধ্যয়ন ও চিন্তার নিত্যসঙ্গী হয়ে থেকেছে। তিনি হোমারের সব রচনা এবং পুরো ‘আরব্য রজনী’ বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছেন; পাঠ করেছেন প্রায় সব গ্রিক নাটক ও কাব্য। আরও পড়েছেন ভলতেয়ার, রুশো, বালজাকসহ ফরাসি সাহিত্যের বিপুল সম্ভার। পাঠ করেছেন প্রাচীন গ্রিক দর্শন এবং কান্ট, হেগেল, লাইবনিজ ও স্পিনোজাসহ প্রাক-আধুনিক ইউরোপের দর্শন।
পাঠ করেছেন ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ারের ভ্রমণকাহিনি। তার পাঠের তালিকায় গুরুডুন ও ‘ডন কিহোতে’র (Don Quixote) মতো বইপত্রও ছিল। তিনি গভীর মনোযোগ সহকারে বহুবার পাঠ করেছেন ‘এস্কাইলাস’ এবং শেক্সপিয়ারের সব নাটক ও কাব্য। শেক্সপিয়ার তিনি এত গভীরভাবে এবং এতবার পড়েছেন যে, তার কনিষ্ঠ কন্যা এলেনর তাকে শেক্সপিয়ারের ‘বাইবেল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আবার পশ্চিমা পুঁজিবাদী সমাজে জন্ম ও বেড়ে ওঠার কারণে মানুষ এবং জগতের ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মহত্তম ধারণাগুলো; যেমন- যুক্তিবাদী চিন্তাচর্চা, সব ধরনের পরাধীনতা, বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তি ও প্রগতির ধারণাগুলো মার্কস অর্জন করেছেন পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী সমাজ থেকেই। সেইসব মহৎ চিন্তা, প্রজ্ঞা ও মূল্যবোধের চর্চা পাশ্চাত্যের আজকের বৈশ্বিক পুঁজিবাদী সমাজে বেশি করে সরব ও সক্রিয়। এ জন্যই দেখা যায়, মার্কস সবচেয়ে বেশি ও গুরুত্বসহকারে পঠিত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতেই।
মার্কস জগতে মানুষের চেয়ে মহান ও বিস্ময়কর আর কিছু মনে করতেন না। মানুষ সম্পর্কে তার আবেগ এত গভীর ছিল যে, আবেগ প্রকাশের জন্য বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই তিনি অন্তত একবার হেগেলের সেই বিখ্যাত উক্তিটি উচ্চারণ করতেন- ‘এমনকি ঘোরতর অপরাধী একজন মানুষের চিন্তাও স্বর্গের চেয়ে উত্তম ও মহিমময়।’
মার্কস সম্পর্কে এখানে এত কথা বললাম এজন্য যে, মার্কস পূর্ব থেকে বিরাজমান কোনো ‘মার্কসবাদ’ পাঠ করে ‘মার্কস’ হননি। জীবন, জগৎ, মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে বৈচিত্র্যময় অধ্যয়ন এবং দার্শনিক চিন্তাচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি ‘মার্কস’ হয়েছেন। এখন কথা হলো-এই মার্কসকে পুরোপুরি না বুঝে অথবা অর্ধেকটা বুঝে সমাজ পরিবর্তন এবং মানুষের মুক্তির মহৎ কর্ম (সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম) সম্পাদন করা কী করে সম্ভব?
তিন
বর্তমান নিবন্ধে রাশিয়ার বিপ্লব, রুশ সমাজতন্ত্র এবং তার পতন সম্পর্কে যখন আমাদের আলোচনা, তখন রুশ বিপ্লবের ইতিহাসটা একনজর ফিরে দেখা জরুরি। সে ইতিহাস তো প্রায় সবারই জানা, তাই ক্ষুদ্র পরিসরের এই সমীক্ষামূলক লেখায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি অনেক পাঠকের কাছেই হয়তো বিরক্তিকর মনে হবে। তবু রুশ বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি, প্রবণতা ও তার পরিণতি বোঝার জন্য ঘটনাপ্রবাহের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত, পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে এখানে তুলে ধরব এবং সে ইতিহাস তুলে ধরব রুশ কমিউনিস্ট সরকার এবং বলশেভিক পার্টির লেখা ইতিহাসের অনুকরণে নয়।
কারণ সে ইতিহাস আবেগ ও বিপ্লবী উন্মাদনার ভারে ভারাক্রান্ত এবং একপেশে, যা সব দেশের বিপ্লবের (বা মুক্তিযুদ্ধের) ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে ঘটে থাকে। তবে এখানে সে ইতিহাসে যাওয়ার আগে মার্কসীয় ধারার রাজনীতিতে বহুল আলোচিত প্রবচন ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করে নিলে রুশ বিপ্লব ও লেনিনবাদী ধারার অন্যান্য বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি বুঝতে সুবিধা হবে।
উনিশ শতকের শেষের দিকে (১৮৭১ সালে) ফ্রান্সের বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের রক্তাক্ত শ্রেণিসংগ্রামের মাধ্যমে শ্রমিক রাজত্ব ‘প্যারি কমিউন’ প্রতিষ্ঠা হয় এবং ১০ সপ্তাহের মধ্যেই তার রক্তাক্ত পতন ঘটে। মার্কস প্যারি কমিউনের উত্থানে উদ্বেলিত ও আবেগাপ্লুত হলেও অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে মন্তব্য করেছিলেন, ‘Time was not allowed to the Commune’; অর্থাৎ প্যারি কমিউন সময়োচিত ছিল না। সেই প্যারি কমিউনের পতনের পর ইউরোপীয় ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাসের এক আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়। পরিবর্তনটা ঘটল দুইভাবে।
প্রথমত-পুঁজিবাদী ইউরোপে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই (শ্রেণিসংগ্রাম) ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের মধ্যে সীমিত হয়ে গিয়ে ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম অনাগতকালের জন্য (বলতে গেলে চিরকালের জন্য) হিমাগারে স্থান নিল। দ্বিতীয়ত-কমিউন পরবর্তী ইউরোপে ক্লাসিক্যাল পুঁজিবাদী যুগের অবসান ঘটে গিয়ে পুঁজিবাদের নতুন আরেক যুগের উত্থান ঘটল। এই সময় থেকেই (বা কিছুকাল আগ থেকেই) এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর ওপর ইউরোপীয় পুঁজিবাদী দেশগুলোর ঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠন ব্যাপক আকার ধারণ করল।
এসব উপনিবেশিত দেশগুলোর বিপুল অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচারের মাধ্যমে ইউরোপের পুঁজিবাদী দেশগুলোর পুঁজি অকল্পনীয়ভাবে ফুলে- ফেঁপে এমন স্ফীতিলাভ করল যে, পুঁজিবাদ তখন ক্লাসিক্যাল ফর্ম পাল্টিয়ে সাম্রাজ্যবাদী স্তরে উন্নীত হলো। ততক্ষণে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর শ্রমিকশ্রেণির জীবনযাপনের মান অতীতের তুলনায় অনেক উন্নত হওয়ার ফলে এবং সমাজে বুর্জোয়া সংস্কৃতির হেজেমনি প্রতিষ্ঠা হওয়ার কারণে তাদের কাছে ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম অতীতের স্মৃতিতে পরিণত হলো।
