Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

আরবি ভাষার গল্প

ফসল কাটার রাত

Icon

আহমাদ হাসান আল-যাইয়াত

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২৩, ১৩:১৮

ফসল কাটার রাত

গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল

আহমদ হাসান আল-যাইয়াত (১৮৮৫-১৯৬৮) ছিলেন মিশরসহ সমগ্র আরব বিশ্বের সাংস্কৃতিক নবজাগরণের পুরোধাদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব এবং ‘আর-রিসালাহ’ ম্যাগাজিনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পত্রিকাটিকে ১৯৩০-এর দশকে পুরো আরব বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘বুদ্ধিবৃত্তিক সাপ্তাহিক’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কায়রো এবং প্যারিসে আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করার আগে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। ১৯৩৩ সালে ‘আর-রিসালাহ’ প্রতিষ্ঠার আগে কর্মজীবনের শুরুতে কায়রোর আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাগদাদে তিন বছর আরবি সাহিত্য পড়ান। তারপর ১৯৬০-এর দশকে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসিক পত্রিকা ‘মাজাল্লাত আল আজহারে’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে সাহিত্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত হন মহান এই লেখক। এই লেখক সম্পর্কে আহমাদ তাম্মাম সংক্ষেপে বলেছেন, ‘হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে, মিশর একটি সাহিত্যিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করেছিল। যেখানে সাহিত্যের সমস্ত শিল্প ও চিন্তার রঙ অন্তর্ভুক্ত ছিল। জীবনকে সমৃদ্ধ করেছিল কবিদের স্তম্ভের নক্ষত্রপুঞ্জ, মহান লেখকবৃন্দ, ভাষা, বাগ্মিতা ও অলঙ্কারশাস্ত্রের শাস্ত্রজ্ঞ, বিজ্ঞানী, চিন্তাবিদ, জনসাধারণের পথনির্দেশের নেতা, ধীমান আইনজ্ঞসহ প্রজ্ঞাবানদের বিরাট একটি দল। আহমাদ হাসান যাইয়াত ছিলেন স্বর্ণালি সময়ের সেই নক্ষত্রপুঞ্জের একজন-----আরব শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে বিশিষ্ট এক স্থান গ্রহণ করে আছেন যিনি। তদুপরি বিগত শতাব্দীতে লেখা তাবৎ আরবি সাহিত্যে রচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বইয়ের মধ্যে আছে তার বিখ্যাত দুটি গ্রন্থ : ১.তারিখুল আদাব আল-আরাবি ২. দিফাঅ আনিল বালাগাহ।’ গল্পটি মূল আরবি ভাষা থেকে ভাষান্তর করেছেন- কাউসার মাহমুদ

হে শস্যদানা! বৃদ্ধি করো/আর আমাদের গোলাঘর ভরে দাও
আমার হাত পূর্ণ করেছ তুমি/তোমার করুণা না থাকলে
আমরা চলে যেতাম
হে গৌরবের দীপাধার/আমাদের চোখে তোমার আলো
দিয়ে আলোকিত করো
আমার প্রিয়তমা ও উৎসবকে ডেকেছি আমি/হে প্রভু!
তাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দাও।

শীতল চন্দ্রালোকিত স্নিগ্ধ রাতে আমিনা আল-ওয়াতরির সুমধুর কোমল কণ্ঠে গানের ঐ ‘চরণগুলো’ মৃদু ভেসে আসছিল। তার সমবয়সীরাও তখন কাস্তে হাতে, গমের ডালপালা কাটতে কাটতে তার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিল; যার ফলে গানের সাথে অদ্ভুত এক বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল ।

সে রাত ছিল মে মাসের শেষ এবং জুনের শুরুর দিকে। ফসল পেকেছে এবং তাদের কিছু কিছু শুকিয়ে একে অপরের ওপর ভেঙে পড়েছে; যেন শস্য গাছেরা তার মঞ্জরির (শিস) ভার আর বইতে পারছে না। কৃষাণ-কৃষাণীরা তখন নৈশভোজ করতে সোনালি ক্ষেতের দিকে বেরিয়েছিল। তাদের হাতে ছিল কাঁচি, কাঁধে কাজের পোশাক। আনন্দ ও আকাক্সক্ষার সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত বসন্তের পথে সুমিষ্ট স্বরে গান গেয়ে পথ চলছিল তারা। সে সময় সমস্ত গ্রামটি বুঝি নির্বাপিত হয়ে গিয়েছিল, যেন মৃত্যু তাদের কানে প্রহার করছে। ফলে তারা শুনছিল না কামারশালায় কোনো নৈশালাপ কিংবা টিলার ওপর কোনো কুকুরের ঘেউঘেউ। 

