শরফুন্নেসা (আলিবর্দি বেগম): এক বিচক্ষণ ও ইতিবাচক চিন্তার ধারক

নাহিদা আশরাফী
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৩, ১১:২৮

ফাইল ছবি।
হলওয়েল আলিবর্দি বেগম ওরফে শরফুন্নেসা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যা বলেছেন তা আগে শুনি চলুন, তারপর না হয় জানব হলওয়েলকে। ‘a woman whose wisdom, magnanimity, benevolence and every ami-able quality, reflected high honour on her sex and station. She much influenced the UsurperÕs [AlivardiÕs] councils, and was ever consulted by him in every material movement in the state, except when san-guinary and treacherous measures were judged necessary, which he knew she would oppose as she ever condemned them when perpe-trated, however successful.’
সিরাজদ্দৌল্লা যখন কলকাতা দখল করেন, তখন হলওয়েল এবং অন্য কয়েকজন ইংরেজকে বন্দি করে মুর্শিদাবাদ নিয়ে আসেন। শরফুন্নেসার অনুরোধে সিরাজ হলওয়েলসহ অন্যদের মুক্তি দেন। ছাড়া পেয়ে হলওয়েল তার গ্রন্থে বন্দিদের প্রতি শরফুন্নেসার অমায়িক ব্যবহার ও রাজকীয় আচরণের প্রশংসা করতে ভোলেননি। নবাব আলিবর্দি খাঁর রাজত্বের বহু ঐতিহাসিক ঘটনা তার বেগমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। বেগম সাহেবা ছায়ার মতোই তার স্বামীর কর্মের ও সিদ্ধান্তের সহযোগী ছিলেন।
মহারাষ্ট্রীয়দের পথপ্রদর্শক মীর হাবিবের কাছ থেকে রতœপ্রসূ বঙ্গভূমির বিপুল ঐশ্বর্যের কথা শুনে রঘুজি ভোঁসলে ভাস্কর পণ্ডিতকে বঙ্গদেশে পাঠান। এই মহারাষ্ট্র অভিযানের কথা নবাব আলিবর্দির কর্ণগোচর হলে তিনি বর্ধমানের নিকটে তাদের সম্মুখীন হন। এই সময় তার বেগমও তার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। মহারাষ্ট্রীয়রা লুণ্ঠনে ও নানা রকম নির্যাতনে লোকদের বিপর্যস্ত করে তুলেছিল এবং এই কাজে তারা এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে, ‘লণ্ডা নামক যে হাতির ওপর নবাব-বেগম আসীন ছিলেন, সেই হাতিসহ তাকে বন্দি করে নিজেদের শিবিরে নিয়ে যায়। নবাবের জনৈক সৈনিক ওমার খাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মুসাহেব খাঁ এই অবমাননায় মর্মাহত হয়ে বীরবিক্রমে আত্মজীবনের বিনিময়ে বহু কষ্টে বেগমকে উদ্ধার করে, তার মান-মর্যাদা রক্ষা করেন। বালেশ্বরের যুদ্ধক্ষেত্রেও আলিবর্দি খাঁর পাশে সাহেবাকে দেখা যায়। রণকোলাহলের মধ্যে, অগণিত শত্রুর প্রাণহীন দেহ দেখে যে কোমলহৃদয়া নারী আপনাকে প্রকৃতিস্থ রাখতে পারেন-শত্রুশিবিরে বন্দি হয়েও যিনি নিজের শৌর্য ও আত্মগরিমার পরিচয় দিতে পারেন, তিনি যে নারীকুলের শিরোমণি, তা সকলকেই অকুণ্ঠিতচিত্তে স্বীকার করতে হবে। ভাস্কর প-িতের হত্যার পর রঘুজি যখন বিপুল বাহিনী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করেন, সেই সময়ে শমসের, সর্দার প্রভৃতি আফগান সেনাপতিরা মহারাষ্ট্রীয়দের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নবাব আলিবর্দি এই সংবাদ শুনে খুবই বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বেগম সাহেবার কাছে পরামর্শ গ্রহণের জন্য উপস্থিত হলে বেগম সাহেবা সবকিছু শুনে সন্ধির প্রস্তাব করে মোজাফফর আলি ও ফকীর আলি নামক দুজন দূতকে রঘুজির কাছে প্রেরণ করলেন। এদিকে রঘুজিও নানারূপে বিপর্যস্ত হয়ে সন্ধিস্থাপনের ইচ্ছা করছিলেন; কিন্তু গৃহশত্রু মীর হাবিব তাকে বোঝালেন, ‘আর কিছুদিন যুদ্ধ চালালেই আলিবর্দিকে বাধ্য হয়ে সন্ধি সংস্থাপিত করতে হবে। কারণ তার রাজকোষ এখন প্রায় শূন্য; সৈনিকেরা রীতিমতো বেতন না পেয়ে ক্ষুণ্ণ। অসন্তুষ্ট আফগান সামন্তদের মধ্যে শিগগিরই বিদ্রোহ অনল ধূমায়িত হয়ে উঠবে। আমির-ওমরাহরা তার ব্যবহারে প্রীত নয়; এ রকম স্থলে আপনি কেন সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হবেন?’ মীর হাবিবের পরামর্শমতে রঘুজি নবাব বেগমের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেন। রঘুজি তার প্রস্তাব অমান্য করে মীর হাবিবের প্ররোচনায় তিনি মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করতে রওনা দেন। কিন্তু কাটোয়ার যুদ্ধে রঘুজি আলিবর্দির হাতে পরাজিত হন। এই সময়ে আফগান সামন্তবর্গ নবাবকে বড়োই বিপন্ন করে তুলল। তারা কৌশলে নবাবের জামাতা জৈনুদ্দীনকে হত্যা করে তার পত্নী আমিনা বেগমকে আবদ্ধ করে রাখে। এই আকস্মিক বিপদে আলিবর্দি অধীর হয়ে পড়লেন। কিন্তু ধীর প্রকৃতির বেগম সাহেবা আমিনার উদ্ধারের জন্য ও উদ্ধতপ্রকৃতির আফগানদের সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সৈন্য-সামন্ত নিয়ে নবাবকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দিলেন। এ যুদ্ধের পরিণাম- আমিনার উদ্ধার ও আফগানসামন্তবর্গের বশ্যতা-স্বীকার।
রাজকার্যের যে কোনো সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, জৈনুদ্দীনের মৃত্যুর পর নবাব আলিবর্দি জামাতা সৈয়দ আহম্মদকে পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করলে আলিবর্দি বেগম তাতে বিশেষ আপত্তি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি স্বামীকে বোঝালেন, ‘পাটনা বাংলার প্রবেশদ্বার। এর শাসনকর্তার সঙ্গে ঐক্য না থাকলে, কারও কখনো বাংলায় প্রবেশ করার উপায় নেই। অতএব কোনো উপযুক্ত লোককে এ রকম স্থানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা উচিত, সৈয়দ আহম্মদের ন্যায় লোকের হাতে দেওয়া কোনোমতেই যুক্তিযুক্ত নয়।’ বেগম আরও বললেন, ‘তার অন্যতম জামাতা নওয়াজিশ মহম্মদ সে রকম সুচতুর ও ক্ষমতাশালী নয়। আমার মনে হয়, সৈয়দ আহম্মদ নবাবের মৃত্যুর পর নিশ্চয়ই তার কন্যাদের, এমনকি দৌহিত্র সিরাজ ও ইকরামুদ্দৌলার প্রধান শত্রু হয়ে উঠবে।’ বেগম কেবল এই বলেই ক্ষান্ত হননি, তারই পরামর্শে সিরাজ প্রকাশ্যে নবাবকে জানালেন যে যদি তিনি তাকে তার পৈতৃক সিংহাসন বিহার প্রদেশ অর্পণ না করেন, তা হলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। অবশেষে সৈয়দ আহমেদকে সরিয়ে সিরাজকেই বিহারের ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ করা হলো।
এদিকে আবার সুচরিত্রা বেগম সাহেবা হোসেন কুলির সঙ্গে ঘসেটি ও আমিনা বেগমের অবৈধ প্রণয় দেখে মর্মাহত হলেন। তিনি যখন কন্যাদের বুঝিয়েও পাপমার্গ থেকে সুপথে আনতে পারলেন না এবং রূপোন্মত্ত হোসেন কুলিকেও ঘসেটি ও আমিনার কাছ থেকে দূরে রাখতে অকৃতকার্য হলেন, তখন আলিবর্দির কাছে সব কুকর্মের হোতা হোসেন কুলি খানকে চিরতরে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেওয়ার ফরিয়াদ জানালেন। তিনি বুঝেছিলেন, যেহেতু হোসেন কুলি খান নওয়াজিশ মোহাম্মদের কর্মচারী ও ঘনিষ্ঠ, সেহেতু নওয়াজিশের অনুমতি ছাড়া কিছুই করা সম্ভব নয়। তিনি নওয়াজিশের অনুমোদন আদায় করলেন এবং সিরাজকে দায়িত্ব দিলেন হোসেন কুলিকে হত্যা করার।
পলাশীর যুদ্ধাবসানে সিরাজের হত্যাকা- সাধিত হওয়ার পর মীরজাফরের পুত্র মীরন আলিবর্দি বেগম, তার দুকন্যা ঘসেটি ও আমিনা, সিরাজপত্নী লুৎফুন্নিসা ও তার শিশুকন্যাকে বন্দি করে ঢাকায় প্রেরণ করেন এবং তাদের গোপনে হত্যা করার জন্য সেখানকার শাসনকর্তা জেসারৎ খাঁর ওপর পরোয়ানা পাঠান; কিন্তু সদাশয় শাসনকর্তা এ কাজে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে মীরন তার একজন বন্ধুর প্রতি এই কাজের ভার অর্পণ করেন। যতদূর জানা যায় ক্লাইভের হস্তক্ষেপে আলিবর্দি বেগম এবং আরও কয়েকজন কোনোরকমে মুর্শিদাবাদ ফিরে আসতে পেরেছিলেন। শেষ জীবন সামান্য মাসোহারায় এক কঠিন ও অসহায় জীবন যাপন করে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এখনো মুর্শিদাবাদের দেয়ালে দেয়ালে কান পাতলে- একজন ধর্মপরায়ণ, সাহসী, বিজ্ঞ, প্রজাবৎসল আলিবর্দি বেগমের গল্প শোনা যায়...