
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ফাইল ছবি
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবস আজ শনিবার (২৯ জুলাই)। ১৮৯১ সালের এই দিনে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ব্যাপক। তিনিই প্রথম বাংলাকে আধুনিকতার উপযোগী করেন। এর পূর্বে বাংলা ভাষায় ব্যবহার ছিল মধ্যযুগীয় পর্যায়ে। কিন্তু তিনি বাংলাকে সহজ করে মানুষের কাছে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজ সংস্কারক ও মানবদরদী। তাঁর বিভিন্ন ধরনের লেখার ভেতর মানবতাবাদী বিষয় সুস্পষ্ট। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) বিপুল পান্ডিত্য ও অনমনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তাঁর পান্ডিত্য, ব্যক্তিত্ব ও বিপুল কর্মোদ্যমের উৎস ও চালিকাশক্তি ছিল তাঁর মানবতাবোধ, আদর্শবাদীতা। জীবনব্যাপী সাহিত্য ও কর্মসাধনাকে তিনি নিয়োজিত করেছিলেন মানুষের কল্যাণে। তাঁর সেই সাধনা পরিচালিত হয়েছে-সমাজ, শিক্ষা ও ভাষার সংস্কার ও উন্নতি সাধন পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে। মধ্যযুগীয় রীতি থেকে বেরিয়ে তিনি ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন। ভাষার ভেতর শৃঙ্খলাবোধ আনেন। পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করার জন্য তিনি লেখেন-বর্ণ পরিচয়, বোধোদয়, কথামালা, আখ্যানমঞ্জরী, বেতাল পঞ্চবিংশতি। গদ্যে শৃঙ্খলা, বিন্যাস ও সাহিত্যের বাহন করার জন্য রচনা করেন-শকুন্তলা, সীতার বনবাস, মহাভারত, ভ্রান্তিবিলাস। বলতেই হয় তাঁর কাজ ছিল শিক্ষা নিয়ে।
রাজা রামমোহন রায় শিক্ষা সংস্কারের যে একটি সূচনা করে দিয়েছিলেন সেটা আরও বহুদূর নিয়ে গিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলায় আধুনিক সমাজ তৈরির পথিকৃৎ যদি রাজা রামমোহন রায় হয়ে থাকেন, তাহলে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পেছনে ভিষণভাবে দোষী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামের এই মানুষটি।বাঙালি সমাজ তখন অনেক দিক দিয়েই পিছিয়ে ছিল। ইউরোপে তখন শিক্ষা এবং শিল্পবিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলতে তখন তারা ব্যস্ত। বাংলা তখন ইংরেজদের অধীনে। ইংরেজরা এই দেশের মানুষদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছে এবং বাংলাকে লুটেপুটে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলার মানুষদের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না। এখান থেকে আমরা মনে করতে পারি, একটি দেশ এবং দেশের সমাজের মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো সবকিছুই করে রেখেছিলো ইংরেজরা। এরকম সময় যদি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলার মানুষদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কাজ না করতেন তাহলে আমাদের এই সমাজ শত বছর পিছিয়ে যেত। কেবলমাত্র শিক্ষাখাত সংস্কারের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অতুলনীয় দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা অকল্পনীয়। সেগুলো হতে পারে আলোচনার প্রধান কেন্দ্র। বিদ্যাসাগর ছিলেন একজন বহুভাষাবিদ। বাংলার সমাজের শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি এমনভাবে সাজাতে চেয়েছিলেন যেন বাংলার প্রতিটি মানুষ শিক্ষিত হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালে তিনি সেখানকার প্রশাসন এবং শিক্ষায়তনিক দিকে যেসব পরিবর্তন আনেন সেগুলো তার আগে আর কেউ কখনও করেনি। তার প্রস্তাবিত এবং প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি স্থান পেয়েছে, তা হচ্ছে সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করা। তিনি সংস্কৃত কলেজ সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেন। কোনো ধর্ম, জাতিবিদ্বেষ এবং কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় মতাদর্শের ব্যক্তিত্বের জন্য সেখানে পড়াশোনা করার কিংবা যাওয়ার বাধা ছিল না। উনিশ শতকের সময় বাংলায় এ ধরনের কাজকে নাস্তিকতা বলা হতো। তিনি বহুবিবাহ প্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন। বিদ্যাসাগর শুধু শিক্ষা প্রসারেই সীমাবদ্ধ থাকেননি- তিনি বহুবিবাহ রোধ করার ব্যবস্থা নেন আর প্রচলন করেন বিধবা বিবাহেরও।
নারী শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ আগ্রহ ফলে- তাঁকে কেবল ভাষা-সাহিত্য সংস্কারক হিশেবে না দেখে একজন সমাজ সংস্কারক রূপেই গ্রহণ করি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার এই মহান মানুষটির মানবিক গুণাবলির প্রশংসা করেছেন- ‘মানবিক সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই তিনি বাংলা ভাষার সংস্কার করেন। তাঁর রচনার ভেতর মানবিক প্রেম উজ্জ্বল হয়ে আছে সর্বত্র। কোন বংশ বা গোত্র বড় হতে পারে না, বড় হওয়া উচিত নিজ ব্যক্তিত্বে-নিজ কার্যে, এ সত্যকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এ জন্য তাকে বহু সংগ্রাম করতে হয়েছে, বহু নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। সবশেষেই তিনি জয়ী হয়েছেন কালান্তরে।’ রবি ঠাকুর এ প্রসঙ্গে আরও বলেছেন- ‘আমরা বিদ্যাসাগরকে কেবল বিদ্যা ও দয়ার আঁধার বলিয়া জানি। দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাহার অজেয় পৌরুষ। তাহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব এবং যতই তাহা অনুভব করিব ততই আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ ও বিধাতার উদ্দেশ্য সফল হইবে এবং বিদ্যাসাগরের চরিত্র বাঙালির জাতীয় জীবনে চিরদিনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে।’ বাঙালির এই মহামানবকে আমরা শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি- একজন মুক্তচিন্তক ও শিক্ষা ব্যবস্থার নবতর পথ প্রদর্শক হিসেবেই।