Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু

Icon

ইকবাল খন্দকার

প্রকাশ: ০১ মে ২০২৩, ০৯:১৫

গৃহপালিত চতুষ্পদ জন্তু

গল্প। প্রতীক ছবি

‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,

আমি তোমাদেরই লোক।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাগুলোতে হঠাৎ করেই যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসলেন আমাদের তুঘলক ভাই। মানুষটার নাম অবশ্য আলী ইদ্রিস। সেই হিসেবে তাকে আমাদের ডাকার কথা ‘আলী ভাই’ বা ‘ইদ্রিস ভাই’ বলে। তাহলে ‘তুঘলক ভাই’ কেন ডাকছি? কারণ একটাই। তিনি তুঘলকি কাণ্ড ঘটানোর ব্যাপারে সাংঘাতিক সিদ্ধহস্ত। এবার আপনারাই বলেন, যে লোক তুঘলকি কাণ্ড ঘটানোর ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত, তাকে ‘তুঘলক ভাই’ বলে ডাকব না তো ‘সহমত ভাই’ বলে ডাকব? 

এখন প্রশ্ন হলো-তুঘলক ভাই রবীন্দ্রনাথ ভাইয়ের কথায়, সরি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় যে যুগান্তকারী পরিবর্তটা আনলেন, সেটা কী? উত্তর হলো-তিনি আবৃত্তির ঢঙে বলে বেড়াচ্ছিলেন ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি বিরাট বড়লোক।’ তার কথা শুনে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল, ঘটনা ঘটে গেছে। মানে তার উপর বড়লোকির ভূত আছর করেছে। হয়তো তলে তলে বড়লোক হয়েও গেছেন। কিন্তু কীভাবে? নায়ক জসিমের মতো লটারি জিতলেন? নাকি অমিতাভ বচ্চনের ‘কৌন বনে গা ক্রোড়পতি’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কোটি টাকা পেয়ে গেলেন?

এসব প্রশ্নের জবাবে তুঘলক ভাই কোনো কথাই বললেন না। শুধু রহস্যময় একটা হাসি দিলেন। যে হাসিকে মোনালিসার হাসির সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এরপর তিনি কয়েক সেকেন্ড নীরবতা পালন করে হাসিমুখ বাসি বানিয়ে মোটিভেশনাল স্পিকারদের ভঙ্গিতে বললেন-বড়লোক হতে হলে সবার আগে যেটা দরকার সেটা হচ্ছে, বড়লোকদের লাইফ-স্টাইল ফলো করা। মানে তারা কী খায়, কী পরে, কী চড়ে, সেদিকে নজর রাখা। আমি কিন্তু অনেক দিন ধরেই নজর রাখছি এবং সেই অনুযায়ী চলছি। এই জন্য নিজেকে ‘বড়লোক’ বলছি।

তুঘলক ভাইয়ের কথা শুনে আমি হাসলাম। না, আমার হাসিটা মোনালিসার হাসির মতো ছিল না। ছিল যাত্রাপালার রাজাদের মতো। মানে অট্টহাসি। তুঘলক ভাই আমার হাসির নিগূঢ় অর্থ অনুধাবন করতে পেরে বললেন-তুই হয়তো ভাবছিস, আমি তো গাড়ির মালিক না। তাহলে বড়লোকরা কী চড়ে, সেদিকে নজর রেখে লাভ কী? শোন, আর আমার কিন্তু নিজস্ব একটা রিকশা আছে। যাকে বলে প্রাইভেট রিকশা। তার মানে হচ্ছে আমি একটা গাড়ির মালিক। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এমনকি তুই নিজেও জেনে থাকবি, রিকশাওয়ালারা রিকশাকেই ‘গাড়ি’ বলে ডাকে। 

