
প্রতীকী ছবি
নাহ, কিছুই হচ্ছে না। তিনি চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রাখেন। মাস্ক খুলে ফেলেন। সারা শরীর মোড়ানো সাদা হ্যাজমেত স্যুট খুলে ফেলেন। গায়ের জামা এবং পান্তালুনও খুলে ফেলেন। গবেষণাগারের ভেতরে নগ্ন হয়ে পড়া বিপজ্জনক। ভারসাম্য হারাননি এন্টন, ঝুঁকির বিষয়টি পুরোপুরিই তার মাথায় ছিল। এখনই যে অ্যালার্ম বেজে উঠবে এ বিষয়ে তার কোনো সন্দেহই ছিল না।
ইউনিফর্মের ওপর সাদা অ্যাপ্রোন জড়িয়ে ল্যাবে ঢোকেন দুজন নিরাপত্তা কর্মী। তাদের একজন, যিনি দলনেতা, বেশ বিনয়ের সঙ্গেই বলেন, ড. জেইলিঙ্গার আপনি পোশাক পরুন অথবা এক্ষুনি ল্যাব থেকে বেরিয়ে যান। এন্টন দুহাত তুলে ওদেরকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি পাগল হয়ে যাননি, তার খুব গরম লাগছিল, তবে ল্যাবের ভেতরে পোশাক খুলে ফেলাটা ঠিক হয়নি। তিনি এজন্য অনুতপ্ত।
প্রথমেই টেবিলের ওপর থেকে চশমাটা তুলে চোখে দেন এন্টন। এবার স্পষ্ট দেখতে পান ওর গা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া লম্বা হ্যাজমেত স্যুটটি শূন্যে ঝুলে আছে। মনে হচ্ছে এটি হ্যাঙ্গারে ঝুলছে অথবা অদৃশ্য কোনো প্রাণী এটি পরে আছে, অথচ এই ঘরে কোনো হ্যাঙ্গার নেই। তিনি আড়চোখে স্যুটটিকে একবার দেখে নিয়ে মেঝে থেকে জামা এবং পান্তালুন তুলে ঝটপট পরে ফেলেন। নিরাপত্তা কর্মীদের একজন নারী, তিনি উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছেন।
৩৬ বছরের তরুণ বিজ্ঞানী এন্টন জেইলিঙ্গার যখন ঘুরে শূন্যে, হ্যাঙ্গার থেকে জামা নেবার মতো করে, শুভ্র হ্যাজমেত স্যুটের দিকে হাত বাড়ান তখন সেখানে কোনো স্যুট ছিল না। ওটা ওর পেছনে, টাইলসের মেঝের ওপর স্ত‚পাকার পড়ে ছিল। একটি ঝুলন্ত হ্যাঙ্গার জাদুবলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে জামাটি যে অবস্থায় মেঝেতে থুবড়ে পড়বে ঠিক সেই অবস্থা থেকে স্যুটটি তুলে নিয়ে তিনি তা নিজের বাঁ হাতের এলবোর ওপর ভাঁজ করে রাখেন এবং দ্রুত ল্যাব থেকে বেরিয়ে যান।
বিশ্বখ্যাত এমআইটির ল্যাবে কাজ করার ইচ্ছেটা ওর আস্তে আস্তে মিইয়ে যাচ্ছে। ছাত্রদের পড়াতে এখনো ভালো লাগে, তাই চাকরি থেকে ইস্তফা দেননি। কিন্তু গবেষণাটা ঠিক হয়ে উঠছে না। এলিজাবেথ এখন ভিয়েনায়। স্ত্রীর কথা খুব মনে পড়ছে। চিত্ত এ রকম অস্থির হলে এলিজাবেথ বড়ো এক কাপ ধূমায়িত ইয়োগি টি হাতে নিয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে হাসতে হাসতে বলেন, মনে হচ্ছে খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছ।
ওর বন্ধুদের মতো স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই এন্টনের। অন্য স্ত্রীদের মতো এলিজাবেথ কখনোই বলেন না, ‘তুমি খুব ক্লান্ত, এবার একটু বিশ্রাম নাও’, অথবা ‘আজ আর ল্যাবে ঢুকবে না।’ কখনোই তিনি ভালোবাসার জোর খাটান না।
চার্লস নদী বরাবরই শান্ত। হেমন্তের হাওয়ায় বার্চ, ওক গাছগুলো টুপটাপ হলুদ পাতা ঝরাচ্ছে। সেই হাওয়ায় আজ চার্লসও কিছুটা উতলা। এন্টন আনমনে চার্লসের তীর ধরে দীর্ঘ ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে নিজের পদক্ষেপ গুনছেন। হিসেব করে বের করার চেষ্টা করছেন দু বছরে কটা পদছাপ এঁকেছেন তিনি এই মার্কিনি নদীর পাড়ে। এই পদছাপগুলো কী বার্তা দিচ্ছে পৃথিবীকে? শুধুই কি ব্যর্থতার গুচ্ছ গুচ্ছ ভেংচি এবং তা বস্টন থেকে হাওয়ায় উড়তে উড়তে অতলান্তিক পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে ভিয়েনায়, অতঃপর সমগ্র ইউরোপে?
