
কবি আল মাহমুদ।
কবি আল মাহমুদ। তার প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই। মৃত্যু ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল এক জ্যোতিষ্ক। স্বর্ণপ্রসবা ছিল তার লেখনী। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন তুলনামূলকভাবে কম। বেশ কম। তবে যা-ই লিখেছেন, তার সবই স্বাতন্ত্র্যম-িত, শৈল্পিক এবং হৃদয়গ্রাহী। তার কবিতার মতোই সেসব লেখা পেলব, মায়াবী, লাবণ্যস্নিগ্ধ এবং মনজাগানিয়া। আপাত নিরাভরণ এসব লেখাজোখার মধ্যে লুকিয়ে আছে শিল্পসুষমা, শাশ্বত সৌন্দর্য ও মহিমা।
এই কবির শিশু-কিশোর রচনাবলিতে রয়েছে মানবিক মূল্যবোধ, গভীর মমতা, প্রকৃতিপ্রিয়তা, নিখাদ দেশপ্রেম। আছে মরমিয়তারও প্রতিফলন বিচ্ছুরণ। শিশু-কিশোর মনস্তত্ত্ব যে কবির পূর্ণ অধিকারে ছিল, তা সহজেই ধরা পড়ে। কবি আল মাহমুদের ‘ছড়াসমগ্র’ নামের গ্রন্থটি বের করেছে অক্ষর প্রকাশনী, ২০১২ সালে। ক্ষীণতনু এ গ্রন্থের কলেবর মাত্র ৫৬ পৃষ্ঠার। এই গ্রন্থের ‘দিনশেষে’ শিরোনামের ছড়াটির উদ্ধৃতি----
আলো আঁধারির খেলায়,
দাঁড়িয়েছি শেষ বেলায়
চোখে মুখে এসে পড়েছে তোমার কেশ
পাখিরা গাইছে বেলা শেষ; খেলা শেষ।
তবু যে কিসের গন্ধে উতলা মন
আমাকে টানছে ইশারায় অনুক্ষণ
আমিও চলেছি প্রবল হাওয়ার ঠেলায়
কোথায় চলেছি অদৃষ্টের কোন মেলায়।
‘একুশের কবিতা’ নামের ছড়াটি বহুল পঠিত, সমাদৃত। উত্তাল অগ্নিক্ষরা সময়কে তিনি ধারণ করেছেন নিপুণ ছন্দে, ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছেন বাঙালির আবেগ, বিদ্রোহ, প্রতিরোধ ও জিগীষাকে। বাঙালির স্বাধীনতাকামী বীর সন্তানদের তিনি স্মরণ করেছেন গভীর বিনম্র কৃতজ্ঞতায়। এই ছোট্ট কিন্তু অতল তাৎপর্যবহ রচনাটি আমাদের চমকে থমকে দেয়। পড়ে আমরা শিহরিত হই, উজ্জীবিত হই। আবেগপ্লাবী এক বোধে সঞ্জীবনী দোলা জাগে পাঠকের রক্তে চেতনায় মননে। এই লেখার পুরো উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করা কঠিন।
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুরবেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে।
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে নাকি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
‘পাখির মতো’ শিরোনামের ছড়ায় কবি হৃদয়ে লালন করেছেন পাখির মতো মুক্ত স্বাধীন হওয়ার স্বপ্ন-বাসনা। কাঁঠালচাঁপা ফুলের মিষ্টি সুবাসে পড়ায় মন বসছে না চঞ্চল এক বালকের। নদীর কাছে থাকতে ইচ্ছে করে, বকুলডালে লুকিয়ে থেকে পাখির মতো ডাকতে সাধ জাগে তার। কবি লিখছেন----
সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়।
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেস্তারা উল্টায়।
তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়বো,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরবো!