এর ফলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ঔপনিবেশিক শোষণ, লুণ্ঠন ও নিপীড়ন তীব্র আকার ধারণ করার কারণে, এসব দেশে উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম-লড়াই জোরদার হওয়ার মাধ্যমে শ্রেণিসংগ্রাম এক ভিন্ন আঙ্গিকে হাজির হলো। এসব দেশে শ্রেণিসংগ্রাম হাজির হলো, জাতীয় মুক্তি ও গণতান্ত্রিক মুক্তির বিপ্লবের রূপ নিয়ে।
এই বিপ্লব হলো, প্রথমত-ঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগের (সশস্ত্র) লড়াইয়ের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তি তথা স্বাধীনতা অর্জন; দ্বিতীয়ত-সার্বভৌম রাষ্ট্র পরিগঠনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জাতিসত্তাগুলোর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার নিশ্চিত করা এবং কৃষকসহ দেশের জনগণের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের শিল্প ও কৃষি উৎপাদন, প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং জাতীয় পুঁজি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া।
গণতান্ত্রিক বিপ্লব এক দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লব। বলতে গেলে এক শতাব্দী বা আরও দীর্ঘ সময়ের বিপ্লব। পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবেরই পরিপূর্ণতা লাভ করতে সময় লেগেছে প্রায় দেড়শ বছর। তবে এই বিপ্লব সম্পন্ন হয় কোনো একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দ্বারা নয়, সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দ্বারা। এমনকি রাষ্ট্র যদি শ্রমিকশ্রেণির পার্টির নেতৃত্বে কিংবা কোনো দার্শনিক বা ধর্মীয় মতবাদ দ্বারাও পরিচালিত হয়, তবু গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মূল ভিত্তি হবে অবশ্যই গণতন্ত্র। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য একচ্ছত্র কর্তৃত্ববাদী শাসন বা একনায়কতন্ত্র (Dictatorship) প্রয়োগের কোনোই সুযোগ নেই। আসলে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় জোরজবরদস্তি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও একনায়কতান্ত্রিকতার ধারণা এক বিমূর্ত বা অবাস্তব ধারণা। মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ রাষ্ট্রের জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক সৃজনশীল কাজ।
দার্শনিক বিচারে এই মহৎ সৃজনশীল কাজে একক কর্তৃত্ববাদী শাসন ও ডিক্টেটরশিপ কখনোই ন্যায্য ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আবার গণতান্ত্রিক বিপ্লবের এই ধারণার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আরেক অভ‚তপূর্ব বিপ্লবের ধারণা। সেটি হলো-রাষ্ট্র ও সমাজের সব ক্ষেত্রে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক হেজেমনি বা প্রভাবলয় সৃষ্টি করার বিপ্লব, যার প্রথম প্রবক্তা হলেন ইতালির কমিউনিস্ট নেতা ও তাত্তি¡ক আন্তোনিও গ্রামসি।
তা ছাড়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলতে শুধু জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকেই বোঝায় না, জমি বণ্টন বা ভূমি ব্যবস্থার সংস্কারও গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এমনকি কৃষিজমি জাতীয়করণ করা হবে, না কৃষকদের ব্যক্তিমালিকানাধীন থাকবে; তা নির্ধারণ হবে কৃষকদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক মতামতের ভিত্তিতে। রুশ বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনায় যে সীমাবদ্ধতাগুলো পরিলক্ষিত হয় এবং অক্টোবর বিপ্লবকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বিপ্লব বলার যে বিভ্রান্তি ঘটে, তা হয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব না বোঝার কারণেই। গণতন্ত্রের উচ্চতম রূপই যে সমাজতন্ত্র তা-ও বোঝা যায় না গণতান্ত্রিক বিপ্লব না বোঝার কারণে।
গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে আরও কথা হলো-পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে এই বিপ্লব পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মতো নয়। ঔপনিবেশিক-নয়া ঔপনিবেশিক দেশগুলোর গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলো মূলত ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। এসব দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব জাতীয় মুক্তির বিপ্লবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যা জাতীয় মুক্তির বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর চলমান নতুন নতুন বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণের মাধ্যমে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে দীর্ঘ পথ ধরে অগ্রসর হবে।
বিশ শতকের গোড়া থেকেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের উপরোক্ত ধারা শুধু পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের উপনিবেশিত দেশগুলোর জন্যই প্রযোজ্য ছিল না, রাশিয়ার জন্যও প্রযোজ্য ছিল। কারণ রাশিয়া পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপনিবেশ না হলেও, সে অভ্যন্তরীণ জার সাম্রাজ্যবাদের জাতিগত শোষণ, লুণ্ঠন ও নিপীড়নের শিকার ছিল। জার-শাসিত বৃহত্তর রাশিয়ার (রুশ সাম্রাজ্যের) বহু জাতিসত্তা অধ্যুষিত ভূখণ্ডগুলো ছিল জার সাম্রাজ্যবাদের জবরদখলকৃত (উপনিবেশিত) ভূখণ্ড। এ কারণেই জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রণনীতি ও রণকৌশল অনুযায়ী রাশিয়ার অবস্থা ছিল তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক-সামন্ততান্ত্রিক দেশগুলোর মতোই। লেনিনও রুশ বিপ্লবকে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবই বলেছিলেন; কিন্তু মার্কসীয় দর্শন আধাআধি বোঝার কারণে বলশেভিকদের হঠকারিতা ও চরমপন্থা অবলম্বনের ফলে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক বিপ্লব ভুল ও আত্মঘাতী পথে অগ্রসর হয়েছিল।