এন্টন নিশ্চিত জন স্টুয়ার্ট বেলের “বেল’স থিওরেম” সত্য। হয়তো সবকিছুরই জোড়া আছে এবং তারা একই বৈশিষ্ট্যের, যমজ দুটি সত্তা প্রকৃতপক্ষে একটিই। এদেরকে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে সরিয়ে রাখলেও মাধ্যম ছাড়াই যোগাযোগ ঘটে। একটির আচরণে পরিবর্তন ঘটলে অন্যটিরও একই সঙ্গে পরিবর্তন ঘটে। আলোর গতি এখানে অর্থহীন। জপমন্ত্রের মতো এন্টন বিড়বিড় করে বারবার বলছেন, ‘ভার্শট্রিকুং, ভার্শট্রিকুং, ভার্শট্রিকুং।’
হঠাৎ কি হাওয়ার তীব্রতা বেড়ে গেল? এন্টনের মনে হচ্ছে তিনি সামনের দিকে হাঁটছেন না, হাওয়াটা ওকে পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তিনি উল্টোদিকে হাঁটছেন এবং হাওয়াটা নিছকই হাওয়া নয়-এর মধ্যে কেউ আছে, নিরাপত্তা কর্মীদের মতো দশাসই কেউ, হয়তো ওরা একাধিক। এবং হঠাৎ, ধাক্কার মতো, একটা নিস্তব্ধতা নেমে আসে চার্লসের তীরে। নদীর ঢেউগুলো থেমে যায়, গাছ থেকে পাতাঝরা বন্ধ হয়ে যায়, এন্টনের হাঁটা থেমে যায়। কোয়ান্টাম মেকানিজমের লজিক দিয়ে এন্টন এসবের ব্যাখ্যা খুঁজতে থাকেন।
অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে অ্যাডামকে ফোন করেন এন্টন। অ্যাডাম ওর প্রিয় ছাত্র, অসম্ভব মেধাবী।
-তুমি কি আজ আসবে?
-বেরিয়েই পড়েছিলাম, ফোনের শব্দ পেয়ে ঘরে ঢুকলাম।
-সোজা আমার এখানেই আসছ তো?
-পথে লন্ড্রিতে যাব, কাপড় ড্রপ করব।
-কতক্ষণ লাগবে আসতে?
-৪০ মিনিট, ভাবছি হেঁটে আসব।
-ট্যাক্সি নিতে পারবে? টাকা আছে তো?
-তা আছে, চার্লস নদীর পাড়ে নৃত্যরত রূপসী হেমন্তকে দেখব বলে হাঁটার কথা ভাবছিলাম, কিন্তু তাড়া কেন কোথাও যাবেন?
-হ্যাঁ যাব, তোমাকে আজ ডিনার খাওয়াব। আমি ভয়ানক ক্ষুধার্ত, জলদি এসো।
ডোর বেল টিপতে হয়নি। অ্যাডাম এসে দরজায় দাঁড়াতেই দরজাটি ভেতর থেকে খুলে যায়।
-ভেতরে ঢুকবার কোনো দরকার নেই, চলো। অ্যাডামকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সিঁড়িতে নামিয়ে দেন এন্টন। বস্টনের আকাশ তখনো লাল। অক্টোবরের সূর্য ডুবেছে: কিন্তু পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে ওঠেনি। ৪১ ইউনিয়ন স্ট্রিট বেশ নিরিবিলি। একটি হলুদ ট্যাক্সি সাইডওয়াক ঘেঁষে থামে। ১৯৮২ সালের হেমন্ত-সন্ধ্যা এতটা চুপচাপ হওয়ার কথা নয়।
ট্যাক্সির চালক একজন ছাত্র, আদিল হোসেন। দু বছর আগে, আশি সালের জুলাই মাসে সোজা দিনাজপুর থেকে বস্টনে এসেছেন।
দিনাজপুর সরকারি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আদিল। ঢাকা বিমানবন্দরে গিয়ে প্লেন ধরা ছাড়া, সারাজীবনে আর মাত্র দুবার নিজের দেশের রাজধানী শহরে গিয়েছেন আদিল। সেই মানুষ দু বছরের মধ্যেই আমেরিকার মতো উন্নত একটি দেশের ট্রাফিক আইন মেনে ট্যাক্সি চালানোর মতো দক্ষ চালক হয়ে উঠেছেন। চমৎকার ইংরেজি বলেন। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন, অ্যাস্ট্রো ফিজিক্সে।
