Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বাঙালির প্রমিথিউস

Icon

স্বকৃত নোমান

প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২০, ১৩:৩২

বাঙালির প্রমিথিউস

গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউসের কথা নিশ্চয়ই সবাই জানেন। প্রমিথিউস মানুষকে সৃষ্টি করে দেবতাদের আদলে। মানুষরা পৃথিবীতে বসবাস শুরু করার পর তার মনে হলো মানুষের আগুনের প্রয়োজন। তাই সে মানুষকে আগুন উপহার দেওয়ার জন্য জিউসের কাছে প্রস্তাব রাখল। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল জিউস। কিন্তু দমল না প্রমিথিউস। স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে মানুষকে উপহার দিলো।

এর ফলে জিউসের কোপানলে পড়ল প্রমিথিউস। ক্রোধান্বিত জিউস এক পাহাড়ের সঙ্গে বেঁধে ফেলল প্রমিথিউসকে। তার নির্দেশে এক বিশালাকার ঈগল প্রতিদিন ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলত প্রমিথিউসের যকৃৎ। রাতের বেলায় সেই যকৃৎ আবার তৈরি হতো। এভাবে চলল বহু বছর। পরে জিউসপুত্র হারকিউলিস বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে প্রমিথিউসকে।

বঙ্গবন্ধুকে কি গ্রিক পুরাণের প্রমিথিউসের সঙ্গে তুলনা করা যায়? আমার মনে হয়, যায়। প্রমিথিউস যেমন মানুষকে ভালোবেসেছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধু ভালো বেসেছিলেন বাঙালিকে। প্রমিথিউস মানুষকে দিয়েছিল সোজা হয়ে দাঁড়ানোর এবং আকাশের দিকে তাকাতে পারার ক্ষমতা।

প্রমিথিউস মানুষকে দিয়েছিল আগুন, বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন বাঙালির জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মানুষকে আগুন উপহার দেওয়ায় জিউসের কোপানলে পড়েছিল প্রমিথিউস, আর বাঙালিকে স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেওয়ায় বিশ্বাসঘাতকদের কোপানলে পড়েন বঙ্গবন্ধু। তাই দু’জনের মধ্যে খুব বেশি ফারাক নেই। ফারাক শুধু এটুকু- প্রমিথিউসকে উদ্ধার করেছিল হারকিউলিস। বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকদের বুলেট থেকে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। বাঙালিকে ভালোবাসে তিনি উৎসর্গ করেন নিজের জীবন। 

বঙ্গবন্ধুকে বলা হয় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। কেন তিনি শ্রেষ্ঠ? জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে অবদান রাখা গুণী বাঙালির সংখ্যা কম নয়; কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি নেই। বঙ্গবন্ধু এমন এক রাজনীতিবিদ, যিনি বাঙালিকে উপহার দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। 

ভারতবর্ষে, বিশেষত বাংলায়, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা ব্রিটিশরা আসার আগেও ছিল, কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু অপচেষ্টাকারীরা কখনোই সফল হতে পারেনি। হিন্দু ও মুসলমান দুটি পক্ষ সরাসরিভাবে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নিয়েছিল এবং অসমতা থাকলেও তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক-সংঘাত ছিল না; কিন্তু তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ব্রিটিশদের আসার পরে বহুবিধ কারণে হিন্দু-মুসলমানের বৈচিত্র্যমূলক সম্পর্ক দ্রুত বিরোধমূলক সমস্যায় রূপ নেয় এবং যে পক্ষটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত ছিল তার একটি অংশ ইংরেজদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারপর তো এলো তথাকথিত দ্বিজাতি তত্ত্ব।

এই তত্ত্ব সঙ্গে নিয়ে এলো রক্তের বন্যা। ভারতবর্ষ ভাগ হলো। ভাগাভাগির মাধ্যমে এর বড় টুকরোটি নিয়ে গেল পাকিস্তান, ছোট টুকরোটি নিল ভারত; কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক বাংলা কিছুতেই যৌথভাবে বসবাস করতে পারছিল না। শুরু হলো অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত। তেইশ বছর ধরে এই সংঘাত চলল। 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব এখানেই, তিনি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের কাছ থেকে অসাম্প্রদায়িক বাংলার বড় টুকরোটিকে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আলাদা করে এই বাংলাকে আবার তার হাজার বছরের ঐতিহ্যের মধ্যে পুনঃস্থাপিত করে দিলেন।

খেয়াল করা দরকার, ৭ মার্চের ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবেই বলছেন, ‘বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’ আরও খেয়াল করা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার অন্যতম ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, যেটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে এই বাংলায় বর্তমান ছিল। তার মানে বঙ্গবন্ধু এই বাংলাকে স্বাধীন করার মধ্য দিয়ে আবার তার পূর্বের জায়গায় ফেরত এনেছেন। 

দুই.