চার
রুশ বিপ্লবের ইতিহাসের কথায় এবার আসি। এর আগে আমরা দেখেছি পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপ সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটেছিল বিশ শতকের গোড়াতেই ‘লেনিনীয় যুগেই’। এই সময়গুলোতেই লেনিন গুরুত্ব সহকারে সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করেন এবং রাশিয়া ও তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক দেশগুলোর বিপ্লবের রূপরেখা তুলে ধরেন। অন্যদিকে ওই সময়টা ছিল ইতিহাসের এক ক্রান্তিকাল। কারণ
প্রথমত-তখন এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জনগণের উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম-লড়াই বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে একদিকে এসব দেশে জাতীয় মুক্তির বিপ্লবের ময়দান উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো চাপের মুখে পড়ে। দ্বিতীয়ত-ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে উদ্ভূত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চাপে ওইসব দেশের অবস্থা তখন অনেকটাই নাজুক।
তৃতীয়ত-পশ্চিমা উপনিবেশবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণমুক্ত থেকেও রাশিয়ায় অভ্যন্তরীণ জার সাম্রাজ্যবাদ ও জার সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে রুশ জনগণের লড়াই তখন তুঙ্গে। এমনকি জার শাসনের পতন তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ঠিক এমন সময়ের মধ্যে, ইউরোপে নির্বাসনে থেকেই রুশ বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিন লক্ষ্য স্থির করলেন রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আগে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার। অতঃপর সেই লক্ষ্য অনুযায়ী বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে সংঘটিত অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব (অনেক মার্কসবাদীর ভাষায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব) শুরু হয়, তার উত্থান-পতন নিয়ে এই আলোচনায় এখন আমরা রুশ বিপ্লবের গতি-প্রকৃতির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চাই।
রাশিয়া ছিল একটি অবিকশিত দুর্বল পুঁজিবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক পশ্চাৎপদ দেশ। সেখানে বহু জাতিসত্তা অধ্যুষিত ভূখণ্ড গুলো ছিল জার সাম্রাজ্যবাদের জবরদখলকৃত (উপনিবেশিত) ভূখণ্ড। এজন্য রাশিয়ার বিপ্লবটা ছিল একই সঙ্গে জার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিপীড়িত জাতিগুলোর জাতীয় মুক্তি তথা আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার বিপ্লব এবং জার সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে কৃষকসহ পুরো জনগণের গণতান্ত্রিক বিপ্লব। অর্থাৎ সেটি ছিল লেনিনের ভাষ্যমতেই ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব’। সেই বিপ্লব রাশিয়ার শুধু শ্রমিকশ্রেণির দ্বারা অথবা অন্য যে কোনো একটি শ্রেণি বা গোষ্ঠীর দ্বারা সফল করা সম্ভব ছিল না। সেই বিপ্লবে দল-মত-শ্রেণি নির্বিশেষে সব দেশপ্রেমিক ও গণতন্ত্রের পক্ষের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য ছিল।
সেই প্রেক্ষাপটেই জার সাম্রাজ্যবাদ ও জার সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে ১৯১৭ সালের ফেব্রæয়ারিতে রাশিয়ার লিবারেল ডেমোক্র্যাট, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, বিপ্লবী সোশ্যালিস্ট ও বলশেভিক পার্টিসহ সব জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইতিহাসে যা ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে খ্যাত। সেই বিপ্লবের মাধ্যমেই জার সাম্রাজ্যবাদ ও জারতন্ত্র উচ্ছেদ হয়। দ্বিতীয় জার নিকোলাস ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন।
ইতালির কমিউনিস্ট নেতা ও মার্কসীয় দর্শনের বোদ্ধা তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি রাশিয়ার ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সম্পর্কে এই মতামত ব্যক্ত করেন যে, ‘১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সফল হওয়ার পেছনে রাশিয়ার পুঁজি ও শ্রমের মধ্যকার অবিকশিত দ্বন্দ্ব এবং শ্রমিকশ্রেণির সংখ্যাল্পতার কারণে শ্রমিকশ্রেণির বাইরে বিপ্লবের আরও বহু গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ণায়ক দ্ব›দ্ব ছিল এবং তা ছিল খুবই তীব্র।’ গ্রামসির বক্তব্যের সেই তীব্র দ্বন্দ্বগুলোর কথা একটু আগেই আমরা উল্লেখ করেছি। সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির বিপ্লব যে জাতীয় মুক্তি ও গণতান্ত্রিক মুক্তির বিপ্লব, সে বিষয়েও কারও কোনো সন্দেহের অবকাশ ছিল না।
প্রসঙ্গত, বিশ শতকের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চ্যালেঞ্জের মুখে রাশিয়ার মতো পশ্চাৎপদ দেশে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করা ছিল দীর্ঘকালীন এক বিশাল কর্মকাণ্ড। সেটি ছিল শিল্প ও কৃষি উৎপাদন, প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং সর্বোপরি গ্রামসির ভাষায় ‘সাংস্কৃতিক হেজেমনি’ প্রতিষ্ঠায় পশ্চিমা উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোকে ছাড়িয়ে যাওয়ার অথবা সমকক্ষতা অর্জন করার বিপ্লব। সেই বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজন ছিল বহু বহু বছরের (অন্তত একশ বছরের) দীর্ঘ এক বিশাল কর্মযজ্ঞের। আর গণতান্ত্রিক বিপ্লবের বিশাল কর্মযজ্ঞ সফল করা, চিরায়ত শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বের বৃত্তের মধ্যে অবস্থান করে কেবল শ্রমিকশ্রেণির কর্তৃত্ববাদ ও বলপ্রয়োগের শাসনের মাধ্যমে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। আর সেই বিশাল কর্মকাণ্ড সফল করার মূলতন্ত্র হলো-গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা।
