
প্রতীকী ছবি
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যুবকটির মাথাটাও আকাশের মতোই ফাঁকা ও শূন্য। বেলা দ্বিপ্রহর, বাজার সয়লাব পৃথিবীর দণ্ডায়মান দুপেয়ে প্রাণীতে।
মস্ত বড় অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় কৃমি এবং তার প্রতিকারের দাওয়াই নিয়ে একজন ‘হেকিম’ তার পসরা নিয়ে বসে আছেন। তার চারপাশে মানুষের জটলার তুলনায় যুবকটির চারপাশে মানুষের সংখ্যা অধিক। সে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে আর আকাশ তার দিকে। মুখোমুখি। তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে মানুষের বাচ্চারা। আরও আছে কুকুর মাছি থুথু বৈশাখ মাস। দূর থেকে ভেসে আসছে জলে ভেজা মাটির স্বাদ। একজন বাজারের থলে হাতে বাড়ি ফেরার পথে যুবকটিকে দেখে দাঁড়িয়ে গেছেন। তারপর তিনিও তাকালেন আকাশের দিকে। কিন্তু আকাশ তাকায়নি তার দিকে। আকাশ তাকিয়ে আছে যুবকের দিকে। যুবক তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। যুবকটি যেদিন বাড়ি থেকে বেরোয়, সেদিন মাকে শুধু বলেছিল-
“মা, গেলাম।”
এই বলে সে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে কাঁধেঝোলাব্যাগ। ব্যাগে স্কেচখাতা তুলি রঙ। সে মানুষের মুখ আঁকবে। শুধু মুখ। এরপর বিড়ালটার সঙ্গে ভাব জমলে সে বেড়ালেরও মুখ আঁকে। আহা! কী চমৎকার মুখ। দিনের পর দিন সে আর বিড়ালটি কেবল এই আঁকা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। তারপর সে বিড়ালটিকে বলত-
“এই মুখ, বাস্তবের তোর থেকেও সুন্দর।”
বেড়ালের প্রথম প্রথম মন্দ লাগলেও পরে, সে-ও যুবকটির মতের সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। সে বিশ্বাসী হয়ে উঠতে শুরু করে। সে-ও বলতে শুরু করে-
“আঁকা মুখটি বাস্তবের আমার মুখের চেয়েও বেশি সুন্দর!”
দূর থেকে ভেসে আসছে জলে ভেজা মাটির স্বাদ। অশ্বত্থের পাতাগুলো আস্তে আস্তে দুলতে থাকে। একজন বলে ওঠে-
“এই শূকরপুত্র! তোর মার বিয়া নি?”
সময় এভাবেই চলতে থাকে। কখনো কখনো থেমে পড়ে। তখন? তখন, যুবকটিও থেমে যায়। এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকায়। আকাশও তাকায় তার দিকে। মুখোমুখি।
“এই, নাহিদ! নাহিদ! কী করিস এখানে?”
যুবকটি শুনতে পায় না কিছুই। সে কেবল তাকিয়ে থাকে, মুখ তুলে। প্রথম যেদিন এই শহরে আসে নাহিদ; সে নূপুরকে ফোন দিয়ে বলেছিল, “এখানে মান্দার ফুলের গাছ আছে, নূপুর!” তারপর আর নূপুরের সঙ্গে কথা হয় না নাহিদের। নাহিদের সঙ্গে কথা হয় না নূপুরের। আমরা জানতে পারি, নাহিদ একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে মাস্টারি করে। আর ছবি আঁকে। মুখের ছবি। মানুষের আর বিড়ালের। দোতলার ডান দিকের অ্যাপার্টমেন্টটি দক্ষিণ দিকে তাকানো। নাহিদ প্রথম যেদিন এই বাসাটায় ওঠে, তখন চারপাশ অন্ধকার। দরজা খুলতেই বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। কার বাড়ি? কে জানে! সে তার কাঁধেঝোলাব্যাগখানা কাঁধে নিয়েই মেঝেতে বসে ছিল অনেকক্ষণ। অন্ধকারে। কালি মাখানো অন্ধকারে। বিদ্যুৎ আসতেই সে দেখে একটি বিড়াল। তাকিয়ে আছে তার দিকে। নাহিদ চমকায়নি। স্বাভাবিকভাবেই এগিয়ে গিয়েছে রান্নাঘরের দিকে। দেখে নিল সব। ঠিকঠাকই আছে। কেবল চুলা বসানোর জায়গাটি বাদে। একদম জানালা বরাবর। বখাটে হাওয়া আগুনের সামনে শিস বাজাবে। সময়ে-অসময়ে। আগুন লজ্জা পাবে। পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইবে! কিন্তু... থেমে যাবে। না চাইলেও।
নাহিদ বাঁশি বাজায়। আর বিড়ালটি শোনে। বিড়ালটি গুনগুনিয়ে লেজ দোলায়। আর নাহিদ বাঁশি বাজায়। কতক্ষণ ধরে বাঁশি বাজাচ্ছে নাহিদ? কে জানে!
“ফরহাদ! আপনি কতক্ষণ বাজাতে পারেন, একটানা?”
