Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

দগ্ধান অথবা একটি না-গল্পের ছায়া

Icon

জোবায়ের মিলন

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৩, ১২:৫৮

দগ্ধান অথবা একটি না-গল্পের ছায়া

গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল

সকালেই গা চুপচুপ করে ঘামছে। শীতের পরপরই এমন গরম আগে পড়েনি। রোদের মুখের দিকে তাকানো আর উনুনের গনগনে আগুনের দিকে তাকানো একই কথা। কাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়া পথচারীরা ধীর, গাছের ছায়ায় ক্লান্ত শরীর থামিয়ে যে-যার মতো। বাতাসের গায়েও কানাবুড়ির চোখ পড়েছে। পাতারা নিশ্চল। শান্ত। লোকেরা হাঁসফাঁস। শিশুরা বিবস্ত্র। ছেলেটা বাড়ি আসার কথা। মাস কয়েক আসি আসি করেও আসে না। এই মাসে না ওই মাসে, এই সপ্তাহে না ওই সপ্তাহে বলে বলে...। ‘এত কাজের চাপ হইলে চলে!’ ফয়জুন্নেসা জাহান ভাবে গৃহস্থালি কর্মের ফাঁকে।

রবু বাড়িতে টাকা পাঠায় রকেটে, না হয় বিকাশে। ওর পুরো নাম রবিউল হোসাইন। মা-খালারা ছোট বেলায় আদর করে ডাকত রবু, সেই থেকে চল হয়ে গেছে নামটা। অসুস্থ বাপ টুকটুক করে গঞ্জে যায়। চোখে ছানি পড়া, হাঁটুতে বাতের ব্যথা, ক্ষয়রোগের প্রাদুর্ভাব। তবু টাকাটা তুলে আনে চাচাতো ভাই-পো সুমিতের দোকানের পাশের ফোনের দোকান থেকে। পা চলে না, হিজিবিজি লাগে সব কিছু, নুয়ে আসা শরীরও কাঁপে বয়সের শাসনে। সুমিতকে বললেই হয়, বাকি কাজটা সেরে দেয় সে নিজের মনে করে। চাচা তো বাপের মতোই। তার ওপর গোষ্ঠীর মুরব্বি, তার ওপর বন্ধুর বাপ। রবুর অনুপস্থিতিতে সুমিতই ক্ষুদ্র কাজগুলো সেরে নির্দ্বিধায়।

রবুই নিষেধ করেছে এবার, ‘কষ্ট করে এই গরমে অত দূরে যাওয়ার দারকার নাই। পথ-ঘাটের যে অবস্থা! নতুন সড়ক, অটোরিকশার দাপট, অদক্ষ ড্রাইভারদেও তপ্ত মেজাজ, কখন কী অয় বলা যায় না। আমিই আসতাছি, দেখা হয়-না অনেক দিন, গরমে গতর পোড়ে, লগে লগে মনটাও পুড়তাছে ক্যান জানি। খরচটাও দিলাম, দেখাও হইল। আর কয়েকটা দিন পরথিকা তো শ্বাস ফেলার সময় থাকব না, ঈদে বেচা-কেনা বাড়ে মা, এই সময়ই কয়েকটা টেকা বেশি কামাই করার সুযোগ আসে, সারা বছর তো আর তেমন অয় না, তার উপর গেল কয়টা বছর তো গেল করুনার থাবায়।’ রবু অনেকবার চেষ্টা করেছে অসুখটাকে ‘করোনা’ বলতে, পারে নাই, এখনো না। তার মুখে আটকে যায়। সঙ্গীরা হাসে, রবুও হাসে, ‘আমি করুনাই কমু, তোরা বুইঝা লাইস।’ বলে উড়িয়ে দেয়। তিন দিন আগে মা ফয়জুন্নেসার সঙ্গে ওই কথার পর বাড়িতে আর কথা হয়নি রবুর।