: আপনি কিন্তু ভাই গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করছেন। 

আমি কথাটা বলতেই তুঘলক ভাই যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। তারপর মৃদু তোতলাতে তোতলাতে বললেন-এক কাজ করি। নিজস্ব গাড়ি, দামি পোশাক-আশাক, ভালো খানাপিনা; এই বিষয়গুলো বাদ দিই। কারণ এইসব আলামতের বাইরেও বড়লোকির আরও কিছু আলামত আছে। আমরা বরং সেইসব আলামত নিয়ে কথা বলি। যেমন একটা আলামত হচ্ছে, প্রাণী পোষা। খেয়াল করবি, বড়লোকরা নানারকম প্রাণী পোষে। আর এসব প্রাণীর মধ্যে কমন প্রাণী হচ্ছে কুকুর। আমি যে বড়লোক, এর গুরুত্বপূর্ণ একটা আলামত হচ্ছে, আমার কুকুর আছে।

একটু আগে তুঘলক ভাই যেভাবে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছিলেন, আমিও ঠিক সেভাবেই একটা বস্তু খেলাম। অদৃশ্য বস্তু। যে বস্তুর নাম ‘টাশকি’। বস্তুটা আমি কেন খাব না বলেন? একটা মানুষ কেবল কুকুর পোষার কারণে নিজেকে বড়লোক দাবি করছে; ভাবা যায়? তো আমি টাশকি খেয়ে হজম করার পর বললাম-মানলাম কুকুর পোষা বড়লোকির লক্ষণ। কিন্তু আপনাকেও একটা বিষয় মানতে হবে। সেটা হচ্ছে, বড়লোকরা যেনতেন কুকুর পোষে না। তারা বাইরের কুকুর পোষে। তা আপনারটা কোথাকার কুকুর শুনি?

: আমারটাও বাইরের। মানে রাস্তা-ঘাটে শুয়ে থাকত। হাড্ডি-টাড্ডি খেতো।

তুঘলক ভাইয়ের কথা শুনে আমি এক কিস্তি হেসে নিয়ে জানালাম ‘বাইরের কুকুর’ বলতে কবি এখানে ঘরের বাইরের কুকুরের কথা বোঝাননি। বরং দেশের বাইরের কুকুরের কথা বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ বিদেশি কুকুর। যেসব কুকুরের চুল লম্বা লম্বা। অবশ্যই ধবধবে সাদা। তুঘলক ভাই বললেন-আমার কুকুরের চুলও লম্বা লম্বা। ধবধবে সাদা। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে একবার আমার বাসায় আয়। নিজ চোখে দেখে যা। আসলে তোদের এত অবিশ্বাস! কী আর বলব!

আমি তুঘলক ভাইয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ফেললাম। অনেকটা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকসেপ্ট করে ফেলার মতো ব্যাপার আরকি। পরদিন সব কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে চলে গেলাম আমন্ত্রণ রক্ষার জন্য। গিয়েই যখন বললাম, ‘ডিওজি সাহেবকে দেখতে এসেছি’, তুঘলক ভাই তো তাজ্জব। ডিওজি সাহেব মানে! আমি বললাম-আপনি জ্ঞানী মানুষ। বড়লোক তো বটেই। আপনি যদি এই সামান্য ব্যাপার না বোঝেন, তাহলে দেশ কীভাবে চলবে আর বিশ্ব কীভাবে চলবে? সবকিছু একেবারে অচল হয়ে যাবে না? আরে ডিওজি মানে হচ্ছে ডগ। মানে কুকুর। মানে কুত্তা।

তুঘলক ভাই এবার এমন একটা ভাব করলেন, যেন তিনি প্রথমেই বুঝে ফেলেছিলেন ডিওজি মানে কী। কেবল না বোঝার ভান করেছিলেন। আমি ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। উচ্চ বংশীয় ভদ্রলোকের মতো চুপচাপ বসে পড়লাম আমার জন্য বরাদ্দকৃত আসনে। এরপর জিজ্ঞেস করলাম কুকুরটা কোথায় আছে। সেই সঙ্গে গৃহপালিত চতুষ্পদ এই জন্তুটাকে দেখার ব্যাপারে প্রগাঢ় আকাক্সক্ষাও প্রকাশ করলাম। তুঘলক ভাই আমার সামনে থেকে সরে গেলেন। আর খানিক বাদে হাজির হলেন কুকুর সমেত। মুহূর্তেই ঘর ভরে গেল ঘেউঘেউ শব্দে। 

