Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

সাদা পোশাক

Icon

জাহিদ সোহাগ

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৩, ১১:৩৩

সাদা পোশাক

প্রতীকী ছবি

কোনো উদ্ভট প্রসঙ্গে কথা বলে অপরিচিত নারীকে চমকে দিতে হয়; তেমন কিছু একটা করতে ভূমিকা ছাড়াই তার হাতে একটি আপেল দিয়ে বললাম, ‘আমরা যখন পদ্মা সেতুতে উঠব আপনি এই আপেলটি ছুড়ে মারবেন, যাতে নদীতে পড়ে।’

নারীটি আপেল হাতে নিয়ে বিস্মিত, ‘কেন?’

তার স্কার্ফের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা চুলগুলো বাতাসে দাপাদাপি করছিল। যা আমার মুখে ঝাপটা দিচ্ছিল। আমি জানালা বন্ধ করতে গেলে তিনি হাত তুলে বন্ধ করতে নিষেধ করেন। 

এরই মধ্যে পদ্মা সেতুতে উঠে গেছে বাসটি। আমি তার নিষেধ অগ্রাহ্য করে জানালা খুলে প্রায় নির্দেশের সুরে বললাম, ‘ছুড়ে মারুন। এক্ষুনি।’

তিনি ছুড়ে মারলেন; কিন্তু রেলিংয়ে লেগে তা ব্রিজের মধ্যেই ছিটকে এলো। 

আমি একটু হেসে বললাম, ‘অনেক ভালো ছুড়েছেন। নদীতে না পড়লেও দ্বিতীয়বার অনুরোধ করব না।’

নারীটির কথা বলায় আগ্রহ নেই। তিনি দূরের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকছেন। 

তার মুখ খুব ঘামছিল। স্কার্ফ পুরোপুরি খুলে তিনি মুখ ও ঘাড় ভালো করে মুছে নিলেন।

হঠাৎ তিনি জানালার দিকে গলা বাড়ালেন আর হড় হড় করে বমি করে দিলেন।

আমার মেজাজটা খিঁচড়ে গেলেও আমি সিটের পকেট থেকে একটা পলিথিন বের করে দেই। তিনি সিটে বসে ব্যাগে বমি করতে থাকেন।

আমি নিজেকে যতটা সম্ভব পরিষ্কার করতে পারলেও উৎকট গন্ধ থেকে রেহাই পেলাম না। 

তাকে জানালার ধারে বসতে দিয়ে আমি তার সিটে বসলাম। বাসের কন্ডাক্টর কিছু নিউজ পেপার হাতে দিয়ে ভালো করে বমি মুছে নিতে বললেন। ততক্ষণে আমি বমির গন্ধের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছি।

তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আমাকে সরি বললেন। আমি প্রায় শুনতেই পেলাম না।

আমি একটি কমলা বের করে তার হাতে দিলাম। তিনি সেটা বাইরে ছুড়তে উদ্যত হলে তাকে থামিয়ে বললাম, ‘খান। টক-মিষ্টি খেলে ভালো লাগবে।’

তিনি আস্তে করে থ্যাঙ্কিউ বলে কমলাটার অর্ধেক খুলে আমার হাতে দিয়ে নিজে একটা কোয়া মুখে পুরলেন। 

আমি স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে শুরু করি, তবে কিছুতেই তিনি বিবাহিত কিনা, স্বামী কী করেন, ছেলেমেয়ে আছে কিনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে যাই না।

যদিও তার দিক থেকে হুঁ, হাঁ... ছাড়া কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। তাতে কী? তিনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছেন এটাই বেশি। 

ডিরেক্ট বাস হলেও পথে পথে যাত্রী উঠছে নামছে। একটা হকার উঠে কাঁচা পেয়ারার স্লাইস বিক্রি শুরু করেছে, এর আগে এক অন্ধ ভিক্ষুকের গান শোনা হয়ে গেছে।

আমি ওনার বিপর্যস্ত মুখ আর পিয়ানোর রিডের মতো হাতের আঙুল দেখে বোঝার চেষ্টা করি এখনো কেন তিনি দু-একটা বাক্য বলছেন না।

তার ব্যাগের ভেতর ফোন বাজে। স্ক্রিনে নাম দেখে মিউট করে দেয়, আবার ফোন বাজে, মিউট করে দেয়, তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে যা আর্তনাদের পর্যায়ে উঠে বাসের অন্য যাত্রীদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এরপর তার থেকে থেকে কান্না আসে আবার চলে যায়। আমি তার বমি সামলাতে পারলেও এই ধরনের কান্না সামলাতে পারছি না। কখনো মনে হয় সে হয়তো মূর্ছা গেছে, বা চেতন অচেতন জগতের মধ্যখানে ঝুলে আছে।