ভ্লাদিমির লেনিনের উত্থান এবং রুশ অক্টোবর বিপ্লব রাশিয়ায় ফেব্রুয়ারি বিপ্লব যখন সংঘটিত হয়, তখন বলশেভিক নেতা লেনিন তার দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবনে সর্বশেষ সুইজারল্যান্ডে নির্বাসিত। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ইতোমধ্যে রাশিয়ার লিবারেল ডেমোক্র্যাটস, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস ও বিপ্লবী সোশ্যালিস্টদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার (Provisional Government) গঠন করা হয়েছে। এদিকে সুইজারল্যান্ড থেকে পাঠানো লেনিনের নির্দেশক্রমে বলশেভিক পার্টি সেই সরকারে যোগ দেয়নি।
লেনিন জার্মান সরকারের সহযোগিতায় সুইজারল্যান্ড থেকে জার্মানি ও ফিনল্যান্ড হয়ে রাশিয়ায় এসে পৌঁছলেন এপ্রিলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হওয়ার দুই মাস পর। ১৬ এপ্রিল লেনিন পেট্রোগ্রাদে এসে পৌঁছলে তরুণ বলশেভিক নেতা-কর্মীরা বিপ্লবী উন্মাদনার মধ্য দিয়ে তাকে সংবর্ধনা দেন। ১৭ এপ্রিল লেনিন খুবই নাটকীয়ভাবে নতুন আরেকটি বিপ্লবের ডাক দিয়ে বলশেভিকদের উদ্দেশে ১০টি নির্দেশনামূলক ঘোষণাপত্র সংবলিত একটি সংক্ষিপ্ত থিসিস প্রদান করলেন, যা ইতিহাসে ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে খ্যাত। ‘এপ্রিল থিসিস’ ছিল মূলত শ্রমিকশ্রেণির বলপ্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের এক তাৎক্ষণিক ‘রণকৌশলগত’ তত্ত্ব।
এপ্রিল থিসিসের ঘোষণা অনুযায়ী লেনিন যে নতুন বিপ্লবের ডাক দিলেন সেটি হলো-রুশ লিবারেল ডেমোক্র্যাটস, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস ও বিপ্লবী সোশ্যালিস্টদের মধ্যকার ‘সুবিধাবাদী’ গোষ্ঠী এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীদের বিপ্লবের শত্রু (শ্রেণি শত্রু) গণ্য করে তাদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রামের ডাক। অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণির পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে সোভিয়েত ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার ডাক দিলেন তিনি।
উল্লেখ্য, এপ্রিল থিসিসের ৮নং ঘোষণায় বলা ছিল-‘আমাদের এখনকার কর্মসূচি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব নয়।’ অর্থাৎ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যেই লেনিন তার ভাষায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াশ্রেণির’ বিরুদ্ধে ‘প্রোলেতারিয়েত’ শ্রেণির সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দিলেন।
প্রসঙ্গত, ১৬ এপ্রিল লেনিন পেট্রোগ্রাদে এসে পৌঁছলে তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সমবেত বলশেভিক নেতাদের অনেকেই তাকে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সফল করার আবেদন জানান; কিন্তু লেনিনের ১৭ এপ্রিলের বক্তব্য তাদের হতবাক করে দেয়। লেনিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা পুরোপুরি বর্জন করে তাদের বিরুদ্ধেই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল এবং শ্রমিকশ্রেণির পার্টির একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার ডাক দিলে বলশেভিক নেতাদের অনেকেই এটাকে দীর্ঘস্থায়ী পরিণামে রাশিয়ার জন্য অমঙ্গল হবে বলেও মন্তব্য করেন।
এমনকি বলশেভিক পার্টির বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ নেতা এবং দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে লেনিনের সহ-কমরেড লেভ কামেনেভ যুক্তিসহকারে লেনিনকে নমনীয় লাইন গ্রহণ করার অনুরোধ জানান। তিনি লেনিনকে কঠোর লাইন বর্জন করে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস, বিপ্লবী সোশ্যালিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটসসহ সব দেশপ্রেমিক জনগণকে সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করার পরামর্শ দেন; কিন্তু সব মতামত, পরামর্শ অগ্রাহ্য করে লেনিন তার নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। অবশ্য বলশেভিক পার্টির ‘অতিবামপন্থিরা’ লেনিনকে সর্বান্তকরণে সমর্থন দেন। এ সময় কট্টর বামপন্থিদের মুখে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরিবর্তে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্লোগান উচ্চকিত হতে থাকে (হায়, বলশেভিকরা যদি দার্শনিক মার্কসকে বুঝতে পারত!)।