আমি কিছু মনে করলাম না। ডিওজি মশাই আমাকে চিনতে পারছেন না, অতএব ঘেউঘেউ করে নাম-পরিচয় তো শুধাতে পারেনই। এটা তার অধিকার। দায়িত্বও বটে। সুতরাং এখানে মনে করার কিছু নেই। তবে মশাইয়ের গলার স্বরটা আমাকে ধাঁধায় ফেলে দিল। আমি তাই তুঘলক ভাইকে পাশে বসিয়ে মোলায়েম গলায় বললাম-গায়ের সাদা রং আর লম্বা লম্বা চুল দেখে মনে হচ্ছে অবশ্যই কুকুরটা বিদেশি। কিন্তু গলার স্বর এমন কেন? বিদেশি কুকুরের গলা তো এমন হয় না! কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনার কুকুরটার গলা শুনে মনে হচ্ছে নেড়ি কুত্তার আত্মীয়টাত্মীয় হবে।

আমার কথা শুনে তুঘলক ভাই কষ্ট পেলেন। তিনি গলার স্বরে পর্যাপ্ত পরিমাণে অভিমান এবং বেদনা মাখিয়ে বললেন, তার প্রিয় পোষা প্রাণীকে ‘নেড়িকুত্তার আত্মীয়’ বলা আমার একদম উচিত হয়নি। আমিও চিন্তা করে দেখলাম কাজটা অনুচিতই হয়েছে। তাই ভাবলাম কুকুরটাকে একটু আদর করে দিই। কিন্তু আদর করার উদ্দেশ্যে যেই তার লোমশ শরীরে হাত বুলানো শুরু করলাম, ঘটে গেল এক মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা প্রমাণ করে দিল, কুকুরটা নেড়িকুত্তার আত্মীয় না, বরং সে নিজেই একটা নেড়িকুত্তা। তো ঘটনাটা হলো, তুঘলক ভাই তাকে বিদেশি সাজানোর চেষ্টা করেছেন আলগা চুল লাগিয়ে। 

কুকুরের গা থেকে খুলে আসা পরচুলাটা তখনো আমার হাতে। আমি তুঘলক ভাইয়ের দিকে গোস্যার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, কাজটা তিনি ঠিক করেননি। নেড়ি কুত্তার গায়ে আলগা চুল লাগিয়ে বিদেশি কুকুর সাজানো যে এক ধরনের প্রতারণা, তাও তাকে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু তিনি বুঝলে তো! তার মধ্যে না দেখা গেল কোনো অনুশোচনা, না দেখা গেল লজ্জা-শরম। তিনি কুকুরটাকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গ সামনে এনে গালগল্প জুড়ে দিতে চাইলেন। আমি বললাম- যেহেতু আমার আসার উদ্দেশ্য কুকুর দেখা, অতএব কথা বললে কুকুর নিয়েই বলতে হবে। অন্য কোনো সাবজেক্ট নিয়ে না।

অবস্থা বেগতিক দেখে তুঘলক ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর কী ভেবে যেন মুখে হাসি ফোটালেন। আর বলা শুরু করলেন- শোন, মানুষ যে শুধু বড়লোকি প্রমাণের জন্য কুকুর পোষে, তা কিন্তু না। এই প্রাণীটা পুষলে আরও নানারকম উপকার পাওয়া যায়। যেমন পাচ্ছি আমি। তুই হয়তো প্রশ্ন করবি, কী কী উপকার পাচ্ছি। তোর প্রশ্নের জবাবস্বরূপ আমি নিকট-অতীতের একটা ঘটনা বলতে চাই। ঘটনাটা একটু পার্সোনাল। তবু তুই যেহেতু আমার ভাই, অতএব বলা যেতেই পারে।