সে দৃশ্য আমাকে সেই রাতে এমনভাবে একা করে দিল, যেমন একজন নিঃসঙ্গ পথচারী দুর্বোধ্য জটিল বন বা প্রশস্ত কবরস্থান থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়।

তাই নিঃসঙ্গতা কাটাতে কাছের একটি ক্ষেতে যাই আমি। জানতাম যে, সে ক্ষেতের ফসল কর্তনকারীদের মধ্যে সুন্দর মুখশ্রী আর সুমধুর কণ্ঠের যুবতী নারীদের গায়িকা ছিল। এরপর শস্যক্ষেতের রাত যখন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং প্রকৃতির শক্তি আমাকে দখল করে নেয়, তখন নিজের ভেতর নতুন এক জগৎ অনুভব করি; পূর্বে কখনোই যা মানুষের দিনে কিংবা গ্রামের রাতে অনুভব করিনি! আকাশে চাঁদটা ছিল অর্ধগোলাকার। সেখান থেকে নরম মৃদু আলো ঝরে পড়ছিল। স্বপ্নের দীপ্তির মতো যা শান্ত, আকাক্সক্ষার স্ফুরণজ্যোতির মতো ফ্যাকাশে, আবার একই সাথে যা পরিখা, বিশ্বাসঘাতকতা ও রাস্তাগুলোকে নির্বাপিত রুপালি রঙে রাঙিয়ে দেয় এবং মার্চের শিশিরস্নাত সুগন্ধি হাওয়া মানুষ, পশুপাখি এবং বৃক্ষরাজির জন্য স্বর্গের স্নিগ্ধতা প্রকাশ করে। অতএব নিষ্ক্রিয় ব্যক্তি পুনরুজ্জীবিত হয়, দুস্থ-দুর্ভাগ্যপীড়িত নতুন প্রশ্বাস নেয় এবং ফসল তোলা হয়। সেই সাথে ভঙ্গুর     তৃণবিশেষ ত্রিপত্রের ওপর ফড়িংয়ের বিচরণ শোনা যায়, খালে গর্তের ভেতর ব্যাঙ ঘ্যাঁঙর ঘ্যাঁঙর করে, ফসলের মাথার ওপর চালকের হাহাকার গুঞ্জিত হয়, কৃষাণীরা গম ক্ষেতে গান গায়, সন্ধ্যার পাখিরা প্রকা- গাছের উঁচুতে উড়ে বেড়ায়, প্রহরী কুকুরেরা শস্য মাড়াইয়ের উঠোনের চারপাশে ঘেউঘেউ করে। যার ফলে এই সবকিছুর সম্মিলিত আশ্চর্য সঙ্গীতধ্বনি আত্মায় এক সন্ত্রস্ততা প্রেরণ করে এবং মনের ওপর কবিতা ছুড়ে দেয়।

এই বিবিধ শব্দ; যা তাদের কর্মচাঞ্চল্যে সাড়া দেয়- তা কিন্তু আমার অনুভূতিকে জাদুমোহিত করার উৎস ছিল না। বরং তার উৎস ছিল সেই গভীর, অতল নীরবতা; যা রাতের জীবনকে আঘাত করে, প্রতিটি ইন্দ্রিয়কে আধিপত্য এবং প্রতিটি আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে কারণে আমরা এই নিস্তব্ধতার গভীরে কোনো প্রতিধ্বনি শুনতে পাই না; তবে মরুর শিশিরের মতো ক্ষীণ কোনো শব্দ কখনো ভেসে আসে। 

নিশাচর এই রাতের মাঝে মন্থর দৃঢ় পদক্ষেপে গম্ভীর ভাবনা ও সূক্ষ্ম অনুভূতি নিয়ে চলছিলাম আমি। তারুণ্যের লঘুত্ব ও শিশুর উল্লাসে দিনের বেলায় নিজের প্রকৃতিতে যা খুঁজে পেতাম তা এখন পাচ্ছিলাম না। যেন এমন যে, রাত- শরীর, চিন্তা ও অনুভূতির ওপর তার ভার ফেলে দেয় এবং প্রশান্তি ও মন্থরতার ওপর বিজয়ী হয়। আর তা এ কারণে যে, গ্রামের সামাজিক পরিবেশ ফসল আহরণের দিনে ফসল কাটার রাত থেকে আলাদা হয়। যেখানে গম কাটার সময় গ্রামবাসীরা কৃতজ্ঞচিত্তে সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে থাকে ও তার স্মরণ করে। কেননা তারা এই পবিত্র শস্যে আল্লাহর অনুগ্রহ গ্রহণ করে-এর দ্বারা দেহকে রক্ষা করে এবং আত্মাকে ধরে রাখে। কাজেই তাদের কাছে এটি জীবনেরই সমার্থক এবং গমের রুটিকে তারা নামকরণ করেছে ‘আইশ’ (জীবন) ও নিঅমাহ (সুখ) বলে। আর তা অর্জনে তারা কামনা করে সম্মান ও পবিত্রতা। এর স্মরণ করেই রিজিক, দান, জাকাত এবং বরকতের কথা উল্লেখ করে তারা।

