Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

মানুষের বাড়ি

Icon

দীপক পিললাই

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২০, ০৯:৪১

মানুষের বাড়ি

লুকিয়ে থাকা ঘরবাড়ি

১৯৬৫ সালের কথা। ফ্রান্স দেশের নিস শহর। বন্দরের পাশেই একটা পাঁচতলা আধুনিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির জন্য কিছুদিন হলো কাজ শুরু হয়েছে সেখানে। একটা বুলডোজার মাটি সরানোর কাজ করে চলেছে। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বুলডোজারের মাটি খোঁড়া দেখছিলেন প্রাক-ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হেনরি ডি লুমলে। বৈজ্ঞানিকের গভীর দৃষ্টি নিয়ে কিসের আশায় যেন তিনি চেয়ে আছেন মাটির দিকে। বুলডোজারটা যখন ফুট তিনেকের মতো মাটি সরিয়ে ফেলেছে, তখন লুমলে কি একটা দেখতে পেয়ে হঠাৎ ‘থামো, থামো’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। ব্যস, মাটি খোঁড়াও গেল বন্ধ হয়ে।

কী উদ্দেশ্যে লুমলে চিৎকার করে উঠেছিলেন তা জানতেই অবাক হতে হয়। একটা পাথরের হাতিয়ার, যা লাখ লাথ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষরা তৈরি করত। তবে ফ্রান্সে পাথরের হাতিয়ার যে এই প্রথম পাওয়া গেল, তা কিন্তু নয়। আগেও অনেক পাওয়া গেছে। আসলে আট বছর আগে যখন এখানে বাড়ি তৈরির কাজ প্রথম শুরু হয়েছিল, তখনই লুমলে এখানে একটা পাথরের হাতিয়ার দেখতে পেয়েছিলেন। তখন থেকেই এই জায়গার ওপর তার নজর। এবারে আবার হাতিয়ার পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি উঠে পড়ে লাগলেন।

কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হলো এক এলাহী ব্যাপার! তিনশ’ জনেরও বেশি গবেষকের এক বিরাট দল সেখানে গবেষণার কাজ শুরু করলেন। মাটির প্রতিটি স্তর খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে করতে, মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে তারা নিচের দিকে নামতে থাকলেন।

১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে এসে, প্রায় সত্তর ফুট নিচে গিয়ে তাঁরা যা দেখতে পেলেন তাতে তো স্বয়ং লুমলেরও চোখ ছানাবড়া! তাঁরা এসে হাজির হয়েছেন একদল মানুষের বাসস্থানে! এইসব মানুষ কী খেত, কোথায় ‘রান্না’ করত, কি করে তারা তাদের হাতিয়ার বানাতো, কোথায় তারা শুয়ে থাকত, কিসের ওপর শুতো- সবই বৈজ্ঞানিকরা গবেষণা করে বের করেছেন। এই সব কিছুরই প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া গেল এখানে। পাওয়া গেল ‘উনুন’; তার একদিকে আবার হাওয়া ঠেকানোর জন্য পাথর বসানো। এমনকি, তখনকার মানুষের পায়ের ছাপ পর্যন্তও পাওয়া গেছে!

আরও জানা গেল- আমাদের পূর্ব-পুরুষরা এখানে বাড়ি তৈরি করে থাকত। দু’দশটা নয়, একুশটা এরকম তৈরি করা বাড়ির নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছেন বৈজ্ঞানিকরা।

এইভাবেই, মানুষের নিজের হাতে তৈরি প্রাচীনতম বাড়ির হদিস পাওয়া গেল সেদিনের সেই ঘটনার পর। মাটির যে-স্তরে এই বাড়ির প্রমাণ পাওয়া গেছে তা থেকে জানা যায়- এই বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল মাত্র চার লাখ বছর আগে! বৈজ্ঞানিকরা বাড়ির হদিস পেয়েছেন, অকাট্য প্রমাণ পেয়েছেন ঠিকই। তবে বাড়িগুলো কিন্তু পাননি। প্রায় চার লাখ বছর আগেকার বাড়ি এখনো আস্ত থাকবে কি করে?

তবে কি এমন প্রমাণ পেলেন বিজ্ঞানীরা, যা থেকে তাঁরা বাড়ির চেহারা পর্যন্ত এঁকে ফেললেন? 

হ্যাঁ, সন্দেহাতীত প্রমাণই তাঁরা পেয়েছেন এখানে। পেয়েছেন খুঁটি পোতার গর্ত। খুঁটিগুলোকে যেসব পাথরের চাঁই দিয়ে ঠ্যাকনা দিয়ে রাখা হতো, সেইসব পাথরগুলোকেও পাওয়া গেল গর্তের পাশে-পাশেই ঠিক যেমনটি ছিল চার লাখ বছর আগে। গর্তগুলো পরপর যেভাবে মালার মতো করে সাজানো, তা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল- প্রত্যেকটা বাড়িই ছিল ডিম্বাকৃতির; বেশ একটু লম্বা ধরনের। মাপ নিয়ে দেখা গেল, বাড়িগুলো লম্বায় ছিল ছাব্বিশ ফুট থেকে ঊনপঞ্চাশ ফুটের মধ্যে, চওড়ায় তেরো ফুট থেকে প্রায় কুড়ি ফুট অবধি। এইসব বাড়ির মাঝখানেও পাওয়া গেছে খুঁটি পোঁতার গর্ত। গর্তগুলোর ধরন খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানিরা বললেন- খুব সম্ভবত মরা গাছের মোটা মোটা গুঁড়ি ব্যবহার করা হতো মধ্যেখানের খুঁটি হিসাবে। ডালপালা দিয়ে তৈরি দু’দিকের হেলানো দেওয়াল মাঝখানে এসে এই খুঁটিগুলোর ওপর যেই মিলতো, অমনি তৈরি হয়ে যেত বাড়ির ছাদ।

