
পিঙ্ক ফ্লয়েডের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
Music is a higher revelation than all Wisdom and Philosophy.
-Beethoven
অন্ধ এক বাজপাখি পালক ঝাপটাচ্ছে, হেলিকপ্টারের ভোঁ শব্দ, পানি পতনের মৃদু ধ্বনি কিংবা পিঙ্ক ফ্লয়েড। ১৯৬৭; সিগমা-৬ [sigma-6] নামধারী একদল পাগল মেতে উঠেছে সাইকেডেলিয়ায়। এক উন্মাদ লোক এলএসডি খাচ্ছে, সঙ্গে গানের লিরিক এমনভাবে সাজাচ্ছে যেন সেটি ছিল মহাবিশ্বের অজানা অঞ্চলের প্রতিচ্ছবি। সবুজ ঘাসবনে যেন শিশিরের অগ্নিকাণ্ড। সিড ব্যারেট।
ব্যারেটের মুখোমুখি ব্যাসিস্ট রজার ওয়াটারস, ড্রামার নিক ম্যাসন এবং অর্গানিস্ট রিচার্ড রাইটসহ ব্যান্ডটি তাদের আকর্ষণীয় প্রথম একক ‘আর্নল্ড লেইন’ দিয়ে যুক্তরাজ্যের সেরা ২০টি অ্যালবাম কটাক্ষ করে এবং ব্রিটিশ সাইকেডেলিক পপকে তাদের প্রথম দিক থেকে ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’, ‘উইশ ইউ হিয়ার’, এবং ‘দ্য ওয়াল’-এর মতো ধারণাগত মাস্টারপিসের সঙ্গে বিশাল সাফল্যের দিকে ঠেলে দেয়। শুরুতে, তাদের পিঙ্ক ফ্লয়েড হয়ে ওঠা ছিল কিছুটা তৎসম শব্দের বাংলা রূপান্তরের মতো আরকি। ‘টি সট’ থেকে ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্লুজ’ থেকে পুরোপুরি ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’।
The lunatic is on the grass
The lunatic is on the grass
And if the cloud bursts, thunder in your ear
You shout and no one seems to hear
And if the band you’re in starts playing different tunes
I’ll see you on the dark side of the moon -Brain Damage
শুরুর দিকে ফ্লয়েড অ্যালবামগুলোতে হতাশা, নৃশংসতা এবং বিচ্ছিন্নতার ছাপ ছিল, যদিও কিন্তু পরবর্তী সময় তারা রক, অর্কেস্ট্রাইল মিউজিক, সাহিত্য এবং দর্শনের সংজ্ঞা দেয়। মানে, পুরোপুরি পিঙ্ক ফ্লয়েড ডেভিড বোয়ি থেকে নাইন ইঞ্চ নেইলস থেকে রেডিওহেড পর্যন্ত সবাইকে প্রভাবিত করেছিল। যেখানে একদিকে ‘দ্য লিজার্ড কিং’ খ্যাত জিম মরিসন, তার ‘দ্য ডোরস’ নিয়ে দুর্দান্ত ফর্মে।
‘কামন বেবে লাইট মাই ফায়ার’, ‘পিপল আর স্ট্রেঞ্জ হোয়েন ইউ আর স্ট্রেঞ্জার’ এমন সব সাইকেডেলিক মিউজিকে দিকভ্রান্ত মানুষকে উন্মাদ বানিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে লেড জ্যাপলিনের ছেলেরা যৌন ক্ষুধার্ত গিশার মতো ড্রেস পরে স্টেজ কাঁপাচ্ছে; কিন্তু ব্যারেটের হাতে সময় ছিল মাত্র অল্প কিছুদিন।
পিঙ্ক ফ্লয়েড ব্যারেটের রহস্যবাদী এবং সৃজনশীল ওয়ার্ডপ্লে দ্বারা প্রসারিত হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ব্যারেটকে তারা শৈল্পিক সাফল্যের দিকে ঠেলে দিলেও তা ছিল মূলত তার আত্মধ্বংসের টিকিট। ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার মাত্র ছয় মাস পর ব্যারেট উন্মাদ হয়ে যায় এবং ব্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হয়। গুজব ওঠে, ‘ব্যারেট ইজ নো মোর।’ রকস্টারদের জীবনে এমনই হয় আরকি। আসলেন ডেভিড গিলমোর, বুড়ো কিন্তু মারাত্মক ক্ষ্যাপা।
পিঙ্ক ফ্লয়েডের গানের একটা বড় দিক ছিল গান নিয়ে এক্সপেরিমেন্টের ব্যাপারটা। গানে তারা প্রচুর ফলি সাউন্ড ইউজ করেছে, শুধু দর্শকদের সাইকেডেলিক ধারণায় অভ্যস্ততার জন্য। সেই বিখ্যাত পম্পেতে একোসের (echoes) কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। এক পতিত আত্মা যেন সমুদ্রতলে কূল খুঁজে পাচ্ছে না, দিকভ্রান্ত।
ব্যারেট গ্রুপের প্রথম অ্যালবাম ‘দ্য পাইপার অ্যাট দ্য গেটস অব ডান’-এর জন্য এক দুর্দান্ত স্ট্রিং সরবরাহ করা হয় যা ছিল প্রাচীন চীনা পাঠ্য ‘অ্যাস্ট্রোনমি ডমাইন’ এবং ‘ইন্টারস্টেলার ওভার ড্রাইভ’-এর বায়ুমণ্ডলীয় শব্দের প্রতীক। রক এবং ব্লুজ দ্বারা প্রভাবিত পিঙ্ক ফ্লয়েড ভক্তদের কাছে আজও একটাই রহস্য, ‘হুইচ ওয়ান ইজ পিঙ্ক!’