বাড়ির ঢালের মাচায় লকলকিয়ে বেড়ে ওঠা লাউয়ের কচি পাতা, ডোবার কোণে যত্নহীন জন্মানো কচুর লতি, ক্ষেতের মিষ্টি কুমড়া তুলে এনে কয়েক জাতের মসলা মাখিয়ে তার মধ্যে কাঁচা তিল পুরে এক জাতের শাকের বড়া বানিয়েছে ফয়জুন্নেসা। তেলে ভেজে দিলে এক টানে শেষ করে দেয় একমাত্র ছেলেটা। অভাবের সংসার- বাজারের হালচাল, মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লাগামহীন দর-দাম, ওষুধপাতি- নুন আনতে পানতা ফুরায় তবু খোটের কোণে প্লাস্টিকের ব্যাংকে জমানো অল্প কয়েকটি টাকা খুলে এনে ছেলের জন্য একটা দেশি হাঁসের বাচ্চা কিনে পেঁয়াজ-ভুনা করেছে। সঙ্গে আলু সেদ্ধ গলিয়ে কই মাছের ঝোল। দুই বোন, তিন ভাই জন্মেই মরার পর বেঁচে যাওয়া রবু যখন মাত্র আট কি সাড়ে আট বছরের তখন একবার রবুর সে কী জ্বর! দশ দিন যায়, বারো দিন যায়, পনেরো দিন যায় কোনো সাড়া নেই, শব্দ নেই। খায় না, কথা কয় না, নড়ে না। ডাক্তার, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক কিছু বাকি রইল না। পুরো গাঁয়ের মুখে ভারী মেঘের ছায়া, শঙ্কা। সবাই ভাবল, এই বুঝি বিদায়। ফয়জুন্নেসা রাত-দিন বুক চাপড়িয়ে কাঁদে আর স্মরণ করে নাড় না ছিঁড়তেই গত হওয়া আগের পাঁচ সন্তানের মুখ। রবু ফিরল সতেরো দিন পর। নড়েই বলল, ‘মা আমি হাঁসের গোস্ত দিয়া ভাত খামু। আলুর ঝোলও’- মনে পড়ে তার। চোখ গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা পানি। আঁচলটা টেনে মুছে নেয় ফয়জুন্নেসা। ‘পাগল পোলা’ বলেই পুরনো বাটন মোবাইলটার দিকে তাকায় দুই-তিনবার। একটা তাড়া কাজ করে কোথায় যেন। ‘গাড়িতে উঠেই তো ফোন দেওয়ার কথা।’ কথাটা চোট দেয় ভিতরে। আবার মৃদু খুশির একটা স্রোতও বয়ে যায়, ‘রবু এইবার বাড়িতে আইলে পুবের-পাড়ার নওয়াল মিয়ার ছোডো মাইয়্যাডা তার কেমন লাগে জিগামু। চঞ্চল, চড়ুই পাখির মতো ছটফট করে, পরির লাহান সুন্দর, লিকলিকা; এপাড়া আইলেই ফুফু ফুফু কইরা জান দেয়। ভালোই লাগে। রবুর পছন্দ হইলে দেরি করমু না, তার বাপও পোলার জন্য পছন্দ করছে তারে। নওয়াল মিয়ার লগে কথাও হইছে হালকা। তার চাওন পাওন কিছু নাই। আমগোও চাওন পাওন নাই। কী চাওন যায়, গরিবে গরিবে কার কাছে কী চাইব।’ পাশের ঘর থেকে গলা ছাড়ে অন্য ঘরের জা- মদিনা, ‘বুজি দেইখা যাও কে আইছে....। খেয়াল ভাঙে তার। ফিক করে হেসে পা বাড়ায়।