আরোহীদের আলাপচারিতা ওকে বিভ্রান্ত করেনি। পাগল মনে হয়নি। ওদের একজন এমআইটির শিক্ষক, অন্যজন তারই ছাত্র তা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয়নি। আদিল এও বুঝতে পারেন শিক্ষক ভদ্রলোক জার্মানি বা অস্ট্রিয়ার নাগরিক হবেন, কারণ ওর ইংরেজি উচ্চারণে আদিলের জার্মান সহপাঠী আর্মিনের মতো অ্যক্সেন্ট। ভদ্রলোক বারবার বেশ জোর দিয়ে বলছিলেন কোয়ান্টাম ফিজিক্সের গভীরে ঢোকেননি আইনস্টাইন, ঢুকলে তিনিই ‘এন্টেঙ্গেলমেন্ট’ প্রমাণ করে দিয়ে যেতেন।
রেস্টুরেন্টের নাম ইউনিয়ন অয়েস্টার হাউস। ১৮ শতকের একটি পুরনো দালান, নিচু সিলিং। সি-ফুডের জন্য বিখ্যাত। খাবারের দাম একটু বেশিই কিন্তু এটিই এন্টনের প্রিয় রেস্টুরেন্ট। সারা গায়ে আগুন নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায় উর্বশী ওয়েটার। বেশ একটু সময় নিয়ে ওরা খাবারের অর্ডার দেয়। মেয়েটিও ‘আমার সময়ের অভাব নেই’ টাইপের একটি অভিব্যক্তি সারা অঙ্গে ফুটিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে মেন্যুতে নতুন যুক্ত হওয়া খাবারগুলোর স্বাদ, ইনগ্রিডিয়েন্স এবং অরিজিন ব্যাখ্যা করে। কথা বলার সময় মেয়েটির নীল চোখ থেকে ঝরে পড়ছিল আলোর ফোটন এবং সেগুলোকে এন্টনের দৃষ্টির তরবারি খণ্ডবিখণ্ড করে দিচ্ছিল। খণ্ডিত টুকরোগুলো জোড়ায় জোড়ায় তৈরি হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল সমস্ত রেস্টুরেন্টে।
মেয়েটি যখন মেন্যু হোল্ডার দুটি বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কিচেনের দিকে হাঁটছিল অ্যাডাম তখন ওর কালো পান্তালুন ঠেলে বেরিয়ে আসা গুরুনিতম্ব-জোড়া থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না।
-আগে দেখোনি ওকে? এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে অ্যাডাম।
-নতুন মনে হচ্ছে। গত মাসে যোগ দিয়েছে। দক্ষিণ ইতালির মেয়ে, নাতালিয়া, নর্থ-ইস্টার্নে ভর্তি হয়েছে, বিজনেসে মাস্টার্স করছে।
আলোচনার যে পর্যায়ে অ্যাডাম একই সঙ্গে প্রফেসরের অস্থিরতা এবং উদারতার প্রসঙ্গটি তুলেছে তখনই এক প্লেটে বিশাল একটি লবস্টার, অন্যটিতে স্পেগ্যাটি এবং সঙ্গে একটি পূর্ণ বিকশিত মেডোনা লিলি ফুলের হাসি টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল নাতালিয়া। নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঝুঁকে খাবারের প্লেটগুলো টেবিলে নামিয়ে রাখার সময় কালো শার্টের বোতামের ফাঁক দিয়ে জোড়া চাঁদের মতো উঁকি দেওয়া নাতালিয়ার ফর্সা স্তন দুটি দেখছিল ছাত্র-শিক্ষক দুজনই।
এন্টনের অপ্রস্তুত কণ্ঠে খানিকটা অভিমান।
-আমি ততটা কৃপণ নই যতটা অন্য ইউরোপীয় অধ্যাপকেরা হয়ে থাকেন। সে যা-ই হোক তুমি আমাকে সাহায্য করবে কিনা বলো?
-করব তো। আপনাকে তো আমি আগেও অফার করেছি, মেইনে আমার দাদার বাড়িটি প্রায় পরিত্যক্তই পড়ে আছে। বছরে দু-তিন বার আমি এবং আমার বোন ন্যান্সি গিয়ে কিছুদিনের জন্য থাকি। দাদার মৃত্যুর পর আর কেউ যায় না ওখানে।
-কোনো উটকো ঝামেলা নেই তো?