মানুষ দুই প্রকারের। আত্মমুখী এবং বহির্মুখী। আত্মমুখী মানুষরা শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবেন, নিজেকে নিয়েই থাকেন। অপরদিকে, বহির্মুখী মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবেন না, তাদের সব ভাবনা-চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু সব মানুষ। 

একইভাবে রাজনীতিবিদও দুই প্রকারের। এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ নিজের জাতিকে মহিমান্বিত করার জন্য রাজনীতি করেন। যেমন মহামতি আলেকজান্ডার, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, আব্রাহাম লিংকন প্রমুখ। আরেক ধরনের রাজনীতিবিদ আছেন, যারা রাজনীতি করেন নিজেকে মহিমান্বিত করার জন্য, নিজের শৌর্য বৃদ্ধির জন্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রথম শ্রেণিভুক্ত একজন রাজনীতিবিদ, যিনি ধারণ করেছিলেন মহৎ রাজনীতিবিদ ও মহৎ শাসকের গুণাবলি, কর্মের মধ্য দিয়ে যিনি নিজেকে উন্নীত করেছিলেন এক অনন্য উচ্চতায়। 

১৯৭১ সালে হুট করেই নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অভ্যুদয় ঘটেনি। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের গোড়া থেকেই ছিল তার সম্পৃক্ততা। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজপথে সক্রিয় ছিলেন আন্দোলন-সংগ্রামে। সারাজীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে ৭ দিন কারাভোগ করেন, বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তাঁর জেলজীবন কাটে পাকিস্তান আমলে। ৫৪ বছরের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তাঁর মোট জীবনের সিকিভাগ।

পাকিস্তান সরকার বারবার তাঁকে কারারুদ্ধ করেছে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে পাকিস্তান সরকার প্রথমবারের মতো তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তারপর আরো বহুবার গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। সর্বশেষ গ্রেফতার হন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেদিন প্রথম প্রহরে হানাদার বাহিনী তাঁকে ধানম-ি ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান নিয়ে যায় এবং কারাগারে বন্দি করে রাখে।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু যখন আন্দোলন শুরু করলেন তখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলো। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি থাকলেন। কাজের মানুষ তিনি; কিছু না কিছু কাজ তাঁকে করতেই হবে। এই সময়গুলোতে তাঁর স্ত্রী মহীয়সী নারী শেখ ফজিলাতুন্নেছার প্রেরণা ও অনুরোধে তিনি ডায়েরি লিখতে শুরু করলেন। যতবার তিনি জেলে গেছেন ফজিলাতুন্নেছা কিছু খাতা কিনে কারাগারে পৌঁছে দিয়েছেন। আবার যখন মুক্তি পেতেন খাতাগুলো সংগ্রহ করে নিজের কাছে যতœ করে রেখে দিতেন। নিশ্চয়ই তাঁর চিন্তা ছিল দূরদর্শী। এসব ডায়েরির লেখাগুলো যে একদিন বাংলার ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কারাগারে বসে যে ডায়েরি লিখেছিলেন সেই ডায়েরি নিয়েই কারাগারের রোজনামচা বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। 

তিন.

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঙালি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন বঙ্গবন্ধু। তাই স্বাবলম্বিতা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিমালাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজান। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন, যার লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন, ক্ষেতে খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। নতুন আশার উদ্দীপনা নিয়ে স্বাধীনতার সুফল মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিন্তু মানুষের সেই সুখ বেশিদিন স্থায়ী হলো না।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই বিষাদরজনীর কথা সবাই জানেন। ’৭৫ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তো সবার জানা। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বদলে যেতে লাগল বাংলাদেশের চেহারা। যে দেশের মানুষ অকাতরে জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছিল সে দেশটি আবার পেছনমুখী হাঁটতে শুরু করল। পরবর্তীকালে জাতির পিতাকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার জন্য যা যা করা দরকার সব করার উদ্যোগ নিল বিশ্বাসঘাতকরা। 

কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নাম কি মোছা গেছে? তিনি শহীদ হয়েছেন পঁয়তাল্লিশ বছর আগে। পঁয়তাল্লিশ বছর আমার মতো অসংখ্যা মানুষ লিখছেন। তেতাল্লিশ বছরে তাকে নিয়ে অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধ রচিত হয়েছে। রচিত হয়েছে অনেক বই। বাংলার কোটি কোটি মানুষের বুকে উচ্চারিত হয়েছে, হচ্ছে তাঁর নাম। প্রতি বছরই পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মদিবস। ১৭ মার্চ এখন জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস। প্রতি বছরই পালিত হচ্ছে তাঁর প্রয়াণদিবস। ১৫ আগস্ট এখন জাতীয় শোক দিবস। তার মানে ইতিহাসের পাতা থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার যে অপচেষ্টা হয়েছিল তা সফল হয়নি, সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। হওয়ারই কথা।

কারণ, বঙ্গবন্ধু বাংলার সূর্য। কৃষ্ণভয়ংকরী মেঘ মাঝেমধ্যে সূর্যকে ঢেকে ফেলে। কিন্তু তা খুবই সাময়িক, দীর্ঘক্ষণ সূর্যকে ঢেকে রাখা যায় না। সূর্য তার আপন বিভায় মেঘ তাড়িয়ে উঁকি দেবেই। দিন যতই যাচ্ছে ততই উজ্জ্বল হচ্ছেন বাঙালির প্রমিথিউস, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উজ্জ্বল হচ্ছে তাঁর কীর্তিগাঁথা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