বিকাল চারটা। মজিদ গাজীর ফোনে একবার, দুইবার, তিনবার...সাতবার কল। সে দিশেহারা, তার হুঁশ নেই। সকাল সাড়ে ছয়টায় বাশিরুলের কল পেয়ে প্রথম জানতে পারে- তার দোকান মার্কেটে আগুন লেগেছে। খবর পেয়ে যখন উদ্ভ্রান্ত  মজিদ গাজী মার্কেটের সামনে এসে আছড়ে পড়ে তখন দেখে, নরকের লাল আগুনের লেলিহান শিখা ততক্ষণে মার্কেটের প্রায় চার হাজার দোকানের সঙ্গে তার চারটা চার পদের দোকানও তিমি মাছের মতো গিলে ফেলছে রাক্ষুসা জিভের টানে। চারপাশে ধোঁয়ার কু-লী, ধোঁয়া আর ধোঁয়া। দাউদাউ জ্বলছে। মানুষে মানুষ। আহাজারি। পাগলপ্রায় অন্য দোকান-মালিকরাও। মজিদ গাজী মূর্ছা যায়। 

দমকলের পানি মাতমা আগুনের কাছে কিছুই না। পড়ার আগেই শুকিয়ে যায়। বাতাসে, তাপেই শুষে নেয় সবটা। কূল-কিনার দেখে না কেউ। বেলা গড়ায়। মজিদ গাজী সামান্য স্থির হলে পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখে রবুর মায়ের নম্বর। রবুর মা! ভাবে রবুর ফোন। ফোনটা পকেটে ঢুকায়। আবার কল ঢোকে। রিসিভ করতেই ‘রবুরে কি ছুটি দেন নাই ভাইসাব? রবুর না দুপুরের মইধ্যে বাড়ি আসপার কথা, ওর ফোন বন্ধ ক্যান? ইস্কুলের ফরিদ মাস্টার কইল, আফনেগো মার্কেটে নাহি আগুন লাগছে! টিভিতেও দেহাইতাছে। রবু কই ভাইসাব....? ‘মুহূর্তে হাত থেকে ছিটকে পড়ে মজিদ গাজীর এনড্রোয়েড ফোনটা। মজিদ গাজীর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে!’...‘ভাইসাব রবু কই, ভাইসাব?’ ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে মধ্যবয়স পেরোনো রবুর মায়ের কম্পিত, আতঙ্কিত স্বর। মজিদ গজীর মাথা চক্কর দিতে থাকে। তার মনে পড়ে তাজরিন ফ্যাশন লিমিটেডের কথা, টাম্পাকো ফয়েলস কারখানার কথা, ১১৭ আর ৪১টি নিথর দেহের কথা। চুড়িহাট্টার কথা, নিমতলীর কথা, আরও আরও...। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসতে থাকে মধ্যবয়স পেরোনো ফয়জুন্নেসা জাহানের একই কণ্ঠস্বর। মজিদ গজীর মাথা আবার চক্কর দেয়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে আবার ভেসে আসে মধ্যবয়স পেরোনো ফয়জুন্নেসা জাহানের কম্পিত কণ্ঠস্বর। আসতেই থাকে। ছাই হতে থাকা মার্কেটের সবদিকে ভিড় করা লাখো মানুষের মাথার উপর দিয়ে, হানিফ ফ্লাইওভার, টেলিফোন ভবন, পুলিশ ভবন, রেলওয়ের পুরনো দালান তারও উপর দিয়ে বাসা ভাঙা পাখির মতো উড়তে থাকে রবুর মায়ের স্বরটা। মজিদ গাজী জানে না, সে কী বলবে এখন?