তুঘলক ভাই চারপাশে তাকালেন। এই তাকানোর অর্থ, ধারে-কাছে কেউ আছে কিনা দেখে নেওয়া। যখন নিশ্চিন্ত হলেন কেউ নেই, তখন বললেন- তোর ভাবির মা অর্থাৎ আমার শাশুড়ির একটা বদভ্যাস আছে। দুই দিন পরপর বেড়াতে আসবে তো আসবে, সঙ্গে করে বিড়াল নিয়ে আসবে। উনার প্রিয় প্রাণী। আমার যেমন কুকুর প্রিয়, এই ভদ্রমহিলার প্রিয় বিড়াল। তবে একটা বিষয় মানতেই হবে, কুকুর বড়লোকির প্রতীক হলেও বিড়াল কিন্তু সে ধরনের কিছু না। বিড়ালকে বড়জোর ‘ইন্দুর মারার কল’ বলা যেতে পারে। 

: আপনি লাইন ছেড়ে বেলাইনে চলে যাচ্ছেন। লাইনে আসুন। মানে আপনার শাশুড়ির প্রসঙ্গে।

তুঘলক ভাই বললেন-ভদ্রমহিলাকে আমি নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কারও বাসায় বিড়াল নিয়ে আসা ঠিক না। কিন্তু উনি বুঝলেন না। বিড়াল নিয়ে আসতেই লাগলেন আর বজ্জাতের হাড্ডি বিড়ালটা ঘরের নানা প্রান্তে বসে আরাম করে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে লাগল। এখানেই কিন্তু ট্র্যাজেডির শেষ না। আরও আছে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বিড়ালটা যে ইয়ে করত, সেগুলো কাজের মেয়েটা পরিষ্কার করতে চাইত না। করলেও মোটা অঙ্কের বকশিশ দাবি করত। যা দিতে হতো আমাকেই। অবশেষে বিড়ালের ইয়ে পরিষ্কার-সংক্রান্ত দায়িত্বটা আমাকেই কাঁধে নিতে হলো। একজন পুরুষের জীবনে এর চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি আর কী হতে পারে?

প্রশ্নটা উত্থাপন করে তুঘলক ভাই চোখে-মুখে এমন ‘ইমোশন’ ঢেলে দিলেন, যেন গ্লিসারিন ছাড়াই কেঁদে ফেলবেন। আমি পাত্তা দিলাম না। বলে দিলাম তিনি যেন বিড়ালের প্রসঙ্গ থেকে কুকুরের প্রসঙ্গে চলে আসেন। তুঘলক ভাই বললেন- বিড়ালের প্রসঙ্গ আরও আগেই শেষ। মানে যেদিন থেকে আমি কুকুর পোষা শুরু করলাম, সেদিন থেকে আমার শাশুড়ি বিড়াল নিয়ে আসার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে ফেলেছে। কারণ কে নাকি উনাকে একটা গায়েবি তথ্য দিয়েছে। তথ্যটা এমন- কুকুররা বিড়াল খেয়ে ফেলে। আমি তাকে বোঝাতে চাইনি যে, তথ্যটা মিথ্যা। কেন বোঝাতে যাব? মিথ্যা তথ্যের বদৌলতে যদি আমি বিড়ালের ইয়ে পরিষ্কারের যন্ত্রণা থেকে বাঁচি, ভালো না? ভালো তো।

আমি জানতে চাইলাম কুকুর পোষার কারণে তুঘলক ভাই আর কী কী উপকার পাচ্ছেন। তিনি পা দোলাতে দোলাতে বললেন- উপকারের কিন্তু শেষ নেই। কোনটা রেখে কোনটা বলব! তুই তো জানিস, তোর ভাবি একটু বেশিই সুন্দরী। আর এদিকে আমার বাড়িওয়ালা আস্ত একটা ছ্যাবলা। ভাড়ার নেওয়ার নাম করে এসে সে বসে থাকত। আমার বউয়ের হাতের চা না খেয়ে যেতই না। কিন্তু কদিন আগে কুকুরটা তাকে দেখে ঘেউ করে উঠল। সে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল কামড় দেয় কিনা। আমি বললাম, কামড় দিলেও উপরে দেয় না। হাঁটুর নিচেই দেয়। এরপর থেকে সে আর ভাড়া নিতে আসে না। তার বউকে পাঠায়। বউ কিন্তু দেখতে খারাপ না। 