-একদম না। আশেপাশে ২০০ একরের মধ্যে কোনো
বাড়ি-ঘরই নেই। একদিকে চিরহরিৎ পাইনের বন, যে কারণেই জায়গাটির নাম হয়েছে গ্রিনউড। অন্যদিকে বিশাল একটি পন্ড, যার জল সকালে নীল আর বিকেলে কালো। পন্ডের পাড়ে সারি সারি বার্চ, উইলো আর ওক।
-এমন নিরিবিলি কোনো জায়গায়ই যেতে চাই। বলতে পারো, পালাতে চাই।
-জায়গাটা অতটা নিরিবিলি অবশ্য না।
-মানে কী? হৈ-হুল্লোড় আছে? এই যে বললে কোনো বাড়িঘর নেই!
-না না, মানুষের হৈ-হুল্লোড় নেই, তবে সিকাডার অবিরাম ডাকে কান ঝালাপালা হয়ে যায়, আর সকাল-বিকাল পাখিদের তারস্বরে কোরাস তো আছেই। রাতে অবশ্য মাঝে মাঝে নেকড়ের ডাক শোনা যায়।
অধ্যাপকের হাসিতে স্যাটিসফ্যাকশন।
-কবে যাচ্ছেন?
-কালই, সম্ভব হলে ভোরেই।
-ছুটি নিয়েছেন?
-কাউকে জানাতে চাই না। তাহলে আর নিরিবিলি থাকা যাবে না।
-মেইনের স্টেট পুলিশ পরদিনই আমার দাদার বাড়িতে হামলা করে হুলুস্থূল কাণ্ড বাধিয়ে দেবে।
-সেটা অবশ্য ভুল বলোনি। ঠিক আছে, আমার অ্যাপার্টমেন্টে চলো, ছুটির দরখাস্তটা লিখে দিচ্ছি। তুমি সকালে ডিনের অফিসে দিয়ে আসবে।
সকালের রোদ ঠেলে ন্যান্সির ছিয়াত্তর মডেলের হুডখোলা ফোর্ড ব্রঙ্কো ড্রাইভ করছে অ্যাডাম। একটি প্রাচীন, সুদৃশ্য রেইনবো ব্রিজের ওপর দিয়ে পিস্কাতাকুয়া নদীটি অতিক্রম করতেই মেইন স্টেট ওদের স্বাগত জানায়। এন্টনের চোখ মানচিত্রে, গাড়ির হুড খোলা থাকার কারণে ম্যাপটি করতলের নিচে খুব জোর দিয়ে চেপে রাখতে হচ্ছে। দানবীয় হাওয়ায় সেটি পতপত করে উড়ছে। দূরত্বটা অনুমান করে বেশ চেঁচিয়ে বলেন এন্টন, মনে হচ্ছে আরও প্রায় তিন ঘণ্টা লাগবে। অ্যাডামও একই রকম চেঁচিয়ে জবাব দেয়, আশা করছি দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে যাব।
পথে লোকালয়গুলোর নাম পড়তে পড়তে এন্টনের মনে হয় পুরো ইউরোপটাই বুঝি উঠে এসেছে মেইনে। নরওয়ে, প্যারিস, পোল্যান্ডএইসব নাম একেকটা নেইবারহুডের। বিরল বসতি, দূরে দূরে একেকটা বাড়ি। কোনো কোনো বাড়ির সামনে বৃদ্ধ দম্পতি অথবা একা এক বৃদ্ধ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। বার্ধক্যে উপনীত বৃক্ষরাজির মতো মেইন স্টেটও যেন বার্ধক্যে পৌঁছে গেছে। ওরা একটি সার্ভিস সেন্টারে গাড়ি থামাল। উদ্দেশ্য রিফুয়েলিং, তবে এন্টন চাইলে কফি ও ডোনাট পিক করতে পারেন।
আশ্চর্য! এই শহরের তরুণেরা সব গেল কোথায়? দোকানগুলোর বিক্রয়কর্মীদের কারও বয়সই ষাটের নিচে নয়। সাদা পুরুষদের প্রায় সবাই শ্মশ্রæমÐিত। গ্যাস নেওয়ার জন্য যেসব গাড়ি থেমেছে প্রায় সব গাড়িতেই চালক ছাড়া অন্য যাত্রী একটি কুকুর। হাইওয়ে ২৬ থেকে রকি রোড গ্রিনউডের অরণ্যে নেমে গেল। পিচঢালা মসৃণ রাস্তাটি একটি
অর্ধচন্দ্রাকৃতির অর্ধবৃত্ত নির্মাণ করে মাইলখানেক পরেই আবার উঠে এসেছে হাইওয়ে ছাব্বিশে। অর্ধচন্দ্রের পেটে বুঝি কেউ স্ট্যাব করেছে, বেশ কিছু ফুটো দিয়ে নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে নেমে গেছে পাহাড়ে, অরণ্যে, ছোটো ছোটো কাঁচা রাস্তা। সবগুলো রাস্তার লক্ষ্য তীব্র নীল-গোলা জলের ব্রায়ান্ট পন্ড, এবং রাস্তার মাথায় একটি করে বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির দূরত্ব বেশ অনেক, এক বাড়ি থেকে চিৎকার দিলে তা দিঘির নীল জলে প্রতিধ্বনিত হয়ে শূন্য হাতেই ফিরে আসবে, অন্য কোনো বাড়ির দেয়ালে ধাক্কা খাবে না।