এদিকে এপ্রিল থিসিস অনুযায়ী গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ঘোষণা ও কর্মসূচির মধ্যেই থিসিসের ২নং নির্দেশনায় যখন বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বাধীন সোভিয়েতের (ওয়ার্কার্স কাউন্সিলের) হাতে রাষ্ট্রের ‘সর্বময় ক্ষমতা’ অর্পণের কথা বলা হলো, তখন তার মধ্যে শুধু শ্রেণিসংগ্রামই নয়, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠারও ‘অশনিসংকেত’ পাওয়া গেল, যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস ও বিপ্লবী সোশ্যালিস্টদের ‘বুর্জোয়া’ মনোভাবাপন্ন অংশ, দেশপ্রেমিক জাতীয় চেতনাসম্পন্ন পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীসহ বলশেভিকদের মতের বাইরে সব দল, মত ও গোষ্ঠীর ওপর একনায়কত্ব (ডিক্টেটরশিপ) প্রতিষ্ঠা। আর সন্দেহাতীতভাবে তার মহান লক্ষ্য হলো ডিক্টেটরশিপ প্রয়োগের মাধ্যমে রাশিয়ায় ‘গণতন্ত্র’ ও ‘সমাজতন্ত্র’ দুটোই প্রতিষ্ঠা করা। অথচ মার্কসের দর্শন অনুযায়ী সমাজতন্ত্র হলো গণতন্ত্রেরই উচ্চতম রূপ।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, বলশেভিকদের এই শ্রেণিসংগ্রামের সঙ্গে প্যারি কমিউনের ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের মিল-অমিল দুটোই ছিল। মিল ছিল অনুকরণে, আর অমিল ছিল অনুশীলনে। প্যারি কমিউনের শ্রেণিসংগ্রাম ছিল পূর্ণমাত্রায় বিকশিত বুর্জোয়াশ্রেণির বিরুদ্ধে বিকশিত শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের বিপ্লব। আর বলশেভিকদের শ্রেণিসংগ্রামের লক্ষ্য ছিল দেশপ্রেমিক লিবারেল ডেমোক্র্যাটস ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ওপর (যারা ছিল জারবিরোধী জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রত্যক্ষ অংশীদার এবং যাদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব ছাড়া জারতন্ত্র উচ্ছেদ সম্ভব হতো না) তাদের ওপর রাশিয়ার অবিকশিত পশ্চাৎপদ শ্রমিকশ্রেণির নিপীড়নমূলক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা। তা ছাড়া ইউরোপে প্যারি কমিউনের পতনের পর পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদে বিকশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে যে ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রামের যুগের অবসান ঘটে গিয়েছিল, এই অঙ্ক বলশেভিকদের মাথায় ছিল না।
তদুপরি সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদ যে শতাব্দীকাল বা আরও বেশি সময় ধরে বৈশ্বিক রূপ নিয়ে বিশাল অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও সাংস্কৃতিক হেজেমনির প্রভাববলয় তৈরি করে শক্তিশালীভাবে টিকে থাকবে, এই ধারণাও বলশেভিকদের মাথায় ছিল না। বরং তাদের কাছে সাম্রাজ্যবাদ ছিল ক্ষয়িষ্ণু, পতনোন্মুখ, যা অচিরেই ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। বলশেভিকদের চিন্তায় এমনটি ঘটেছে মূলত গ্রামসির ভাষায় ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিয়মগুলো না বোঝার কারণে’।
এ ছাড়াও সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের পর সাম্রাজ্যবাদী শোষণের ঔপনিবেশিক চরিত্র পাল্টে গিয়ে যে নয়া ঔপনিবেশিক চরিত্র ধারণ করবে এবং সেই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শ্রেণিসংগ্রামের রূপও যে পাল্টে যাবে এবং তার ফলে পশ্চাৎপদ দেশগুলোর গণতান্ত্রিক বিপ্লব শুধু অবিকশিত শ্রমিকশ্রেণির একক নেতৃত্বে সফল করা সম্ভব হবে না, তার জন্য সব দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল শক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য হয়ে পড়বে-এই অতিনিকট দূরদর্শী চিন্তাও বলশেভিকদের মাথায় ছিল না।
বরং প্যারি কমিউনের অনুকরণে তাদের চিন্তায় ছিল শুধু ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম (যে ক্লাসিক্যাল শ্রেণিসংগ্রাম প্যারি কমিউনের পতনের পর হিমাগারে স্থান নিয়েছে)। এমন অবস্থার মধ্যেই বলশেভিকরা প্যারি কমিউনের অনুকরণে রাশিয়ায় ক্লাসিক্যাল শ্রেণিবিপ্লবের ডাক দিয়েছিল। সেই হিসেবে রুশ অক্টোবর বিপ্লব ছিল এক অভিনব এবং ইতিহাসে সবচেয়ে অনিশ্চিত এক চ্যালেঞ্জিং বিপ্লব। অবশ্যই সে বিপ্লবের মহানায়ক হলেন বলশেভিক নেতা ভ্লাদিমির লেনিন এবং অবিশ্বাস্যভাবে তিনি সে বিপ্লব তাৎক্ষণিকভাবে জয়যুক্তও করলেন।
এপ্রিল থিসিসের ভিত্তিতে বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে সংঘটিত হলো যে অক্টোবর বিপ্লব, সেই বিপ্লব নিয়ে যেমন ছিল দুনিয়াব্যাপী বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, তেমনি ছিল নানা মত ও বিশ্লেষণ। অনেক বিশ্লেষকদের মতে, সংখায় অল্প ও অবিকশিত শ্রমিকশ্রেণির অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই বিপ্লব সফল করা সম্ভব হতো না, যদি তাৎক্ষণিকভাবে জার আমলের নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সবচেয়ে দক্ষ ৩০ হাজার সৈন্য (যাদের মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ক-অক্ষর ধারণা ছিল না) তারা বন্দুকের নল ঘুরিয়ে বলশেভিকদের পক্ষে না দাঁড়াত। এজন্য অনেকে অক্টোবর বিপ্লবকে একধরনের ‘ক্যু-দেতা’ বলেও মনে করেন। তবে যে যা-ই বলুন, বিচক্ষণ লেনিন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্রান্তিকালকে মোক্ষম সময় হিসেবে কাজে লাগিয়ে, অন্তর্বর্তীকালীন চেরেনেস্কি সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে এবং অভাবনীয় রণকৌশলের মাধ্যমে জার সেনাবাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্যকে ব্যবহার করে যেভাবে অক্টোবর বিপ্লবকে জয়ী করেছিলেন তা ইতিহাসে এক বিস্ময়কর কীর্তি হয়ে থাকবে।
কিন্তু একই সময়ে ইতিহাসের এই মহাকীর্তির ওপর আরেক ‘মহা অপকীর্তির’ ছায়া পড়ল। সেটি হলো ডিক্টেটরশিপের কালো ছায়া। অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ার গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ওপর চেপে বসল বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় শাসন ও ডিক্টেটরশিপ। প্রচার করা হলো-‘প্রোলেতারিয়েত’ ডিক্টেটরশিপ নাকি মার্কসের শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বের সারাৎসার। দুনিয়া প্রকম্পিত করে বিপ্লবী উন্মাদনায় মদমত্ত দেশ-বিদেশের মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগল-‘অক্টোবর বিপ্লব জিন্দাবাদ’, ‘প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ জিন্দাবাদ’, ‘সমাজতন্ত্র দীর্ঘজীবী হোক’ ইত্যাদি স্লোগান, যাদের কণ্ঠে স্লোগান উচ্চারিত হলো তারা বিশ্বাস করল এটাই গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব; এটাই মার্কসবাদ। আর এদিকে বলশেভিকরা শপথ নিল ডিক্টেটরশিপ প্রয়োগ করে রাশিয়ায় গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র দুটোই প্রতিষ্ঠা করার। অথচ মার্কসীয় দর্শন মতে সমাজতন্ত্র হলো কমিউনিজমের প্রথম ধাপ, যা গণতন্ত্রেরই উচ্চতম রূপ। সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার যেটি ঘটল সেটি হলো-অক্টোবর বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ায় প্রোলেতারিয়েতের নামে প্রতিষ্ঠিত হলো কমিউনিস্ট পার্টির আমলাতান্ত্রিক একনায়কত্ব।