বলেই তুঘলক ভাই একটা রোমান্টিক হাসি দিলেন। যে হাসিতে হালকা পরকীয়ার আভাস পাওয়া গেল। কিন্তু আমি তাকে এই প্রসঙ্গে প্রশ্ন করার আগেই তিনি বলতে লাগলেন- তোর ভাবি সুন্দরী হলে কী হবে, হাতের রান্না জঘন্য। তবে সেটা তার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। বরং যা রেঁধেছে, মজা করে খেতে হবে। ‘মজা হয়নি’ এটা বললে তো বিপদ আছেই, না খেলেও বিপদ আছে। তবে আমি এখন সেই বিপদ থেকে মুক্ত। যা-ই রান্না করুক, আর যত বে-মজাই হোক, প্লেট ভরে নিই। তারপর পায়ের কাছে বসে থাকা কুকুরটার সামনে এক-দুই নলা করে পেশ করি। তোর ভাবি ধরে নেয় আমি নিজে খেয়েই বুঝি ভরা প্লেট খালি করে ফেলেছি। কী যে খুশি হয় সে! তুই-ই বল, কুকুরটা না থাকলে কি তাকে এত খুশি করা যেত?

আমি কিছু বললাম না। তাই তুঘলক ভাই তার কথা অব্যাহত রাখার সুযোগ পেলেন---- কুকুরটা যখন থেকে পুষতে শুরু করলাম, আমার কাজ অনেক কমে গেছে। বিশ্বাস কর, অনেক কাজ এখন আমাকে না করলেও চলে। তুই হয়তো আমাকে খোঁচা মারার জন্য বলবি, আপনার কুকুর কি আপনার জামা-কাপড় ধুয়ে দেয়? আরে বাপুরে, জামা-কাপড় ধোয়া ছাড়া কি জগৎ-সংসারে আর কোনো কাজ নেই? কত কাজ আছে! আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, ওইসব কাজের অধিকাংশই এখন আমাকে করা লাগছে না।

: বুঝতে পেরেছি, এখন আপনাকে অফিসে যেতে হচ্ছে না। আপনার পরিবর্তে কুকুরটাই অফিসটফিস করছে। তা কুকুরটা কি জামা-কাপড় ছাড়াই অফিস করছে? নাকি কোট-টাই পরছে?

আমার খোঁচায় ভালোই ক্ষেপে গেলেন তুঘলক ভাই। কিছুক্ষণ বেশ হম্বিতম্বি করলেন। তবে আমি চুপ থাকায় তিনি আগের অবস্থায় ফিরে আসতেও বেশি সময় নিলেন না। বললেন-আমার বাসার সামনে মানে দরজার পাশে জুতার বাক্সটা দেখেছিস না? আগে এই বাক্সে তালা দিয়ে রাখলেও জুতা চুরি হয়ে যেত। আর এখন আমার কাজ কমে গেছে। কষ্ট করে তালা দিতে হয় না। বাক্সটার সামনে শুধু একটা চট বিছিয়ে রাখি। সেখানে কুকুরটা শুয়ে থাকে। কোনো বেটার সাহস হয় না বাক্সে হাত দেওয়ার। 

: আপনি তো অতিচালাকি করতে গিয়ে দেশি কুকুরকে বিদেশি বানানোর চেষ্টা করলেন। যদি এই অপকর্মটা না করে সত্যি সত্যি বিদেশি কুকুর পুষতেন, তাহলে জুতা-ইস্যুতে আরও উপকার পেতেন।

: কী ধরনের উপকার? বিস্তর আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন তুঘলক ভাই।

: বিদেশি কুকুরকে যা শিখিয়ে দেওয়া হয়, তারা তা-ই করতে পারে। যা দেশি কুকুরের পক্ষে সেভাবে করা সম্ভব হয় না। তা আপনি যতই আলগা চুল আর আলগা রং লাগান না কেন।

: আরে বুঝলাম তোর কথা। এখন বল বিদেশি কুকুর পুষলে জুতা-ইস্যুতে কী উপকার পেতাম, কীভাবে উপকার পেতাম। 