‘কাকা, সকালে একটু মার কাছে যামু, বাজানের শরীরডাও নাকি খারাপ। চোখে নাকি আগের চেয়ে আরও কম দেহে। ওষুদ লাগব। খোরাকির টেকাডাও দিয়ামু, দেইখাও আমু। চাবিটা রাইখা যায়েন আজকে, দিনের রিপুর কামগুলা রাইত জাইগা সাইরা দোকানেই ঘুমামু। সয়-সকাল উইঠা রওয়ানা দিতে পারমু। তাইলে কাজের হেম্পার হইব না।’ মজিদ গাজী এর চেয়ে বেশি কিছু আর মনে করতে পারে না। আকাশটা আবার পাক খায়। বুকটা মোচড় দেয়। শরীরটা খালি হয়ে আসে। মজিদ গাজী চিৎকার দিয়ে ছোটে তার দোকান বরাবর পোড়া ছাই আর কয়লার দিকে। কয়েকজন আটকায়। পারে না। পারে। মজিদ গাজী দশ আঙুলে ‘রবু...রবুরে...।’ কান্নায় আচড়াতে থাকে তখনো ধোঁয়া ওঠা পোড়া স্তূতের ছাই, কাদা মাটিতে। বাশিরুল জাপটে ধরে রবুর কথা জানতে চায়, মজিদ গাজীর কণ্ঠ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না। ভাঙা কণ্ঠ থেকে ফ্যাসফেস করা কিছু শব্দ শোনা যায়, ‘রবু তো বাড়ি যায় নাইরে বাশিরুল, রবু তো বাড়ি যায় নাই; রাইতে দোকানেই ঘুমাইছিল...।’ 

মজিদ গাজীর মনে পড়ে না তার রক্ত পানি করা চারটি দোকানের কথা, লাখ লাখ টাকা ঋণের কথা, নতুন তোলা কাপড়ের গাঁইটের কথা, সুতার ববিনের কথা, রিপু-মেশিনের কথা, ঠকঠক ঠকঠক শব্দে চলতে থাকা মেশিনের চাকার কথা, অনবরত কান্নায় ফুলে ডোল হয়ে ওঠা চোখের আসমানে কেবল ভাসতে থাকে তেরো বছর ধরে পিতার দোকানের চেয়েও অধিক যতেœ তার দোকানগুলোতে লেগে থাকা, তার দুই সন্তানের চেয়েও বিশ্বস্ত কর্মচারী রবুর জীবন্ত মুখটা। তিন-চারজন দৌড়ে যায় উদ্ধার কর্মীর কাছে, ফায়ারব্রিগেডের সৈনিকের কাছে, তথ্যকেন্দ্রের কাছে, এদিকে-ওদিকে, ‘ভাই, কোনো লাশের সন্ধান আছে? আমগো রবুর?’ আগুনে সবাই পানি ঢালে, সবাই ভেজা, সবাই আতঙ্কে বোবা। একজন অফিসার জানায়, ‘কানো লাশের তথ্য এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।’...শুধু কাঠ, শুধু কয়লা, শুধু অঙ্গার। মানুষের ভিড়।

নড়বড়ে ঘরটার পেছনে একটা বয়স্ক ডুমুর গাছ। তার পাশ ধরে বড় সড়কের দিকে চলে গেছে বাড়ি থেকে নামা চিকন একটা কাঁচা রাস্তা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে, যায়। কেউ গীত গায়, কেউ ছড়া পড়ে, কেউ রহিম-রুব্বান পালার শ্লোকে গলা উচায়, কেউ হালের কোনো সিনেমার গল্প করতে করতে নিজেদের পথে চলতে থাকে পায়ের তলায় ধূলির কণা ফেলে। কেউ সংসারের আলাপ করে, কেউ সঙের। পথ জানে-না কে কোন স্মৃতি ফেলে সামনের দিকে যাচ্ছে, কে কোন স্মৃতির কামড়ে কাতর। এও জানে না, কে কোন দুঃখ-ব্যথা বহন করে হাসি হাসি    ছুটছে----ছুটতে হবে বলে। নাকি পথ জানে সবকিছু? গাছটির নিচে ফয়জুন্নেসা জাহান দাঁড়িয়ে, অপলক; অপেক্ষায়। হাঁসের মাংসের সঙ্গে সেদ্ধ আলুর ঝোল আর কচু শাকের ভেতর তিলে মোড়ানো ভাজা-বড়া হাঁ করা হাঁড়িতে উদাম। রোজই ও-ঘর থেকে প্রায়-অন্ধ, অচল বাপ জমিরউদ্দিন ডাক দেয়, ‘রবু আইছে...রবু? রবু কবে আইব রবুর মা?’ 

আচমকা দমকা হাওয়া। ঘূর্ণিধুলায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