Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার সিনেপোয়েট্রি : চাঁদে ভ্রমণ

Icon

কায়েস সৈয়দ

প্রকাশ: ০৩ জুন ২০২৩, ১৩:২৬

ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার সিনেপোয়েট্রি : চাঁদে ভ্রমণ

ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা। ছবি: সংগৃহীত

Cinema with ink and paper ought to do the job faster than cinema on film.

—jean epstein

সিনেমা যখন নিষিক্ত হয় কাব্য উপাদানে অর্থাৎ কবিতা বা কাব্যময়তা যখন ব্যবহৃত হয় সিনেমায় তখনই তা হয়ে ওঠে সিনেপোয়েট্রি। জঁ ককতোর সিনেমা ব্লাড অব এ পোয়েট সিনেপোয়েট্রির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে বস্তুগত আকারের মাধ্যমে একজন কবির অবচেতন মনে চরিত্র সৃষ্টি করা ও আবার তাকে ধ্বংস করে ফেলার চিন্তাকে দৃশ্যমান করা হয়েছে কাব্যিকভাবে।

সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী, মৃণাল সেনের বাইশে শ্রাবণ কিংবা ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার ও সুবর্ণ-রেখা সিনেমাগুলোতে কাব্যময়তার ছড়াছড়ি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মেঘে ঢাকা তারা সিনেমায় নায়ক সনৎ-এর সাথে নায়িকা নিতার কথা বলার মুহূর্তে সৎ মায়ের চারপাশে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে মায়ের অন্তর্দাহ বা মনে মনে জ্বলা তথা হিংসা।

আমার কাছে এই প্রকাশ কবিতার প্রকাশ। আমাদের পরিচিত বাস্তবতাকে কাব্যদর্শন সমন্বিত একটা নতুন জগতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে সিনেপোয়েট্রি। পিয়ের পাওলো পাসোলিনি এবং আঁদ্রে তারোকাভস্কির সকল সিনেমাই যেন সিনেপোয়েট্রির প্রকাশ। পাসোলিনি নিজেই একজন কবি। আর তারোকাভস্কির পিতা ছিলেন একজন কবি। পিতার কাছ থেকে পাওয়া কাব্যময়তার ধারণা সিনেমায় প্রয়োগ করেন তারোকাভস্কি।

সালভাদর দালি ও লুইস বুনুয়েলের আন্দালুসিয়ান কুকুর পরাবাস্তব ছকে কাব্যময়তার তীব্র প্রকাশ। যেখানে শুরুতেই একজন লোককে ক্ষুর ধার দিতে দেখা যায়। তারপর ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ চাঁদ দেখে। কয়েকটি চিকন ফালি মেঘ পূর্ণিমার চাঁদকে ভেদ করে যায় এবং সাথে সাথে ওই ক্ষুর চোখকে ভেদ করলে বেরিয়ে আসে চোখের ভিতরের অংশ। এগুলো সিনেমায় কবিতারই প্রকাশ।

আন্দালুসিয়ান কুকুর চিত্রনাট্য পাঠ করে অনুপ্রাণিত হয়ে ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার আকাঙ্ক্ষা ও হতাশা নিয়ে তিনিও যা বলতে চান তা দৃশ্যমান করে এমন একটি চিত্রনাট্য লিখবেন, যেগুলো তিনি তার কবিতা, নাটক এবং ড্রয়িংয়ে প্রকাশ করতে পারেন সেগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

গারথিয়া লোরকার চিত্রনাট্য চাঁদে ভ্রমণ পরাবাস্তব ধাঁচে লেখা সিনেপোয়েট্রির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ যেখানে লেখার শব্দ আর চলচ্চিত্রের ছবির মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়েছে।

১৯২১ সালে গুইলারমো দেল তেরো তার মহাজাগতিক প্রবন্ধে চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি ধারণার বর্ণনা দেন যাকে তিনি সম্বোধন করেন সিনেগ্রাফিয়া বলে এবং পরবর্তীকালে যা আন্তোনিও এসপিনা তার চলচ্চিত্রগ্রহণ শিল্প প্রতিফলন প্রবন্ধে গ্রহণ করেন। এসপিনা ব্যাখ্যা করেন কীভাবে চলচ্চিত্র তাকে কথাসাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক ধারণা পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছিল।

স্প্যানিশ লেখকদের জন্য ১৯২০-এর দশকের মাঝামাঝিতে আধুনিক নাগরিকের কল্পনার ওপর সিনেমার একটি শক্তিশালী দখল বা আধিপত্য ছিল যা একটি শিল্পরূপ হিসেবে সাহিত্যের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। “ভবিষ্যতে যখন প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আমাদের দিবাস্বপ্ন ও কল্পনার দূরবর্তী প্রকাশ বাইরের জগতে সম্ভব করে তুলবে তখন সিনেমা অন্যান্য শিল্পের মূল উপাদানকে গ্রহণ করবে এবং আমাদের চেতনায় এর কর্মের বিস্তৃতি হবে সুবিশাল।”

