বনপাংশুল মঞ্চনাটকের দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত
যেখানে প্রকৃতির সাথে আত্মার লীন হয়ে সর্বপ্রাণের অস্তিত্ব অনুধাবন করা যায় কিংবা ভূমিপুত্রদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কথা উঠে আসে এমনি এক আখ্যান নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ‘বনপাংশুল’।
‘পাংশুল’ শব্দের অর্থ ‘শিব’। অনার্য দেবতা শিবের সাথে এই মাটি আর প্রকৃতির ভূমিপূত্রদের যে সংযোগ তার সাথে সাথে মান্দি জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামের গল্প অবলম্বনে সেলিম আল দীন নাটকটি লিখেছেন নব্য-পাঁচালি আঙ্গিকে। থিয়েটার দল ‘অন্তর্যাত্রা’ সম্প্রতি জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মুক্তমঞ্চে বনপাংশুল নাটকটি মঞ্চায়ন করেছে। নাটকটি নির্দেশনা দিয়েছেন খন্দকার রাকিবুল হক। এই নাটকে ফুটে ওঠে শোষক আর শোষিতের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
কিংবা নিপীড়িতের নিজের মাটিকে আঁকড়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা। মধুপুরের মান্দি জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত লড়ে যায় টিকে থাকার সংগ্রামে। নিজের ভিটে থেকে উচ্ছেদ, ক্রমাগত শোষণের মহাজনি প্রথা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের শিকার সুকি, গুণীন, রাজেন্দ্র, মঙ্গলি, সোনামুখী, নৃপেন চরিত্রগুলো যেন হাজার বছরের শেকড়ে নিজেদের অস্তিত্বের কথা জানান দিচ্ছে। মান্দিদের জীবন, বিশ্বাস, রীতি-নীতি, সর্বপ্রাণের প্রতি যে তাদের বিশ্বাস তা লক্ষণীয় এই নাটকে। নাটকের শেষে স্পষ্ট হয় ধর্ষিত সুকির গর্ভেই আসছে নতুন এক প্রাণ নতুন আরেক ‘বনপাংশুল’।
নিপীড়িত মান্দি গোষ্ঠীর আনন্দ, বেদনা, বেঁচে থাকার লড়াইয়ের বাতাবরণে নির্মিত হয়েছে বনপাংশুল। ঐতিহ্যবাহী বর্ণনাত্মক বাংলা নাটকের আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়েছে এই নাটক। বাংলার চিরায়ত দর্শন দ্বৈত-অদ্বৈতবাদের প্রভাব লক্ষণীয় এখানে। ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিতে গীতাভিনয়ের অদ্বৈতবাদের সুর স্পষ্ট জানান দেয় শেকড়ের নাট্য আঙ্গিক।
মঞ্চে অবস্থানকারী দোহার সঙ্গীতের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ধ্রুপদী রাগ নাটকের দৃশ্য আবেগকে দর্শকের সাথে সহজে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করেছে। নাটকের আলোর ব্যবহার দৃশ্যের ভাবকে ফুটিয়ে তুলেছে। বনপাংশুল যেন সে সব মানুষের গল্প বলে গিয়েছে যারা জানে নিজের অস্তিত্বের শেকড়ের গভীরতার তীব্রতা। অন্তর্যাত্রা থিয়েটার যথাযথভাবে তার শৈল্পিক কারুকার্যে এই নাটকটি বিনির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ভ‚মিপুত্রদের শ্রেণিসংগ্রামের ভাষা হোক শিল্পের নন্দনতত্ত্বের আলোকে।