তোমরা যখন শিখছো পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি না হয় পাখিই হবো,
পাখির মতো বন্য।
চাকমা মেয়ে রাকমাকে নিয়ে ছড়া লিখেছেন কবি আল মাহমুদ। জুম গিয়েছে ঘুম গিয়েছে, হাঁড়িকুড়ি ডুবে গেছে। কাপ্তাইয়ের ঝিলের জলে ভেসে গেছে জুম। সেই হাহাকার ও মর্মবেদনা ছোট্ট এই ছড়ার ধ্বনিতে উদ্ভাসিত, চিত্রায়িত। বাংলা সনের সূচনা মাস বোশেখ নিয়ে মর্মস্পর্শী লেখা আমাদের সচকিত করে। কবির আর্তি ও আকাক্সক্ষা খুব সহজেই মন কাঁপিয়ে দেয় আমাদের। কবি ফরিয়াদ করছেন, গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী আনন্দ কালবোশেখীর? চাষির ভিটে গুঁড়িয়ে দিয়ে কী ফায়দা? মত্ত ঝড় দুঃখী মায়ের হাঁড়ি উল্টে ফেলে দেয়। বাসা ছিঁড়ে দেয় টুনটুনিদের। সেই বোশেখকে মহা জটিল প্রশ্ন ছুড়ে দেন কবি আল মাহমুদ। কী তার করণীয়, সেটাও বাতলে দেন ছন্দে ছন্দে। তিনি লেখেন----
তবে এমন নিঠুর কেন হলে বাতাস
উড়িয়ে নিলে গরিব চাষির ঘরের খুঁটি
কিন্তু যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে
তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে না তো!
... .... .... ...
ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো তুফান
ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের
পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান
বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেলো।
গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল ঊনসত্তর নিয়ে দুটি ছড়ার কথা সানন্দে উল্লেখ করতে হয়। প্রথম ছড়াটি হচ্ছে----
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
শুয়োরমুখো ট্রাক আসবে
দুয়োর বেঁধে রাখ।
কেন বাঁধবো দোর জানালা
তুলবো কেন খিল?
আসাদ গেছে মিছিল নিয়ে
ফিরবে সে মিছিল।
ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!
ট্রাকের মুখে আগুন দিতে
মতিয়ুরকে ডাক।
কোথায় পাব মতিয়ুরকে
ঘুমিয়ে আছে সে!
তোরাই তবে সোনামানিক
আগুন জ্বেলে দে।
মরমিয়তাকে হালকা স্পর্শ করেছেন কবি আল মাহমুদ। মিস্টিক জগতের আধো আলো আবছা আঁধার তিনি শিল্পীর তুলিতে মূর্ত করে তুলেছেন। ‘একটা পাখি একলা ডাকে’ শিরোনামের ছড়ায় তিনি বলছেন----
একটা পাখি একলা ডাকে একটা গাছে
সে পাখিটার নাম জানি না কোথায় আছে
গানের পাখি প্রাণের পাখি ডাক দিয়েছে
আমি কি আর ফিরতে পারি নিজের কাছে?
উধাও হলো মনটা আমার পাখির ডানায়
উথলে ওঠে সুরের বাটি কানায় কানায়
আমারও তো দিন ফুরালো সন্ধ্যা ঘনায়
কীভাবে দিন কাটিয়ে গেলাম উন্মাদনায়।
কবি আল মাহমুদকে একদা প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হয়েছে? তার উত্তর ছিল : আমি মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব পড়তাম আমি। পড়তে পড়তে একদিন আমার মনে হলো----আচ্ছা আমিও তো এরকম লিখতে পারি। তখন লেখা শুরু করলাম। আশ্চর্য যে, আমার লেখা তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ কাগজগুলো খুবই অনায়াসে ছেপে দিল। প্রশ্ন : সেটা তো বিস্ময়কর। উত্তর : আমার কাছেও বিস্ময়কর।
এই নিবন্ধের শুরুতে বলেছি, শিশু-কিশোরদের জন্য কবি আল মাহমুদ যা লিখেছেন, তা ছিল নিতান্ত অপ্রতুল। এ বিষয়ে খোদ কবির কাছেই অনুযোগ করেছিলাম। আমার প্রশ্ন ছিল : আপনার মায়াবী কলমে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশ কিছু মূল্যবান ফসল ফলেছে। কারও কারও অভিযোগ : আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সময় দেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার বক্তব্য কী হবে?
কবির উত্তর ছিল : হয়তো বা। যারা আমার এ খুঁতটা ধরতে পেরেছে, তারা আমার অনুরাগী। তাদের উচিত ছিল একটা পরামর্শ দেওয়া। কিন্তু তারা তো সেটা করেননি। করা উচিত ছিল। এটা তারা যদি বলে দিতেন, তাহলে আমি সেভাবে চলতাম।