প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ
এক কুজ্ঝটিকাময় প্রহেলিকা
মার্কসবাদী-লেনিনবাদীরা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বহারার একনায়কত্ব তথা প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপের তত্ত্বকে মার্কসের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব বলে মনে করেন; কিন্তু ‘প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ’ কথাটা নিয়ে অনেক প্রহেলিকা আছে, বিতর্ক আছে। ১৮৭৫ সালে জার্মানির গোটা (এড়ঃযধ) নামক শহরে বিভিন্ন জার্মান সমাজতান্ত্রিক দলগুলো এক সম্মেলনে বসে একটি ঐকবদ্ধ সমাজতান্ত্রিক দল গঠনের লক্ষ্যে দলের কর্মসূচি প্রণয়ন করে তার কপি মার্কসের কাছে তার মন্তব্যের জন্য পাঠিয়েছিল এবং মার্কস সেই কর্মসূচি সম্পর্কে কিছু মন্তব্য লিখে পাঠিয়েছিলেন।
সেখানে তিনি এক জায়গায় শ্রমিক ও নির্বিত্ত শ্রেণির একনায়কত্ব (ডিক্টেটরশিপ) কথাটা উল্লেখ করেছিলেন; কিন্তু মার্কস তার জীবদ্দশায় সেই লেখাটি তার কোনো গ্রন্থেও অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা সেটি আলাদাভাবে কোথাও প্রকাশের জন্যও পাঠাননি। তা ছাড়া মার্কসের সারা জীবনের লেখা অন্য কোনো গ্রন্থে বা প্রবন্ধে প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ কথার উল্লেখ পাওয়া যায় না। মার্কসের লেখালেখি ও তা প্রকাশের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এরকম অনেক লেখাই তিনি লেখার পর প্রকাশের জন্য কোথাও পাঠাননি, যেগুলোকে তিনি চূড়ান্ত বা নিশ্চিত বলে মনে করেননি। এই হলো মার্কসের প্রোলেতারিয়েত ডিক্টেটরশিপ ‘তত্ত্বে’র ইতিহাস। তবে এর প্রহেলিকা বোঝার জন্য ইতিহাসের বাকিটুকু মনে হয় এখানে তুলে ধরা দরকার।
গোটা (Gotha) কর্মসূচি সম্পর্কে লেখা মার্কসের মন্তব্যগুলো ১৬ বছর পর এবং মার্কসের মৃত্যুর আট বছর পর ১৮৯১ সালে ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস প্রকাশ করেছিলেন এক বিশেষ উদ্দেশে। তখন জার্মান সোশ্যালিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে উদ্ভূত দ্বন্দ্বে ও বিতর্কে সুবিধাবাদী চক্রের বিরুদ্ধে তার (এঙ্গেলসের) অবস্থানকে শক্তিশালী করে তোলার জন্য মার্কসের সেই মন্তব্যগুলো ‘গোটা কর্মসূচির সমালোচনা’ শিরোনাম দিয়ে পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেন। পার্টির মধ্যকার সেই উত্তপ্ত বিতর্কে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করার জন্য পুস্তিকাটি প্রকাশ করার সময় এঙ্গেলস কোনো স্বাধীনতার আশ্রয় নিয়েছিলেন কিনা, অর্থাৎ মার্কসের মন্তব্যের সঙ্গে আরও কিছু ব্যাখ্যা যোগ করেছিলেন কিনা-এরকম একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে।
বিরোধী পক্ষ থেকে তখন প্রশ্ন উঠেছেও। যা হোক, এঙ্গেলসের প্রকাশিত সেই পুস্তিকাটি পরবর্তীকালে রাশিয়ায় পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল এবং অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ার গণতান্ত্রিক বিপ্লবে (এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে?) নিপীড়নমূলক ডিক্টেটরশিপ প্রয়োগের কাজে বলশেভিকরা ওই দলিলটিকে মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল।
আজ প্রশ্ন জাগে- এঙ্গেলস কি তখন কল্পনা করতে পেরেছিলেন যে, তার দ্বারা প্রকাশিত এই ‘প্রহেলিকাময়’ পুস্তিকাটি ২৬ বছর পর রুশ বলশেভিকদের কাছে বিপ্লব করার ‘বাইবেল’ হয়ে উঠবে, আর তার ফলে মার্কসীয় ধারার কমিউনিস্ট আন্দোলন অন্তত একশ বছরের জন্য পিছিয়ে যাবে?
অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় বলশেভিক ডিক্টেটরশিপের মহাযজ্ঞ খুব ভালোই জমেছিল। বলা হয়ে থাকে ডিক্টেটরশিপ প্রয়োগ করা হয়েছিল শুধু প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়াদের ওপর। পশ্চাৎপদ রাশিয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়ার সংখ্যা খুব কম থাকারই কথা। তবে কমিউনিস্ট রাশিয়ায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া’ তকমাপ্রাপ্ত কত হাজার বা কত লাখ মানুষকে ডিক্টেটরশিপের বেদিতে বলি হতে হয়েছিল তার ইতিহাস আছে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব আছে।
আলেক্সান্দ্র সলজেনিৎসিনের মতো বহু লেখক, কবি, বুদ্ধিজীবীর বইপুস্তক পুড়িয়ে ফেলা, তাদের বন্দিশিবিরে পাঠানো, অনেককে দেশ থেকে বিতাড়িত করা, সের্গেই আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র নির্মাণে বাধা প্রদান, ভিন্ন মতাবলম্বীদের পাকড়াও করে কারাগারের বদ্ধ কুটিরে পাঠানো, গোয়েন্দা বাহিনী দিয়ে অগণিত গুপ্তহত্যা-এসবের ইতিহাস আছে।
সোভিয়েত বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে বার্লিনে আশ্রয় নেওয়া এক মার্কসবাদী ধারার রুশ লেখকের প্রখ্যাত ভারতীয় কূটনীতিক ড. সত্যনারায়ণ সিংকে (১৯৬৪ সালে) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারের কথোপকথন-‘সোভিয়েত ইউনিয়নে খুব কম পরিবার আছে, যাদের অন্তত একজনও বলশেভিক ডিক্টেটরশিপের বেদিতে বলি হয়নি। ... সোভিয়েত কাগজগুলো ফ্যাসিবাদ বা নাৎসি বন্দিশিবিরের কাহিনি আজকাল কম লিখছে। এটা তাৎপর্যপূর্ণ। কেন জানেন?