-অল সেট প্রফেসর, আসুন বড়ো ওক গাছটার নিচে বসে বিয়ারে চুমুক দিই। অ্যাডামের হাতে দুটি বিয়ারের বোতল, কোনো ব্র্যান্ডের নাম নেই, সাদা লেভেল লাগানো। পায়ের নিচে স্তূপাকার ঝরা পাতা মাড়িয়ে, মর্মর ধ্বনি তুলে শতবর্ষী একটি রেড ওক গাছের নিচে পাতা কাঠের বেঞ্চে গিয়ে বসে ওরা। সামনে ব্রায়ান্ট পন্ড, দুপাশের ঝোপঝাড় ফুঁড়ে দৃষ্টি বরাবর নীল একটি বাতির মতো জ্বলে আছে।
লাল-হলুদ গাছের পাতা টুপটাপ ঝরে পড়ছে, তীব্র আওয়াজ তুলে একটানা ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে। নামহীন বিয়ারের বোতলটি হাতে নিতে নিতে অধ্যাপক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ঠোঁট ভাঁজ করেন।
অ্যাডাম জানায়, নতুন একটি ব্র্যুয়িং ইন্ডাস্ট্রি হয়েছে মেইনে, আমাদের লোকাল বিয়ার। দুয়েক মাসের মধ্যেই অফিসিয়ালি লঞ্চ করবে।
-নাম ঠিক হয়নি?
-হয়েছে, ‘পিক মি’, লঞ্চিং-এর জন্য অপেক্ষা করছে, তাই লেভেল লাগায়নি।
এন্টন আবারও আরও একটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ছুড়ে দেন অ্যাডামের দিকে।
-আমার চাচা ডেভিড গিয়ারির কোম্পানি। পিক মি বিয়ারে চুমুক দিয়ে অ্যাডাম গিয়ারি জানায়, সো অল সেট প্রফেসর। বিয়ারটা শেষ করেই আমি উঠব, এনজয় ইওর স্টে।
-পোস্ট অফিস কত দূরে বললে যেন?
-তিন মাইল, ছোট্ট একটি টাউন, বেথেল। ওখানে গেলেই পে-ফোন পাবেন, কোনো দরকার হলে আমাকে ফোন দেবেন।
গত তিন দিনে কোনো দরকার হয়নি, কিন্তু মনে হচ্ছে আজ দরকার হবে। ঠিক বুঝতে পারছেন না এন্টন। ম্যালেরিয়া কি-না, থেমে থেমেই জ্বরটা আসছে। মধ্যরাত অব্দি আগুন জ্বালিয়ে পুকুর-পাড়ে বসে থেকেছেন, মশার কামড়ও খেয়েছেন, ম্যালেরিয়া হওয়ার আশঙ্কাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শেষ বিকেলের সূর্য লেকের জলে লেপ্টে আছে। সূর্যাস্তের সময় লেকটি অদ্ভুত রূপ ধারণ করে। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, তবুও উঠছেন না এন্টন। সূর্যাস্তটা দেখেই উঠবেন। গাছ থেকে ক্রমাগত পাতা ঝরছে, লাল-হলুদ পাতার সর পড়ে আছে জলাশয়ে এবং সেখানে পড়ন্ত সূর্যের আলো এক অদ্ভুত খেলায় মেতেছে।
আলবেয়ার কাম্যু ঠিকই বলেছেন, হেমন্তে প্রতিটি পাতাই হয়ে ওঠে ফুল। গাছ থেকে দুলতে দুলতে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে ঝরে পড়ছে পাতারা এবং এই পতন এক আপার্থিব মিউজিক তৈরি করেছে সমস্ত বনভ‚মি জুড়ে, সেই সঙ্গে ঝিঁঝি পোকাদের কোরাস। এন্টন ভাবছে পত্রাবলি আর ঝিঁঝি পোকা, কে ভোকালিস্ট আর কে মিউজিশিয়ান এই সন্ধ্যার কনসার্টে? এবং তখনই হঠাৎ ওর মনে হলো পাতাগুলো দুলতে দুলতে মাটিতে পড়েই দুভাগ হয়ে যাচ্ছে, একটি পাতা থেকে তৈরি হচ্ছে দুটি পাতা। একটি লাল এবং অন্যটি হলুদ। এ কারণে ঝরা-পাতাদের মধ্যে লাল-হলুদের এই অদ্ভুত ভারসাম্য।
শুধু তাই না, নতুন সৃষ্টি হওয়া দুটি পাতা দুদিকে ঘুরে শুয়ে পড়ছে মাটিতে। একটির ডাঁট যদি উত্তরমুখী তো অন্যটির দক্ষিণমুখী। এন্টন যখন তন্ময় হয়ে পাতাদের মধ্যে “বেল’স থিওরেম” খুঁজছে ঠিক তখনই কেউ কথা বলে উঠল। এন্টন উৎকর্ণ হয়। এখানে তো কোনো মানুষের কণ্ঠ শুনবার কথা নয়। অ্যাডাম এসেছে? অথবা ওর চাচা ডেভিড? অ্যাডাম বলেছে, ডেভিড কখনো আসে না, অ্যাডাম ছাড়া এখানে আর একজন আসে ন্যান্সি, সঙ্গে ওর বয়ফ্রেন্ড আসতে পারে। কিন্তু ন্যান্সি তো জানেই বাড়িটি এখন খালি নেই।
আবারও, এবার বেশ স্পষ্ট।
কে? কে কথা বলছ?
