
প্রতীকী ছবি
জীবনের চালচুলো নেই, পড়াশোনা কবে শেষ হবে ঠিক নেই, ঠিক নেই কিভাবে চাকরি জোগাড় হবে অথবা বেঁচে থাকার অন্য ধান্দা, যদিবা কিছু হলো তাতে কোনোমতে দিন চলে, বছর গেলে দুটো টাকা বাড়ে, লসের ব্যবসায় কেবলই আশা, কেবলই অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপে কাটানো দিন। এই দিন কি কোনোকালে শেষ হবে? ভবিষ্যৎ নাগালহীন দূরে গাঢ়তম অন্ধকারে দোল খায়।
হাসিমুখের অন্তরালে দুশ্চিন্তার অবিরাম ঢেউ আছড়াতে থাকে, দীর্ঘশ্বাসের পেন্ডুলামে হার্টে চাপ বাড়ে। স্ট্রেসড, অ্যাংজাইটি, দুঃস্বপ্ন, মাঝরাতে ভাঙা ঘুম, সব চলে, সব চলে নিজের মধ্যে কেবল। আর কত? ভবিষ্যৎটা নিশ্চিত করতে পারার পরেই বুঝি শান্তি!
একটা সময় আসে যখন ভবিষ্যৎটা ফিক্সড হয়ে যায়। একটা নির্দিষ্ট রাস্তা শুধু সেই রাস্তা দিয়েই তোমাকে যেতে হবে, কিছু নির্দিষ্ট মানুষ তোমাকে তাদের মধ্যেই চলতে হবে, লটারির আর কোনো টিকিট নেই, তুমি বহুকিছু পাল্টাতে পারো না, বলতে গেলে কিছুই পাল্টাতে পারো না, শুধু নির্দিষ্ট ছকে পারফর্ম করে যাও। কে তোমাকে কেমনভাবে দেখতে চায় তাতে তুমি নিশ্চিত, তুমি কতটুকু সামনে আগাতে পারবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত। কে তোমাকে কতটুকু অনুভব করছে, তাও নিশ্চিত জানো। নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম, তাই বলে কি এই নিশ্চিত জানাটা চেয়েছিলাম?
বাবা ইঞ্জিনিয়ার, মা ব্যাংকার। আট মাসের প্রেগনেন্সিতে জটিলতা বেধে শেষমেশ বাচ্চা নিউনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ারে। আটত্রিশ দিন দুশ্চিন্তাময় দিন কাটানোর পর মা-বাবার মুখে হাসি। সন্তানকে বাড়ি নিয়ে যাবার সময় ডাক্তার বললেন, বাবুর গ্রোথ ডিলে হতে পারে। আগামী পনেরো থেকে আটাশ দিনের মধ্যে যেন অবশ্যই শিশু ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে একবার দেখিয়ে নিয়ে যান। বাচ্চা আস্তে আস্তে বড় হবে, সে আর এমন কী, হয়তো একটু দেরি করে বসবে, দেরি করে হাঁটবে।
ওরা আসেনি।
বাবুর বয়স আট মাস কিন্তু এখনো বসতে পারে না। চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে যখন তারা নিয়ে এলেন, থেরাপিস্ট এক নজরে বুঝে ফেললেন যে ওর ডাউন সিনড্রোম যা কখনো সারে না। বাচ্চাটার শারীরিক গঠন, মানসিক গঠন কোনোদিনও স্বাভাবিক হবে না। খিলখিল করে হাসতে থাকা বাচ্চাটাকে দেখে আমার খুব কষ্ট লাগল। সাথে সাথেই মনে হলো, থেরাপিস্ট বা ডাক্তার যখন মা-বাবাকে সন্তানের এই সমস্যার কথা জানাবে, তখন তারা সেটা কিভাবে গ্রহণ করবে! আমি থেরাপিস্টের রুমে হাত পা শক্ত করে বসলাম, গলার কাছে কিছু একটা বিঁধে আছে, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
আরিয়ানা খুবই তুলতুলে। স্বাভাবিক শিশুদের চেয়ে বেশি। ওর শরীরে যা দেখে মাংসপেশি মনে হচ্ছে তা পেশি নয়, ভেতরে অনেক পানি। থেরাপিস্ট শিশুটির কানে ঝুনঝুনি দিয়ে শব্দ করতে থাকে কিন্তু বাচ্চাটি সেদিকে ঘাড় ফেরায় না, চোখে বা চেহারায় কোনো পরিবর্তন আনে না। এবার অন্য কানে। জোরে বাজানোর পরও কোনো রেসপন্স না পাওয়ায় থেরাপিস্ট যখন ক্রস মার্ক দিতে যাচ্ছে তখনই মা তড়িঘড়ি করে বলতে লাগল, ‘ডাক দিলে ও খেয়াল করে, ও শুনতে পায়, আপনারা নতুন বলে অমন করছে।’ এরপর বাচ্চার বাবাকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হলো যেন পরিচিত জনের কণ্ঠ শুনে অন্তত কোনো সংকেত দেয়। একই ফলাফল। উজ্জ্বল একটা খেলনা ডানে বাঁয়ে ঘোরানো হলো, মণি একই দিকে স্থির হয়ে রইল।
ফলাফল যত নেগেটিভের দিকে যাচ্ছে, মায়ের কথা আর থামে না। কেয়ার গিভার বলছিল, ওকে এইভাবে মেরুদণ্ডটাকে সোজা করে ধরিয়ে বসাবেন, এইভাবে হাতে পায়ে স্ট্রেচিং করাবেন, পেশি শক্ত করার জন্য দিনে অন্তত পনেরো বার এইসব এক্সারসাইজ করাবেন। আমি দেখছি, মায়ের কোনোদিকে খেয়াল নেই। তার মেয়ে ঠিক আছে, তার মেয়ে বাসায় সবকিছু ঠিকঠাক করে, দাদুর সাথে এটা করে, নানুর সাথে ওটা করে, এমনিতে বসতে পারে না কিন্তু চারদিক দিয়ে বালিশ চেপে দিলে দিব্যি বসে। তার মেয়ে সুস্থ, তার মেয়ে স্বাভাবিক, মা মরিয়া হয়ে আমাদের সামনে প্রমাণ করতে চাইছে।
বেরোনোর সময় সম্পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলছিল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই তো?’ এতটা নিশ্চিত এই ভবিষ্যৎ, আমি বরফের মতো জমে গিয়েছিলাম।
১৭ নভেম্বর, ২০২২