: মনে করেন এই বিল্ডিংয়ের অন্যান্য ফ্ল্যাটের কারও না কারও জুতা আপনার পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু নিজে যে গিয়ে নিয়ে আসবেন, সেই সাহস পাচ্ছেন না। বিদেশি কুকুররা খুব শিকারি হয় তো! আপনি হালকা ট্রেনিং দিয়ে দিলে যে কারও জুতা এনে হাজির করত আপনার সমীপে।

এবার তুঘলক ভাইয়ের রাগ দেখে কে! তিনি এত জোরে চিল্লাতে লাগলেন, যেন গলার রগ ছিঁড়ে তবেই ক্ষান্ত হবেন। তারপর শুরু করলেন কৈফিয়ত চাওয়া। তাকে জুতা চুরির মতো নিকৃষ্ট কাজের কথা বলার সাহস আমার হলো কী করে! আমি মিনমিনে গলায় বললাম---- আসলে হয়েছে কী ভাই, আপনি যেহেতু নিজেকে বড়লোক দাবি করছেন, ভবিষ্যতেও করবেন, অতএব চুরিবিদ্যাটা আয়ত্তে থাকলে মন্দ হয় না। অধিকাংশ বড়লোকই চুরির সঙ্গে জড়িত কি না! না না, আজীবনই জুতা চুরি করতে হবে, এমন বাধ্যবাধকতা নেই। আজ জুতা চুরি করলেন, ভবিষ্যতে করলেন পুকুরচুরি। না মানে চুরিতে প্রমোশন আরকি।

এই পর্যন্ত বলে আমি একটা তেলতেলে হাসি দিলাম। আর কেন যেন তুঘলক ভাইয়ের চিল্লাপাল্লা বন্ধ হয়ে গেল। হতে পারে বড়লোক হওয়ার ব্যাপারে যে সুবুদ্ধি মতান্তরে কুবুদ্ধিটা আমি দিলাম, সেটা তার পছন্দ হয়েছে। এরপর আচমকা হাসতে শুরু করলেন তুঘলক ভাই। আমি এই হাসির হেতু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি বলতে লাগলেন-বিষয়টা কীভাবে বলি! একটু নোংরা ধরনের ব্যাপার। এই জন্য বলতে সংকোচ লাগছে। কিন্তু যেহেতু কুকুর-সংক্রান্ত, তাও কুকুরের উপকার সংক্রান্ত, অতএব না বললে চলছে না।

আমি ‘এনওসি’ দিয়ে দিলাম। মানে নিঃসংকোচে বলার ব্যাপারে ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’। তুঘলক ভাই আরও কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে বললেন-আগে আমার বারান্দার নিচে পাড়ার বখাটে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আড্ডা দিত। ঘরে সুন্দরী বউ থাকলে যা হয়। তার আগে একটু বলে নিই। আমি কিন্তু আমার কুকুরটাকে নির্দিষ্ট সময়ে বাইরে নিয়ে যাই টয়লেট সারানোর জন্য। তো একদিন কী কাজে যেন ব্যস্ত ছিলাম। সময়মতো নিয়ে যেতে পারিনি। কুকুরটা করল কী, বারান্দায় গিয়ে গ্রিলে পা উঠিয়ে দিয়ে কাজ সেরে ফেলল। এদিকে আমার সুন্দরী বউকে ডিস্টার্ব করার আশায় নিচে তখন দাঁড়িয়ে ছিল বখাটেরা।

তুঘলক ভাই আবার হাসা শুরু করলেন। তারপর হাসি আর কথা চালালেন একসঙ্গে-ওই দিনের পর থেকে বখাটেদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তারা ভুলেও আমার বারান্দার নিচে দাঁড়ায় না। তবে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যদি কুকুরটা তাদের চোখে পড়ে যায়, সেরেছে। তারা এমনভাবে দিগ্বিদিক দৌড়াতে থাকে, যেন সামনেই ম্যারাথন প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করতে না পারলে মান-ইজ্জত থাকবে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