গুহা-বাড়ির খবর

এত গেল তৈরি করা বাড়ির কথা। কিন্তু তিন-চার লাখ বছর আগে মানুষ কি থাকার জন্য সব সময়েই নিজের হাতে বাড়ি তৈরি করত? না, তা কিন্তু নয়। যেখানে আগে থেকেই প্রাকৃতিক বাড়ি তৈরি হয়ে আছে, সেখানে মানুষ আর বাড়ি তৈরির ঝামেলায় না-গিয়ে একেবারে তৈরি-বাড়িতেই বাস করতো। কিন্তু এইসব তৈরি-বাড়িগুলোর নির্মাণ হতো কি করে? আসলে, এইসব তৈরি-বাড়িগুলো হলো বিভিন্ন পাহাড়-পর্বতের গুহা। গুহাই ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের পাকা বাড়ি। বৈজ্ঞানিকেরা আদিম মানুষের এইরকম প্রাচীনতম যে গুহা-বাড়ি আবিষ্কার করেছেন, সেটা চীন দেশে। তৈরি করা বাড়ি আবিষ্কারের মতো এই গুহা-বাড়ি আবিষ্কারের ঘটনাও ভারি মজার।

চুন-কারখানার কিছু শ্রমিক চুনা পাথর জোগাড় করতে মাঝেমধ্যেই আশপাশের পাহাড়ে গিয়ে পাথর কাটে। পাথর কাটতে গিয়ে তারা প্রায়ই এক ধরনের জিনিস দেখতে পায়, যাকে তারা বলতো ‘ড্রাগনের হাড়’। আসলে, এই ‘ড্রাগনের হাড়’গুলো হচ্ছে নানা রকমের জীবাশ্ম (বা ‘ফসিল’)। আর কি, বৈজ্ঞানিকদেরও নজর পড়লো এই অঞ্চলের ওপর।

১৯২১ সালে একটা জায়গার অবস্থান এবং ধরনধারণ দেখে তাঁদের সন্দেহ বেশ জোরালো হয়ে ওঠে। শুরু হলো বৈজ্ঞানিক খনন-কাজ। খুঁড়তে খুঁড়তে দেখা গেল- এটা আসলে বিরাট আকারের বহু প্রাচীন একটা গুহা, চাপা পড়ে আছে পাথরে। কিছুদিনের মধ্যেই বোঝা গেল, বৈজ্ঞানিকদের অনুমান মিথ্যা নয়।

১৯২৩ সালে দুইটি এবং ১৯২৭ সালে একটা দাঁত পাওয়া গেল এই গুহা থেকে। বৈজ্ঞানিকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন- এগুলো হলো- বর্তমান মানুষের আদিম পূর্বপুরুষের দাঁত। ১৯২৮-এ আবার পাওয়া গেল দুটি ভাঙা চোয়াল; তার একটাতে আবার তিনটে দাঁতও লেগে আছে। কিন্তু এই ক’টা মাত্র প্রমাণ পেয়ে এগুলো যে প্রকৃতই আমাদের বিশেষ এক-গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষের শরীরের অংশ- সে কথা নিশ্চিতভাবে বৈজ্ঞানিকরা খুব জোর দিয়ে বলতে পারছিলেন না।

অবশেষে, ১৯২৯ সালের ২ ডিসেম্বর বিকাল চারটের পর, প্রায় একশো ফুট নিচ থেকে আবিষ্কার হলো- মানুষের খুলির ওপরের দিকের সুন্দর একটা অংশ। নানা ধরনের গবেষণার পর, এবার আর কোনো সংশয়ই রইল না যে, এগুলো সবই হলো- আদিম মানুষের প্রমাণ।

তারপর বিভিন্ন সময়ে গবেষণার ফলে, এই গুহা থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে নানা রকমের পাথরের অস্ত্র। এমনকি, এই গুহায় যে আমাদের পূর্বপুরুষরা আগুন ব্যবহার করতো, তার প্রমাণও পাওয়া গেল। শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই রইল না যে, এটাই হলো মানুষের প্রাচীনতম গুহা-বাড়ি।

কতদিনের প্রাচীন? বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন: প্রায় পাঁচ লাখ বছর আগেই মানুষ এই গুহায় বাস করেছে। বিজ্ঞানীরা এটাও স্থির করেছেন যে, বিভিন্ন সময়ে মানুষ বিভিন্ন কারণে এই গুহা-বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে; হাজার হাজার বছর পর আবার একদল মানুষ এসে এই ‘বাড়ি’তেই বাস করেছে। এইভাবে, চার-চারবার মানুষ ঘুরে ফিরে এসেছে এই লোভনীয় প্রাচীনতম বাড়িটায় থাকার জন্য। আর, যারা এই বাড়িটার বাসিন্দা ছিল, বিজ্ঞানীরা আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের নাম দিয়েছেন ‘হোমো ইরেকটাস’।

লাখ লাখ বছর আগে মানুষতো আর আজকের মতো বড় বড় সব অট্টালিকা বানাতে শেখেনি; কারিগরি বিষয়ে আজকের তুলনায় সে দিন তাদের কোনো জ্ঞান ছিল না বললেই চলে। তাই, যেখানে গুহা আছে সেখানে সে গুহাতেই থেকেছে; বাড়ি বানানোর ঝামেলায় যায়নি। মানুষের এই গুহা-বাসের অভ্যাস কিন্তু আজও কোনো কোনো মানব- গোষ্ঠীর মধ্যে বজায় আছে। (চলবে)

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