প্রবন্ধটি উচ্চস্বরে বর্ণনা করে চলচ্চিত্র দর্শকদের নিবিষ্ট মুগ্ধতা, যখন তারা অন্ধকারে বসে পর্দায় বলা গল্পটা এমনভাবে অনুভব করে যেন তা একটি নির্মল স্বপ্ন। এসপিনা ব্যাখ্যা করেন, গল্প বলার এই রূপের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব চলচ্চিত্র দর্শকের নতুন অভিজ্ঞতার দ্বারা আরও বৃদ্ধি পায়, যিনি সম্মোহিত হন ক্যামেরার নড়াচড়া দ্বারা, একের পর এক ছবি তুলে এমনভাবে নির্বিঘ্নে একত্রিত করে যেন তাদের পিছনেও শিল্পকর্ম রয়েছে; কিন্তু তা থাকে অদৃশ্য।

১৯২০-এর দশকে এসপিনার মতো চলচ্চিত্র সমালোচকরা মন্তব্য করেন কীভাবে চলচ্চিত্র সম্পাদনা ও ক্যামেরার মধ্য দিয়ে বাস্তবতা দেখার ক্ষমতা চলচ্চিত্র পরিচালককে বাস্তব বস্তুগুলোকে নতুন উপায়ে একত্রিত করার সামর্থ্য দেয়। তারা এটাও লক্ষ করেন যে এটা আসলে তাই যা সিনেমাকে তার শক্তি প্রদান করে, বাস্তবকে অত্যন্ত প্রলোভনসঙ্কুলভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা ও স্বপ্নসুলভ আচরণ যা দর্শককে আরও উন্মুক্ত করার সম্ভাবনা রাখে।

ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার চিত্রনাট্য চাঁদে ভ্রমণ এই সিনেগ্রাফিয়া তথা সিনেপোয়েট্রির এক অনন্য উদাহরণ। তার সমসাময়িক অধিকাংশ আভাগার্দের মতো গারথিয়া লোরকাও চলচ্চিত্রের মাধ্যমকে ভেবেছিলেন অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। গারথিয়া লোরকার চিত্রনাট্যে যৌন আকাঙ্ক্ষা আর শৈল্পিক অভিব্যক্তির নতুন রূপের আকাক্সক্ষা দুটোই দাবিয়ে রাখা। চিত্রনাট্যটি যৌন স্বাধীনতার সংগ্রাম আর শৈল্পিক উদ্ভাবনের জন্য উদ্বেগকে উপস্থাপন করে।

ইয়ান গিবসন ১৯২০-এর দশকের শেষের দিকে গারথিয়া লোরকার জীবনের বিস্তারিত ঘটনাপঞ্জিতে বলেন, নিউইয়র্কে যাওয়ার পূর্বে প্যারিসের পথে আসা যাওয়ার সময়ে গারথিয়া লোরকা পরাবাস্তব চলচ্চিত্র আন্দালুসিয়ান কুকুর দেখেননি; কিন্তু নিউইয়র্কে থাকাকালে তিনি অবশ্যই চলচ্চিত্রটির সমালোচনা শুনেছেন ও পড়েছেন এবং সাথে সাথে চিত্রনাট্যটিও পড়েছেন। গারথিয়া লোরকার চিত্রনাট্যের অসচরাচর ইতিহাস ভালোভাবে নথিভুক্ত।

নিউইয়র্কে থাকাকালে ডিসেম্বর ১৯২৯ এবং জানুয়ারি ১৯৩০-এর মধ্যকার যে কোনো দুটি দিনে চিত্রনাট্যটি লেখা, নথির সাথে কয়েকটি অঙ্কন ছিল যা লিখিত অংশগুলোর অর্থ সুস্পষ্ট করে। নিউইয়র্কেই গারথিয়া লোরকার সাথে মেক্সিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা ও চিত্রশিল্পী এমিলিও এমেরোর সাথে বন্ধুত্বতা গড়ে ওঠে। গারথিয়া লোরকা তার চিত্রনাট্য বন্ধু এমিলিও এমেরোকে দিয়েছিলেন, যা এমেরো চিত্রায়িত করতে শুরু করেছিলেন ঠিকই; কিন্তু শেষ করতে পারেননি। চাঁদে ভ্রমণ-এর একটি অসম্পূর্ণ ও দুর্বল ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।