-আমি।
-আমি কে, নাম বলো, এবং কোথায় তুমি?
-আমার কোনো নাম নেই। আর আমাকে তুমি দেখতেও পাবে না।
-হেঁয়ালি বাদ দাও। সামনে এসো।
-আমি তো তোমার সামনেই আছি। ইন ফ্যাক্ট আমি তোমার পেছনেও আছি, ডানে, বাঁয়ে সবখানেই আছি।
-কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছ না, খুব কাছে থেকেই তা ভেসে আসছে। কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন? জ্বরের কারণে কি আমি দৃষ্টি হারিয়েছি? না, তা কী করে হয়, আমি তো লাল-হলুদ পাতাদের ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। লেকের জলে তরঙ্গ দেখছি, শুভ্র হাঁস দেখছি, ওই তো একটি হাঁস জলের ওপর উঁচু হয়ে ডানা ঝাপ্টাচ্ছে। আকাশ দেখছি, আকাশে উড়ে বেড়ানো পাখি-এমনকি ছোটো ছোটো পাখিদেরও দেখতে পাচ্ছি।
-হা হা হা হা।
-কী ব্যাপার তুমি হাসছ কেন?
-ওই যে বললে, মনে হচ্ছে তুমি মিথ্যা বলছ নাতাই হাসলাম।
-এতে হাসির কী হলো!
-হলো হলো, হাসির অনেক কিছুই হলো। তুমি তা বুঝবে না। কারণ তোমরা, মানুষেরা, প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলে বলেই মিথ্যার সঙ্গে তুলনা করে অমিথ্যাকে মহৎ করে তোলো। আমাদের মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই, তাই এসব শুনলে হাসি পায়।
-‘তোমরা, মানুষেরা’ এর মানে কী? কে তুমি?
-আমি মানুষ নই, শুধু এইটুকু বলতে পারি।
-এলিয়েন?
-যা খুশি একটা নাম দিতে পার।
-তুমি বেশ কায়দা করে আমার চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছ। তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি এবং মনে করিয়ে দিচ্ছি, মানুষই শ্রেষ্ঠ, মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করার সাধ্য কারও নেই।
-হা হা হা হা।
-কী ব্যাপার তুমি আবার হাসছ!
-মানুষের এটিই সবচেয়ে বড়ো মূর্খতা।
-তুমি যেই হও, তুমি কিন্তু আমাকে রাগাচ্ছ, প্রথমে বলেছ মানুষ মিথ্যাবাদী, আবার বলছ মানুষ মূর্খ।
-দুটোই কি ঠিক নয়?
-না, নয়। মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী এবং সবচেয়ে শিক্ষিত। এই পৃথিবী মানুষের নিয়ন্ত্রণে, অন্য কারও ক্ষমতা নেই পৃথিবীকে শাসন করার। মানুষ পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গপথ বানিয়েছে, উড়োজাহাজ বানিয়ে আকাশে উড়েছে, ডুবোজাহাজ বানিয়ে সমুদ্রের তলদেশে গেছে। নদীর ওপরে সেতু নির্মাণ করে এপার-ওপারের যাতায়াত সহজ করেছে। রেশমের সুতা দিয়ে কাপড় বানিয়েছে মানুষ, জল এবং বাতাসের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষই উৎপাদন করেছে বিদ্যুৎ, আর বিদ্যুতের শক্তি দিয়ে জয় করছে সব কিছু। তুমি কে? কোন ধরনের প্রাণী? কী সৃষ্টি করেছ তোমরা?