ব্যারেটের চলে যাওয়ার শূন্যতা পূরণ করে ওয়াটারস ফ্লয়েডের শৈল্পিক দিকনির্দেশনা আঁকতে শুরু করে। ব্যান্ডের পরবর্তী ডি-ফ্যাক্টো লিডার হয়ে ওঠে রজার ওয়াটারস। এক আহত গোলন্দাজ, যার স্বপ্ন নিহত হয়েছে যুদ্ধে। এবং সেই স্মৃতিটুকু তাকে আটকে রেখেছে একাকিত্বে। ওয়াটারস ছিল যুদ্ধপরবর্তী স্বপ্নের একটি বিপ্লবী প্রয়োজন, যেন প্রত্যেক আহত যোদ্ধার মুখের গল্প, প্রাণের আকুতি।
পিঙ্ক ফ্লয়েডের হয়ে ওয়াটারস, ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন (১৯৭৩)’ থেকে শুরু করে ‘উইশ ইউ ওয়্যার হিয়ার (১৯৭৫)’, ‘অ্যানিমলস (১৯৭৭)’, ‘দ্য ওয়াল (১৯৭৯)’ এবং ‘দ্য ফাইনাল কাট (১৯৮৩)’ এই পাঁচটি অ্যালবামের গানের কথা লেখেন। ফ্লয়েডের জীবনগ্রহীতা, গ্লেন পোভির মতে, পৃথিবীর সর্বাধিক বিক্রীত ক্ল্যাসিক্যাল রক অ্যালবামগুলোর মধ্যে ‘ডার্ক সাইড অব দ্য মুন’ অন্যতম। অ্যালবামটি মুক্তি পায় ১৯৭৩-এর মার্চে। এটি পিংক ফ্লয়েডের অষ্টম অ্যালবাম। ধারণা করা হয়, এর প্রায় ৪৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছিল। লিরিসিস্ট ওয়াটার্সের মধ্যে দ্বন্দ্ব, লোভ, উন্মাদনার প্রসঙ্গ তো ছিলই; ধারণা করা হয়, ব্যারেটের মানসিক অবস্থার কিছু কথাও ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
ওয়াটারসের নেতৃত্বে পিঙ্ক ফ্লয়েড লস অ্যাঞ্জেলস, নিউইয়র্ক, লন্ডন এবং ডর্টমুন্ডের ওয়ার্ল্ড ট্যুরে যাত্রা করে। কিন্তু ব্রিটিশ ম্যাগাজিন ‘রোলিং স্টোনস’ খ্যাত সেই অস্তিত্ববাদী রজার ওয়াটারসও টিকে থাকতে পারেনি। জন লেনন হত্যাকাণ্ড এবং নিজেদের অন্তঃকোন্দলের কারণে ওয়াটারস ব্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হয় এবং ২৪ বছর পর ২০০৫ সালের ২ জুলাই লন্ডনের হাইড পার্কে ‘লাইভ-এইড’ কনসার্টে ব্যান্ডের সংক্ষিপ্ত পুনর্মিলন হওয়া অব্দি এটিই ছিল ওয়াটারসের সঙ্গে ফ্লয়েডের শেষ উপস্থিতি। ডেভিড গিলমোর ফ্লডিয়ানরা তাকে ভালোবেসে ডাকত বুড়ো চাচা।
সর্বকালের সেরা গিটারিস্টদের তালিকায় গিলমোর ছিল নিচ থেকে সবার উপরে। একদিকে ওয়াটারস বেদনার্ত সুরে আহত গানারের গল্প করছেন অন্যদিকে গিলমোর তার গিটার থেকে ছুড়ে দিচ্ছেন স্মৃতিমগ্ন ‘ইকোস’। কী অপূর্ব মেলবন্ধন! ফ্লয়েডের গানে ফুটে ওঠে কান্না, আর্তনাদ, নর-নারীর প্রেম, একটি স্বপ্নবোধ। সেখানে জোর নেই, বাধা নেই, আছে কেবল গিটারের উন্মাদনা। গিটার যেহেতু নিজেই এক বিপ্লব। অসহায় মানুষ যেখানে খুঁজে পায় কথা বলার, বেঁচে থাকার অধিকার।