অন্যদিকে তুলার ফসলের ক্ষেত্রে তাদের গ্রাস করে লোভ ও অহংকারের স্পর্শ। তাই তারা পৃথিবীকে ভালোবাসে, অর্থের লালসা করে, বিনোদন কামনা করে এবং তা স্মৃতিতে রাখে। ফলে সুদ, সম্পদ, প্রচলন, বিবাহ এবং চিন্তার কথাও মনে রাখে তারা।

ক্ষেতের জলচালিত চাকায় শুয়ে ছিলাম আমি, যখন মায়াবিনী আমিনার সুমিষ্ট গলায় গান উচ্চকিত হয়ে ওঠে, যার কথা এ রচনার শুরুতে উল্লেখ করেছিলাম। কৃষাণ-কৃষাণীরা তখন তাদের কাস্তে নিয়ে সারিবদ্ধভাবে হামাগুড়ি দিয়ে ফসলের দিকে এগোয় এবং তাদের পেছনে ফেলে যায় কর্তিত ফসলের সুবিন্যস্ত আঁটি। তারপর মাঝে মাঝে ফিরে এসে মোটা স্তূপ বেঁধে ওগুলো মাড়াইয়ের উঠোনে উটের বহন করে নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করে।

তবে ফসল কাটার রাতে সবচেয়ে অপূর্ব জিনিসটা হলো-বিস্তৃত ফসলি ক্ষেতের দৃশ্য। যখন চাঁদের আলো তাদের হলুদ মঞ্জরির ওপর পতিত হয়, মিশরীয় সৌন্দর্যের শুভ্রতায় তাদের আলোকিত করে। গম ক্ষেতে তরুণ যুবাদের প্রাণবন্ত আড্ডা, যেখানে তাদের হাস্যরস চলে এবং প্রণয়ের কথাবার্তায় তাদের লাজুক ইঙ্গিত বিনিময় হয়। নিকট ও দূর-দূরান্ত থেকে কানে ভেসে আসে মেয়েদের গান আর ছেলেদের বাঁশি। সেই সঙ্গে একজন দক্ষ সঙ্গীতজ্ঞ যা করে না- তারা তা নিজেদের মধ্যে করে।

তারপর তারা এবং যারা ফসল কাটার বিছানায় শেষ প্রহরে ঘুমায়, পবিত্রতার চোখে পরস্পর কথা বলে তারা এবং তাদের স্বপ্নে পুণ্য ও মর্যাদার প্রতিচ্ছবি দেখা দেয়। এরপর ভোর যখন তাদের প্রলম্বিত ঘুমন্ত মুখের ওপর নিঃশ্বাস ফেলে, তারা খালে গিয়ে পবিত্রতা অর্জন করে (অজু) এবং প্রার্থনা (নামাজ) করতে চলে যায়। অতঃপর তারুণ্যের তৎপরতা এবং বিশ্বাসের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি নিয়ে তাদের ফসল কাটার যন্ত্রের কাছে ফিরে আসে।

কখনোই তাদের সঙ্গে কাটানো সে রাতের কথা ভুলব না আমি। 

তারপর এই ঘুম ঘুমালাম, এই ওঠা উঠলাম। এর ফলে হেসে দেওয়া সেই প্রভাতের কোলে দেখলাম, গ্রামের রাস্তা দিয়ে ফসল কর্তনকারীদের জন্য নাশতা বহনকারীরা-সকালের নাশতা নিয়ে যাচ্ছে আর গবাদিপশু চালকরা যাচ্ছে চারণভূমিতে। সেই রাত ও প্রভাতের অপূর্ব সৌন্দর্য থেকে এমন এক আনন্দ পেয়েছি আমি- যে স্মৃতিতে এখনো আমি ধন্য, আমার হৃদয়ে এখনো যা অমলিন এবং এখনো যা কামনা করি আমি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