-শান্ত হও বিজ্ঞানী। একটু স্থির হও। প্রত্যেকে তার নিজস্ব নিয়মে সৃষ্টি করে। তোমরা তোমাদের নিয়মে কর, আমরা আমাদের নিয়মে করি।
-কী সৃষ্টি করেছ তুমি, বা তোমরা? তোমাদের নিজস্ব নিয়মটা কী? তার আগে বলো, তোমাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন?
-আমাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ না এজন্য যে আমার কোনো অবয়ব নেই। আমরা তরঙ্গ দিয়ে তৈরি, আমাদের কোনো অবয়ব নেই। আমাদের দেহ নেই, তাই তোমাদের মতো ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, লোভ-এইসব নেই। আর আমরা কী সৃষ্টি করেছি জানতে চাও?
-হ্যাঁ জানতে চাই।
-তার আগে আমাকে একটা কথা বলো। তোমরা তো এক সময় গরু কিংবা ঘোড়া দিয়ে হাল চাষ করতে, করতে না?
-হ্যাঁ করতাম। এখনো এশিয়ায় এবং আফ্রিকায় অনেকে তা করে।
-যখন ফসল উৎপন্ন হয়, তখন কি তোমরা বলো গরু কিংবা ঘোড়া ফসল উৎপন্ন করেছে?
-এইখানেই তো মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষ অন্য সবাইকে দিয়ে কাজ করাতে পারে। যে কাজ করায়, কৃতিত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তো তারই।
-ঠিক বলেছ। এবার তোমাকে বোঝানো সহজ হবে, আমরা কী সৃষ্টি করেছি। আমরা নিজেরা কিছুই সৃষ্টি করি না। সৃষ্টি করাই। এবং তা করাই তাদের দিয়ে যাদের অবয়ব আছে। একদিন আমাদের ইচ্ছে হলো উড়োজাহাজ বানাব, ব্যস ঢুকে গেলাম দুই ভাই উইলভার এবং ওরভিলের মাথার ভেতর। ওদের মাথায় অ্যারোপ্লেন বানানোর ডিজাইন প্রোগ্রামিং করে দিলাম, ওরা তা বানিয়ে ফেলল। এভাবেই আমরা তোমাদের দিয়ে যখন যা সৃষ্টি করতে ইচ্ছে হয় করিয়ে নেই। তোমরা হচ্ছো আমাদের গরু বা ঘোড়ার মতো।
তুমি কিন্তু আমাকে আবারও রাগাচ্ছ।
-তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। তবে তুমি চেষ্টা করলেও আমাকে রাগাতে পারবে না। কারণ আমাদের কোনো রাগ নেই। যার চাহিদা নেই তার কোনো রাগ থাকে না। ও, ভালো কথা, আমরা শুধু তোমাদের দিয়েই এটা-সেটা বানিয়ে নেই না। সবাইকে দিয়েই বানাই। যেমন-বৃক্ষকে দিয়ে ফল, ফুল ও ফসল ফলাই, পশু-পাখিকে দিয়ে দুধ ও ডিম উৎপাদন করাই। বাতাসকে দিয়ে মাটি থেকে জল তুলে আকাশে নিয়ে যাই আবার সেখান থেকে বৃষ্টি নামাই। আমরা যা খুশি তাই করতে পারি।
-তুমি কি ঈশ্বর?
-তোমাকে তো আগেই বলেছি, যা খুশি নাম দিতে পার।
-শুনেছি ঈশ্বর একজন, যদিও আমার কাছে ওটা মানুষের একটা কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়। ঈশ্বর বলে কিছু নেই। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার নিজস্ব নিয়মে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত। এর কোনো চালক নেই। যাই হোক, আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তোমাদের সংখ্যা কত?
-অগণন। আমাদের গোনা যায় না। তবে আমরা সবাই যুক্ত। বলতে পার আমরা সবাই মিলে একজন, আবার একজন অসংখ্য জনে বিভক্ত।
-আচ্ছা বন্ধু এলিয়েন কিংবা ঈশ্বর, বাই দ্য ওয়ে, তোমাকে বন্ধু বলতে পারি তো?
-যা খুশি তাই বলতে পার। বন্ধু তো একটি ইতিবাচক শব্দ, অবশ্যই বলতে পার।
-মনে হচ্ছে বন্ধু বলাতে তুমি অখুশি হওনি।
-আমরা খুশি কিংবা অখুশি হই না। কী বলতে চাইছিলে তাই বলো।
-তুমি কি সব কিছু জানো? মানে সব জ্ঞান কি তোমাদের কাছে আছে?