মূল পাণ্ডুলিপি ১৯৮৯ সালের আগ পর্যন্ত হারিয়ে গিয়েছে বলে মনে করা হয়, যা গচ্ছিত ছিল মৃত এমেরোর স্ত্রী ওকলাহোমার শয়নকক্ষের একটি নাইটস্ট্যান্ডে। আন্তোনিও মোনেগাল চাঁদে ভ্রমণ-এর ১৯৯৪ সালের সংস্করণে পূর্বের অনুষঙ্গী নোট, গারথিয়া লোরকার একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভূমিকা ও কয়েকটি ড্রয়িংসহ খুঁজে পাওয়া পাণ্ডুলিপির একটি সম্পূর্ণ অনুলিপি ছাপান।

মোনেগালের প্রকাশনার ক্যাটালন শিল্পী ফ্রেদেরিক আমাতকে গারথিয়া লোরকার ১৯৩০-এর চিত্রনাট্যকে একটি চলচ্চিত্রে রূপায়িত করতে অনুপ্রাণিত করেন যা ১৯৯৮ সালে অনেক সমালোচকেরও প্রশংসা পায়। চাঁদে ভ্রমণ লেখা হয় ৭২টি অংশে যা আখ্যানহীন আভাগার্দ লেখার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণযেখানে এটি না গদ্য না কবিতা, একটি চলচ্চিত্রের জন্য প্রতিচিত্র হিসেবে বোঝানো হয়েছে। নিউইয়র্কে যখন গারথিয়া লোরকা তার চিত্রনাট্যটি লেখেন তখন তার শৈল্পিক গতিপথের একটি নতুন পর্বের সূচনা করেন। তাৎপর্যপূর্ণভাবে দীর্ঘকালের জন্য লেখার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেন।

১৯১৮ সালের দিকে গারথিয়া লোরকা সিনেমার কৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সন্ধান করেন যখন তিনি গ্রানাডায় তার বন্ধু ম্যানুয়েল এঞ্জেলেস অর্তিজ, মিগুয়েল পিজারো এবং এঞ্জেল বারিওসের সাথে একটি সংক্ষিপ্ত প্রাথমিক চিত্রনাট্যে কাজ করেন। তাদের সহযোগিতার ফলাফল ছিল গুপ্তধনের ইতিহাস শিরোনামের চারটি ফটোগ্রাফের একটি সিরিজ (বর্তমানে গারথিয়া লোরকা ফাউন্ডেশনের আর্কাইভে সংরক্ষিত) যেখানে দেখায় একজন মুরের (স্প্যানবিজয়ী আরব্য মুসলমান) গুহায় তার গুপ্তধন পাহারা দেওয়া এবং গুহা দিয়ে চোরের অনুপ্রবেশের সময় তার হত্যাকাণ্ড।

নিউইয়র্কে থাকাকালে গারথিয়া লোরকা তার পূর্ববর্তী কাজগুলোর লোকজ আন্দালুসিয়ান উপাদান পিছনে ফেলে উত্তরোত্তর পরাবাস্তববাদে আকৃষ্ট হয়ে ওঠেন। গারথিয়া লোরকা নিজেই তার রচনাগুলোকে অসম্ভব বলেছিলেন, যা ডেনিসের মতো কিছু সমালোচক বুঝতে পেরেছিলেন যে সেগুলো পাঠক বা দর্শক থেকে এতটাই দূরবর্তী ও দুর্ভেদ্য ছিল যে সেগুলো বোঝার ক্ষেত্রে হতে পারে অর্থহীন বা অসম্ভব অথবা কাজগুলো যৌনতার সাথে এমনভাবে আচরণ করে যা সম্পূর্ণভাবে উপস্থাপনযোগ্য ছিল না।

চাঁদে ভ্রমণ একটি অসম্ভব কাজ নয় বরং এর লিখিত ও দৃশ্যত রূপ এবং যৌন আকাঙ্ক্ষা ও তার হতাশার মধ্যে মধ্যস্থতা করে যা একবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান দৃষ্টিলব্ধ রূপের ভোক্তাদের কাছে দারুণ অনুরণন বহন করে। প্রকৃতপক্ষে প্রথম পরিচয়ে ছবিগুলো বিসদৃশ মনে হতে পারে; কিন্তু তাদের পাশাপাশি ধারাবাহিক অবস্থান সৃষ্টি করে অর্থের সংযোজন, প্রতীকী স্তরে কাজ করে কাব্যবিন্যাসের প্রভাব। গারথিয়া এখানে একটি কৌশলের সাহায্য নিয়ে আন্তঃসংযোগের বোধশক্তিকে শক্তিশালী করেছেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