আমি আলতো করে তার নরম আঙুল স্পর্শ করে বলি, ‘আপনার কী হয়েছে? বলুন।’ 

তিনি অভিব্যক্তি পরিবর্তন না করে তার হাত সরিয়ে নিলেন, কিন্তু আমার হাতের ভেতর থেকে সবগুলো আঙুল ছাড়িয়ে নিতে পারলেন না; তার আগেই তার কান্নার গমক উঠতে শুরু করে। আমি ওয়ালেট থেকে কার্ড বের করে বললাম, ‘সত্যিই আমি আপনাকে হেল্প করতে চাই, যদি তা আমার দ্বারা সম্ভব হয়।’

উনি তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে খবরের কাগজ বের করে একটি ছবির দিকে তর্জনী তুলে আবার ফোঁপাতে শুরু করলেন।

ছবিটা আমার চেনা, সকালেই চা খেতে খেতে দেখেছি, নিউজটাও পড়া। শুধু একটি তথ্যে ভুল আছে, ১০টি ছোরার আঘাত নয়, ১১টি হবে। 

আমি তাকে বললাম, ‘আপনি ডেডবডি মর্গ থেকে ছাড়িয়ে নিতে চান তো?’ একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘তাহলে আমি চেষ্টা করতে পারি।’

তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মত হন। 

আমরা বাস থেকে নেমে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়াই। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে দু-কাপ চায়ের অর্ডার দেই। আমার পাজেরো পেছনে ছেড়ে এসেছি। পাঁচ-সাত মিনিটের পেছনে থাকার কথা সেটা; কিন্তু এই সময়টাকে অথৈ সমুদ্র বলে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে নারীটিকে মূর্ছা থেকে ফেরাতে মাথায় একপ্রস্থ পানি ঢেলেছি। এখন সে আমার মুঠোর মধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। পাজেরোটি দূর থেকে দেখার আগেই প্রায় সবগুলো প্রাইভেট কার ও ট্যাক্সিকে থামার জন্য ইশারা করি; কেউ থামে না। পাজেরোটি আমাদের সামনে থেমে আবার কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থামল। আমি পেছন পেছন দৌড়ে গেলাম নারীটির হাত ধরে। 

ড্রাইভারকে আইডি কার্ড দেখিয়ে বললাম, ‘আমাদের ঢাকা যেতে হবে। জরুরি। আমাদের লিফট দেন, প্লিজ।’ 

ড্রাইভার পাঁচ হাজার টাকা চেয়ে একটু হাসল। আমি রূঢ় কণ্ঠে বললাম, ‘সরকারি গাড়ি, আবার টাকা চাচ্ছেন?’ ততক্ষণে আমরা গাড়িতে উঠে গেছি। সামনের ইউটার্ন থেকেই আমরা ঢাকার পথে রওনা দেব। গাড়িটি রাস্তার ওপাশে যেতেই আমি ড্রাইভারকে থামতে বলে নারীটিকে বলি, ‘আমার ব্যাগে একটা নতুন শাড়ি আছে।’ ব্যাগ থেকে বের করে তার হাতে সেটা তুলে দিয়ে প্রায় হুকুম করলাম, ‘এটা পরে নিন। আপনার গা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছে।’

ড্রাইভারকে নিয়ে আমি গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট জ্বালালাম। ড্রাইভার পান মুখে নিল।

আমি ভাবতে লাগলাম হলুদ ছাপা শাড়িতে তাকে ভালোই মানাবে। যদি তিনি ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে নিতে পারতেন তাহলে সুন্দরই লাগত। গাড়িতে উঠে দেখি তিনি শুধু বোরখা খুলে দলা পাকিয়ে হাতে ধরে আছেন।

আমি আক্ষেপ করে বললাম, ‘শাড়িটা পরলেন না? কত লোকের কাছে যেতে হবে!’

আমরা গাড়িতে উঠলাম। স্পিড বেড়ে গেল সঙ্গে হেভি মেটালের গান। 

আমি তার সালোয়ার কামিজ ছিঁড়ে পুরো পিয়ানোটা বের করে আনি। এখন এটাই কিছুক্ষণ বাজিয়ে নিতে হবে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