গিটারের বিপ্লব আর নিক মেসনের ড্রামের তালে তালে লিরিকের ঝংকার। মূলত এই শিহরণ থেকেই আসে প্রচণ্ড অভিজ্ঞতা। ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার পর থেকে মেসন ছিল একমাত্র স্থির সদস্য, মানে যাকে বলে কনস্ট্যান্ট মেম্বার। কিন্তু ২০০৮-এ রিচার্ড রাইটের মৃত্যুর পর যেন সব গুটিয়ে নেয় গিলমোর। কারণ রাইটকে ছাড়া ব্যান্ডকে টিকিয়ে রাখার যুক্তি ছিল না তার কাছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি ব্যান্ডটি অবশেষে তাদের চিরস্থায়ী ভাঙনের খবর নিশ্চিত করে।
যদিও ওয়াটারস এবং মেসন এখনো জীবিত, যদিও বিশ্ব শ্রোতাদের মনে প্রশ্ন থাকবে তাদের ফিরে আসা নিয়ে, তাদের নতুন অ্যালবাম নিয়ে, একই সঙ্গে পারফর্ম করা নিয়ে। তাদের অস্তিত্ব থেকে যাবে যদিও নতুন কোনো কাজ দিয়ে নয় বরং সিড ব্যারেটের দেখা পিঙ্ক ফ্লয়েড নামটুকু দিয়ে। ‘sigma-6’ মিউজিকের জন্য কতটুকু করে গেছে তা আজও পিঙ্ক ফ্লয়েড শ্রোতাদের কাছে রহস্য।
ব্যান্ড সদস্য
নিক ম্যাসন-[ড্রামস, পারকিউশন, ভোকাল (১৯৬৫-১৯৯৫, ২০০৫, ২০১২-২০১৪)], রিচার্ড রাইট-[কিবোর্ড, পিয়ানো, অঙ্গ, ভোকাল (১৯৬৫-১৯৭৯, ১৯৯০-১৯৯৫, ২০০৫) ( ১৯৭৯-১৯৮১ এবং ১৯৮৬-১৯৯০)], রজার ওয়াটারস-[ব্যাস, ভোকাল, রিদম গিটার (১৯৬৫-১৯৮৫, ২০০৫)], সিড ব্যারেট-[লিড এবং রিদম গিটার, ভোকাল (১৯৬৫-১৯৬৮)], বব ক্লোস-[লিড গিটার (১৯৬৫)], ডেভিড গিলমোর-[লিড এবং রিদম গিটার, ভোকাল, বেস, কিবোর্ড (১৯৬৭-১৯৯৫, ২০০৫, ২০১২-২০১৪)]
স্টুডিও অ্যালবাম
দ্য পাইপার অ্যাট দ্য গেটস অব ডন [১৯৬৭], অ্যা সসারফুল অব সিক্রেটস [১৯৬৮], মোর [১৯৬৯], উম্মাগুম্মা [১৯৬৯], অ্যাটম হার্ট মাদার [১৯৭০], মেডল [১৯৭১], অবসকিউরড বাই ক্লাউড [১৯৭২], দ্য ডার্ক সাইড অব দ্য মুন [১৯৭৩], উইশ ইউ অয়্যার হিয়ার [১৯৭৫], অ্যানিমেলস [১৯৭৭], দ্য ওয়াল [১৯৭৯], দ্য ফাইনাল কাট [১৯৮৩]
অ্যা মোমেন্টারি লেপ্স অব রিজন [১৯৮৭], দ্য ডিভিশন বেল [১৯৯৪], দ্য এন্ডলেস রিভার [২০১৪]।