-শোনো, মানুষেরা শেখার বিভিন্ন স্তর পার হতে হতে জ্ঞানের পূর্ণতার দিকে যায়। যদিও কেউই পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে না। আমাদের ব্যাপারটা ভিন্ন। আমাদের শুরুটাই হয় পূর্ণতা থেকে। এরপর আমরা পূর্ণতাকে ভাঙি, বিশ্লেষণ করি, আস্তে আস্তে ভগ্নাংশে যাই। সেই অর্থে বলতে পার সব জ্ঞানই আমাদের মধ্যে আছে।
-আচ্ছা, তোমাদের তো দেহ নেই, শিশু অবস্থা থেকে তোমরা বড়ো হও কীভাবে, যৌবন, বার্ধক্য-এই বিষয়গুলো আছে নিশ্চয়ই তোমাদের?
-না, নেই। আমাদের জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আমরা বড়ো হই না, বুড়োও হই না। তবে আবারও বলি, আমরা সংখ্যায় অগণন। একটা মজার কথা তোমাকে বলি।
-বলো।
-তুমি কি জানো, কোনো মানুষ একা জন্মগ্রহণ করে না? সব সময় পৃথিবীতে এক জোড়া শিশু জন্মগ্রহণ করে। তারা হয়তো কেউ কাউকে চেনে না কিন্তু দুজন মিলে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে।
-কী রকম ভারসাম্য?
-ভালো ও মন্দের ভারসাম্য। ধরো একজনের মধ্যে ইতিবাচকতার পাওয়ার +৫। তার যে জোড়া তার মধ্যে ইতিবাচকতার পাওয়ার হবে -৫। মোট ফলাফল হবে শূন্য। মানুষের ভারসাম্য সর্বদা শূন্যে। আমাদেরও জোড়া আছে, তবে আমাদের ভারসাম্য শূন্যে নয়, এক-এ।
-সেটা কী রকম?
-এককভাবে আমরা সবাই ভগ্নাংশ। ধরো আমি যদি দশমিক সাত হই তাহলে আমার জোড়া হবে দশমিক তিন। আমরা দুজনে মিলে ১। আমাদের ভারসাম্য সর্বদা একটি পূর্ণ সংখ্যায় নির্ধারিত। এই পূর্ণ সংখ্যাটিও একটি বৃহৎ পূর্ণ সংখ্যার অতি ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশ, তাই আমরা সবাই সবসময় যুক্ত থাকি।
-মনে হচ্ছে, আমি এই চেয়ার থেকে উঠে ঘরে যেতে পারব না। জ্বর ভীষণ বেড়েছে। তুমি কি আমাকে ঘরে পৌঁছে দিতে পারবে?
-পারব। তবে আমার যেহেতু অবয়ব নেই, আমি তোমাকে ধরে ধরে বা কোলে করে নিয়ে যেতে পারব না। তুমি নিজেই যাতে উঠে যেতে পার সেই ব্যবস্থা করতে পারব। তার আগে তোমাকে একটা সুখবর দেই। তোমার স্ত্রী এলিজাবেথের হাড়ে ব্যথার যে একটা অসুখ ছিল, যার জন্য মাঝে মাঝে জ্বরে কাতরাত...
-থামো থামো...ছিল বলছ কেন? ওটা তো আছে এবং তা কোনোদিনই ভালো হবে না।
-সেটা ভালো হয়ে গেছে।
সেই সন্ধ্যায় এন্টন জেইলিঙ্গার একজন সুস্থ মানুষের মতোই হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেরেন। সারারাত খুব ভালো ঘুম হয়। পরদিন সকালে, ১৯৮২ সালের ৫ অক্টোবর, মঙ্গলবার তিনি বেথেল পোস্ট অফিস থেকে ভিয়েনায় ফোন করে জানতে পারেন মেডিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, তার স্ত্রী এলিজাবেথের রিউমেটিক ফিভার সম্পূর্ণ সেরে গেছে।
৪০ বছর পরে ‘কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট’ প্রমাণ করে ২০২২ সালের ৪ অক্টোবর, মঙ্গলবার, অস্ট্রিয়ান পদার্থবিজ্ঞানী এন্টন জেইলিঙ্গার পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। যৌথভাবে তিনি এই পুরস্কার পান ফরাসি বিজ্ঞানী এলেইন আস্পেক্ট এবং আমেরিকান বিজ্ঞানী জন এফ ক্লজারের সঙ্গে। কোয়ান্টাম এন্টেঙ্গেলমেন্ট হচ্ছে প্রতিটি পার্টিকেলের যমজ আরেকটি আছে এবং এই দুটির মধ্যে যোগাযোগের জন্য কোনো মাধ্যম প্রয়োজন হয় না। কোটি কোটি মাইল দূরে থাকলেও একটি নড়লে অন্যটি সঙ্গে সঙ্গেই একইভাবে নড়বে।