প্রথম মৃত্যুশিবিরগুলো চালু জার্মানরা করেনি, করেছিল সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। প্রথম মৃত্যুশিবির চালু হলো ১৯২১ সালে, মেরু প্রদেশের আরমান জেলমকের কাছে খালসাগোরে। রুশ বন্দিশিবিরের পুরো কাহিনি যদি শোনেন তা হলে নাৎসি শিবিরগুলোকে আপনার কাছে মনে হবে ঢের বেশি সভ্য। সোভিয়েত শিবির জীবন বর্ণনা করে প্রায় ১০ হাজার উপন্যাস, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ ও স্মারক রচনা পৃথিবীর বিভিন্ন সাহিত্য-সাময়িকী ও জার্নালের সম্পাদকের হাতে পৌঁছেছে।’
সোভিয়েত রাশিয়ায়, নাজিবাদের চেয়েও নিষ্ঠুর মৃত্যুশিবিরগুলো গড়ে উঠেছিল ১৯২১ সালে, লেনিনের জীবদ্দশাতেই। প্রশ্ন জাগে, লেনিন কি মৃত্যুশিবিরগুলোর খবর জানতেন? যদি জেনে থাকেন তা হলে মহান গণতন্ত্রী লেনিন কি তা মেনে নিতে পেরেছিলেন? ইতিহাস কাকে দায়ী করবে জানি না। তবে দায়ী তো কোনো ব্যক্তি নন। মার্কসের বৌদ্ধিক দর্শন না বোঝার কারণে, যান্ত্রিক মার্কসবাদ এবং নিপীড়নমূলক ডিক্টেটরশিপের যে ‘ভূত’ বলশেভিকদের ঘাড়ে চেপেছিল সেই ‘ভ‚তের’ দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে অক্টোবর বিপ্লব-পরবর্তী রুশ বিপ্লব।
এখন কথা হলো-মার্কসীয় দর্শনমতে সমাজতন্ত্র যদি গণতন্ত্রের উচ্চতম রূপ হয়, তা হলে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট ডিক্টেটরশিপের এই ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার যথার্থ মূল্যায়ন যদি করতে হয়, তা হলে বলতে হয়-রুশ বলশেভিক নেতাদের মার্কস পাঠে সীমাবদ্ধতার বিপদটাই রুশ বিপ্লবের বিপর্যয়ের প্রধান শর্ত হিসেবে কাজ করেছে।
অনেকে লেনিনকে ‘মহান বিপ্লবী’ (লেনিন অবশ্যই মহান বিপ্লবী) এবং বিশ্বস্ত লেনিনবাদী স্ট্যালিনকে ‘ফ্যাসিবাদী’ আখ্যায়িত করে রুশ বিপ্লবের বিপর্যয়ের সব দায় স্ট্যালিনের বলে সিদ্ধান্ত টানেন। আসলে বিপর্যয়ের কারণ লেনিন, স্ট্যালিন বা অন্য কোনো ব্যক্তি নন। এর কারণ ঐতিহাসিক, যার বাস্তবতা হলো মার্কসকে পুরোপুরি না বোঝার ‘ফের’। গ্রামসির চিন্তাগুলো মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে এই ফেরের ব্যাপারটি পরিষ্কার বোঝা যায়।
এ প্রসঙ্গে রুশ বলশেভিকদের মার্কস চর্চার স্বরূপ বোঝার জন্য, ইতালির কমিউনিস্ট নেতা লেনিনবাদের ইতিবাচক দিকগুলোকে বিবেচনায় রেখেই লেনিনবাদকে অতিক্রম করে মার্কসীয় ধারার সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবের নতুন সৃজনশীল তত্ত্বের ব্যাখ্যাকার আন্তোনিও গ্রামসির কিছু বক্তব্য এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। গ্রামসি তার ‘Revolution Against Capital’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘বলশেভিকরা কার্ল মার্কসকে বর্জন করেছে। তাদের প্রত্যক্ষ কর্মকাণ্ড ও বিজয় প্রমাণ করেছে যে, একদিকে তারা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিয়মগুলো লঙ্ঘন করেছে এবং অন্যদিকে প্রশ্ন করা যাবে না-এমন কতকগুলো মতান্ধতার ভিত্তিতে একটি অনমনীয় মতবাদ গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গি আঁকড়ে ধরার ফলে তারা মহান শিক্ষককে ধারণ করতে পারেনি। তারা মার্কসীয় চিন্তার নামে ধারণ করেছে এক অবিনশ্বর চিন্তা, যা জার্মান ও ইতালীয় ভাববাদের ধারাবাহিকতারই প্রকাশ।’
রুশ মার্কসবাদের সমালোচনা করে একই প্রবন্ধে গ্রামসি বলেছেন, ‘এই তত্ত্বে মানুষকে গণ্য করা হয়েছে অর্থনৈতিক উপাদান হিসেবে। অথচ মানুষ হচ্ছে সমাজের মধ্যে থাকা সেই মানুষ, যে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। যে মানুষ একে অপরের সঙ্গে চুক্তি করে এবং তার মাধ্যমে গড়ে তোলে এক তাৎপর্যপূর্ণ যোগসূত্র বা সভ্যতা। সেই যোগসূত্রতার মাধ্যমে তারা গড়ে তোলে একটি যৌথ, সামাজিক অভীপ্সা। সেই মানুষ যৌথভাবে অর্থনৈতিক ঘটনাবলিকে বুঝতে শেখে, মূল্যায়ন করতে শেখে এবং নিজেদের ইচ্ছার সঙ্গে সেগুলোকে খাপ খাইয়ে নিতে শেখে।’
গ্রামসি সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সমালোচনায় যেসব শব্দ ব্যবহার করেছেন তার মধ্যে দুটি শব্দ খুবই তির্যক, যেমন- ‘গণতন্ত্রের সংকোচন’ এবং ‘সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত স্বার্থগন্ধি আবেগ’। ১৯২৬ সালের শেষের দিকে সোভিয়েত বলশেভিক (কমিউনিস্ট) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিকে লেখা এক চিঠিতে গ্রামসি লিখেছিলেন, ‘কমরেডরা, ইতিহাসে বিগত নয় বছর দেশ-বিদেশের বিপ্লবীরা আপনাদেরকেই বিপ্লবের চালিকাশক্তি মনে করেছে। ...কিন্তু আপনারা যা করছেন তা নিজের সৃষ্টিকে নিজেই ধ্বংস করার শামিল।’
অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় বলশেভিক কমিউনিস্ট পার্টির গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনায় যেসব আত্মঘাতী প্রবণতাগুলো বিপর্যয়ের তাৎক্ষণিক বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছিল তা বোঝার জন্য, গ্রামসির কারারচনায় (প্রিজন নোটে) বিক্ষিপ্তভাবে আলোচিত আরও দুই-একটি মন্তব্য এখানে তুলে ধরা দরকার। যেমন- গ্রামসি বলেছেন, ‘অক্টোবর বিপ্লবের পর সশস্ত্র (নিবর্তনমূলক) একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রে পার্টির প্রাধান্য। এ দুটি ব্যবস্থাই স্তিমিত ও নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছিল বিপ্লবী প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক সম্ভাবনাকে।’
গ্রামসি আরও বলেছেন, ‘রাষ্ট্র যখন পার্টিজান (পার্টি-রাষ্ট্র) হয়ে দাঁড়ায় তখন শুধু তার গণভিত্তিকেই সীমিত করে না, সীমিত করে দেয় তার শ্রেণিগত চৌহদ্দিকেও।’
রাশিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনে হুবহু এমনটিই ঘটেছিল। অবশ্য একথা ঠিক যে, পার্টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া এবং পার্টি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা লেনিনের নয়, বরং তার মধ্যে শ্রেণি ও গণভিত্তিক সোভিয়েতের ধারণাই ছিল প্রধান; কিন্তু এপ্রিল থিসিসে সোভিয়েতের হাতে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণের কথা বলা হলেও তার ওপর বলশেভিক পার্টিরই একচ্ছত্র আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিপত্তিটা ঘটেছে সে কারণেই।
প্রসঙ্গত এখানে বলা দরকার যে, অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নিপীড়নমূলক একদলীয় একনায়কতন্ত্রের যে সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সংকটের বিষয়টি, আজীবন গণতন্ত্রের চর্চাকারী লেনিন উপলব্ধি করেছিলেন বলেই মনে হয়। ১৯২১ সালে কমিনটার্নের তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি যে ‘যুক্তফ্রন্টের’ সূত্র উপস্থাপন করেছিলেন তা থেকেই এটা বোঝা যায়; কিন্তু রাশিয়ার জন্য তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গিয়েছিল।
কারণ, ইতোমধ্যে লিবারাল ডেমোক্র্যাটস ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটসসহ জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মিত্রশক্তিগুলোর সঙ্গে বলশেভিক পার্টির দ্বন্দ্ব যেভাবে চরম বৈরী রূপ নিয়েছিল, সে অবস্থায় রাশিয়ায় লেনিনের যুক্তফ্রন্টের সূত্র বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। তদুপরি, তার অল্প কিছুকাল পর থেকেই লেনিন ছিলেন রোগশয্যায় শায়িত এবং পরে মৃত্যুপথযাত্রী।
আবার এ কথাও সত্য, মার্কস যেমন ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউনের উত্থানে উদ্বেলিত ও আবেগাপ্লুত হয়েছিলেন, তেমনি গ্রামসিও ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের বিজয় দেখে অভিভ‚ত হয়েছিলেন এবং তার অনেক লেখায় তার মতো করে লেনিনবাদের অনেক ইতিবাচক পর্যালোচনাও করেছেন; কিন্তু মার্কস যেমন প্যারি কমিউন নিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েও বলেছিলেন, ‘Time was not allowed do the commune’। গ্রামসি অক্টোবর বিপ্লব সম্পর্কে ওই রকম কোনো মন্তব্য করেননি। কারণ রুশ সমাজতন্ত্রের পতন গ্রামসির জীবদ্দশায় ঘটেনি। তবে রুশ সমাজতন্ত্রের পরিণতি সম্পর্কে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
শেষ কথা
অক্টোবর বিপ্লব ও রুশ সমাজতন্ত্রের মাহাত্ম্য প্রচারে আজও আমাদের আবেগের কমতি নেই। এ কাজে প্রায়শই আমরা ভয়ানক রকমের স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। বলশেভিক ডিক্টেটরশিপ ও রুশ সমাজতন্ত্রের ‘আশ্চর্যজনক’ সফলতা নিয়ে কত কথাই না বলি আমরা। শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে, প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে রাশিয়ার জাদুকরী উল্লম্ফনের কথাও বলি আমরা। পশ্চাৎপদ রাশিয়ার জন্য সেটি জাদুকরী উল্লম্ফনই ছিল বটে (আবার একথাও অনস্বীকার্য যে, সেই জাদুকরী সফলতা অর্জনের মূল নায়ক ছিলেন স্টালিন, যাকে এখন অনেক মার্কসবাদীরাও ফ্যাসিবাদী বলে গালি দেন); কিন্তু পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর তুলনায় তা কতটা পিছিয়ে ছিল তা পরিমাপ করার অবকাশ পাই না আমরা।
রুশ শ্রমিকশ্রেণির জীবনযাপনের মানের অভাবনীয় উন্নতির কথা, রুশ কমিউনিস্ট সংস্কৃতি ও নারীমুক্তির বিপ্লবের কথাও বলি আমরা; কিন্তু সেটি যে কত নাজুক ছিল সেটি বোঝা গেছে কথিত রুশ সমাজতন্ত্রের পতনের পর। বলা হয়ে থাকে, পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো ছিল পুঁজিবাদী দেশ, আর রাশিয়া তো ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশ। তা হলে উৎপাদনে, অর্থনীতিতে, সমৃদ্ধিতে ও সর্বোপরি সংস্কৃতিতে পুঁজিবাদী দেশের নিচে থাকাই কি সমাজতন্ত্রের ভাগ্য? সেই সমাজতন্ত্র তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যাওয়ার দুর্ভাগ্যও কি সমাজতন্ত্রের ভাগ্য? সমাজতন্ত্রের পতনের পর রুশ নারীদের দলে দলে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলোতে গিয়ে দেহ বিক্রি করে জীবনের দায় মেটানোর দুর্গতিও কি সমাজতন্ত্রের ভাগ্য?
রুশ কমিউনিস্ট ডিক্টেটরশিপের মাহাত্ম্যের কথা এখানে আরও একটুখানি বলি। সত্য কথা বটে, বলশেভিকরা বিন্দুমাত্র দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না ভুগে এবং কালক্ষেপণ না করে ‘সঠিক’ সময়ে ডিক্টেটরশিপ প্রয়োগ করে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাশিয়ায় ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বুর্জোয়া শ্রেণিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন। হায়, রুশ সমাজতন্ত্র চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে বুর্জোয়াদের হাতে নয়, রুশ কমিউনিস্ট পার্টি ও রুশ সমাজতন্ত্রের হাতেই!
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের তিনটি দেশ এবং এশিয়া-আফ্রিকার পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে রাষ্ট্রই সব এবং সর্বেসর্বা, জনগণ এখনো অনেকটাই ‘আদিম’ পর্যায়ে, (গ্রামসির ভাষায় তারা রাষ্ট্রের তৈরি ভেড়ার পাল)। তাই এসব দেশে সমাজতন্ত্র তো বহু বহু দূরের কথা, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাও যেন অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো। সেই প্রেক্ষাপটে এখানে ভিন্ন রকমের একটি প্রবচন দিয়ে আলোচনা শেষ করতে চাই।
হাল আমলে অনেকের মুখেই একটি মুখরোচক মন্তব্য শোনা যায় সেটি হলো- ‘চীনের সৌভাগ্য যে, মাও জে দং চীনে অক্টোবর বিপ্লব করেননি। তা করলে মাওয়ের নয়াচীন আজকের দেং শিয়াও পিং-এর চীন হতে পারতো না।’ এখন বড় প্রশ্ন জাগ্রত হয়, তাহলে মার্কসের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী (যে প্রক্রিয়াতেই হোক) ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্র কি প্রথমে উন্নত পুঁজির দেশগুলোতেই আসবে? কিন্তু তা কীভাবে?
লেখক ও গবেষক