
কমলারানীর দিঘির পালার দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
যে গল্পগুলো জনমানুষের গভীর বোধ থেকে সৃষ্টি এবং যে গল্প জনমানুষের ভাব-চিত্তের মননের সাথে সংশ্লিষ্ট সে গল্প আমাদের হাজার বছরের বাঙলা নাটকের আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে উঠে আসে। অতিপ্রাচীন চর্যাপদের বুদ্ধনাটক কিংবা মধ্যযুগের সাহিত্য, গীতিকা, পাঁচালি, কিচ্ছা, কীর্তন আর পালাগানের আঙ্গিক আমাদের মনে করিয়ে দেয় বাংলা নাটকের ইতিহাসের প্রাচীনত্ব। বিভিন্ন লোকজ গল্প বা কিচ্ছা আমাদের প্রাচীন জনসমাজে প্রচলিত ছিল।
পরে এইসব কাল্পনিক গল্প বা সত্যমূলক ঘটনা গীত-নৃত্যাভিনয়ের আশ্রয়ে পূর্ণাঙ্গ লোকগীতে পরিণত হয়। আবার পরিবেশনার ক্ষেত্রে যখন চরিত্রমূলক উপস্থাপনার রীতির প্রয়োজনীয়তা আসলো তখন সেটি রূপ নিল নাট্যমূলক পালা হিসেবে।
‘কমলা রানীর সাগর দিঘির পালা’ ঠিক এইরকমই একটি পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় নাট্যমূলক পালা। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যবিভাগে পরিবেশিত হলো এই জনপ্রিয় পালাটি। নাট্যমূলক এই পালাটি নির্দেশনা দিয়েছেন স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রান্ত সাহা।
আখ্যানটির সারসংক্ষেপ এই যে, রাজা ধর্মরাজ প্রজাদের পানির অভাব মেটানোর জন্য একটি দিঘি খনন করেন কিন্তু সে পুকুরে পানি ওঠে না। পরে স্বপ্নের মধ্যে ধর্মরাজ দেখেন রানী কমলাসুন্দরী যদি পুকুরের মাঝে পুজো করেন তাহলে পুকুরে পানি উঠবে। সে প্রেক্ষাপটে রানী পুকুরের মাঝখানে পুজো আরম্ভ করলে পুকুরে পানি উঠতে থাকে; কিন্তু এই পরিস্থিতেও রানী প্রণামরত অবস্থায় স্থির থাকে। একপর্যায়ে পুকুর পানি ভর্তি হলেও রানী আর উঠে আসে না। রাজা অস্থির হয়ে ওঠে রানীর জন্য।
কারণ তাদের কয়েক মাসের শিশুসন্তান মাতৃদুগ্ধ ছাড়া আর কিছু খায় না। ইতিমধ্যে রাজা আবার স্বপ্নে দেখেন যদি শিশুপুত্রকে পুকুর পাড়ে রেখে আসা হয় তাহলে রানী তাকে দুধ খাওয়াবেন; কিন্তু শর্ত এই যে রানীকে স্পর্শ করা যাবে না। এরপর রাজা প্রত্যেক রাতে সন্তানকে পুকুর পাড়ে রেখে এলে রানী সন্তানকে দুধ পান করাতে থাকে; কিন্তু একদিন রাজা রানীকে স্পর্শ করার চেষ্টা করলে রানী পুকুরের পানিতে মিলিয়ে যায়।
মূল গল্পের এই আখ্যানটি পালাকার তার আসরে নিজস্ব স্বতন্ত্র আঙ্গিকে পরিবেশনে চেষ্টা করেন। পালাকার যদি চান এত বড় আখ্যানের যে কোনো জায়গা থেকে শুরু করতে পারেন। পরিবেশিত পালাটির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় এই যে পালাকার গল্প কথনের মধ্য দিয়ে দর্শকের দিকে তির্যক মন্তব্য করে হাস্যরসাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্যের সূচনা হয় সৃষ্টিকর্তার বন্দনার মধ্য দিয়ে। এর মধ্য দিয়ে পালাকার বর্ণনাত্মক চরিত্রাভিনয়ের মধ্য দিয়ে মূলত গল্প এগিয়ে নিতে থাকেন।
এখানে পালাকার গল্পের তাগিদে কখনো হয়ে ওঠেন রাজা, কখনো রানী কিংবা কখনো উজির। এই যে এক চরিত্রের মধ্যে বহুত্বের অবস্থান লক্ষণীয়, তা বাংলা নাটকের নিজস্ব আঙ্গিক। দোহারে বসেন ঠেটা যিনি পালাকারের সাথে কথোপকথনের মধ্যে গল্পের দ্বন্দ্ব তুলে ধরেন। নাট্যনির্দেশক পালাকারের প্রপস হিসেবে ব্যবহার করেছেন বালিশ, দড়ি, ব্যাগ। বালিশটিকে পালাকার চরিত্রের প্রয়োজনে কখনো ঘোড়া আবার কখনো কলস হিসেবে ব্যবহার করেছে।
অন্যদিকে গানের ব্যবহারের জনপ্রিয়তাকে গুরুত্ব দিয়েছে নির্দেশক যার জন্য দর্শক সহজেই একাত্মতা বোধ করেছে। হাজার বছরের বাংলা নাটকের শেকড়ে রয়েছে আমাদের নিজস্ব শিল্প আঙ্গিক। ঐতিহ্যবাহী এই কমলাসুন্দরীর পালাতে উঠে এসেছে বাঙালির একান্ত শিল্পবোধ ও চেতনা। এর সাথে সাথে বলতে পারি প্রাচ্যের নাট্যচর্চা পাশ্চাত্যের নাট্যের ধারা থেকে বেশ ভিন্ন।