“আমি তো বাঁশি বাজাই না। বাজাতে জানিও না।”
নাহিদ আর কথা বাড়ায় না। মাঝে মাঝে কথা বাড়াতে ইচ্ছে করে না তার। ইচ্ছে করে চুপচাপ নিজের কাছে ধরা দিতে। এবং ধরা দেয়ও। তারপর প্রশ্ন করতে থাকে নিজেকে। একের পর এক। ব্যথা (শারীরিক এবং মানসিক) ও ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্ক কী? ব্যথার অনুভূতি না হলে কি মানুষ ঈশ্বরকে খুঁজত? অথবা মানুষ না মারা গেলে? তখনো কি খুঁজত ঈশ্বরকে মানুষ? আচ্ছা, মানুষ মারা যায় কেন? মৃত্যু সবসময় স্বাভাবিকভাবে আসলে কী হতো? আর, হত্যা কি যে কেউ করতে পারে!
“ফরহাদ! আপনাকে যদি বলা হয়, একটি নির্দিষ্ট লোককে হত্যা করলেই কেবল আপনি জীবিত থাকতে পারবেন; নয়তো আপনাকে হত্যা করা হবে! তখন কি আপনি হত্যা করবেন?”
“না।”
“নিজের জীবন বাঁচাতে চান না আপনি?”
“অবশ্যই।”
“তাহলে।”
“হত্যা করব না।”
নাহিদের ফোন বাজতে শুরু করে। অপরিচিত নাম্বার। সে ফোনটা গ্রহণ করে বলে, “কে?”
“আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।” একটি নারী কণ্ঠ বলে।
নাহিদের কাছে অস্পষ্ট ঠেকে ব্যাপারটা। না চিনেও সে কেন দেখা করবে?
“দয়া করে মানা করবেন না।” অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে।
কণ্ঠের মধ্যে কেমন একটা নতুন নতুন আর আনকোরা গন্ধ আছে। যেন নারী কণ্ঠটি মাত্রই এই ভাষাটায় হাঁটতে শিখেছে। খুব সাবধানে গোল গোল করে উচ্চারণ করছে শব্দগুলো। তারপর একটা বাক্য শেষ হওয়ার পরও যেন কিছু থেকে যাচ্ছে। কানের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে বাক্যগুলো, শোনার পর। শব্দগুলো ঘুরছে গোল গোল করে। আর এতে করে দেখা করবার বাসনা তৈরি হচ্ছে! বাসনা কেন জন্ম নেয় মানুষের মনে? নারী কণ্ঠ বলেই কি এমন হচ্ছে! নাকি তার উচ্চারণে আনকোরা স্বাদ আছে বলে। এই আনকোরা স্বাদটা এমন, যেমন একটা মানব শিশু নতুন নতুন শেখা শব্দ দিয়ে তার আশেপাশের মানুষের মধ্যে তার প্রতি একটা বাসনা তৈরি করে রাখে, তেমন।
“কোথায় দেখা করতে চান?”
“পৌরপার্কে; অশ্বত্থ গাছের নিচে, চায়ের দোকানটায়।”
“কখন?”
“আগামীকাল। বিকাল পাঁচটায়।”
“ঠিক আছে। কিন্তু আপনাকে...”
“আমি আপনাকে চিনি। আপনি আসলেই হবে। আমি খুঁজে নেব।”
ফোনটা কেটে দিয়েছে সে।
“সে আমাকে চেনে। আমাকে চেনে। আমাকে।” কথাগুলো ভোঁ ভোঁ করছে নাহিদের মাথায়। নাহিদ কতজনকে চেনে এই পৃথিবীতে? কতজন?
“ফরহাদ! আপনি কতজনকে চেনেন?”
“কখনো গুনে দেখিনি তো!”
“মানুষকে কখনো চেনা যায়?”
“না।”
“তাহলে?”
“পরিচিত হওয়া যায়, বড়জোর। এর বেশি কিছু হওয়া যায় কি না, জানি না।”
নাহিদ পরদিন পাঁচটায় অশ্বত্থ গাছের নিচে চায়ের দোকানটায় উপস্থিত থাকে। দোকানের ঘরটা ছোট। তবে চারপাশে বেশ জায়গা আছে তার দখলে। সেখানে বাঁশের তৈরি টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। এই পেতে রাখা টেবিল আর বেঞ্চের ওপর ছায়া পড়ছে অশ্বত্থ বৃক্ষের। একবার নাহিদের সঙ্গে এক তরুণীর ঝগড়া হয়েছিল ভীষণ। গাছটি কি অশ্বত্থ নাকি পাকুড়, এই নিয়ে। তরুণীটি হেরে যায়। পরাজিত তরুণীর মুখ সত্যিই বড্ড করুণ। একটা কুকুর কিছুটা দূরে বসে ঝিমুচ্ছে। দোকানটা এখনো প্রায় ফাঁকাই আছে। শুধু একজন বসে বসে দুধ-চা খাচ্ছে। নাহিদ দোকানিকে চায়ের কথা বলবে কি না ভাবছে। এমন সময় শাড়ি পরা এক তরুণী তার সামনে এসে দাঁড়ায়। এবং কিছু না বলেই বসে পড়ে।
“কেমন আছেন?” তরুণীটি জিজ্ঞেস করে।
“ভালো”, নাহিদ বলে। আর জিজ্ঞেস করে-
“আপনিই...?”
“হ্যাঁ।”
তার কণ্ঠে কোনো জড়তা নেই এখন। ফোনে যেমনটা লাগছিল। মনে হচ্ছে সে খুব পরিণত এখন। তার চেহারার মতোই। নাহিদ মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। খুব পরিচিত; তবে অচেনা। নিশ্চিতভাবেই। বারবার মনে হচ্ছে, অনেক আগের হারিয়ে যাওয়া কেউ। যে হারিয়ে গেছে বলে জানে। তবে তার মুখ ভুলে গেছে। কোনো কিছু ভুলে যাওয়া মানুষের সহজাত স্বভাব। সে ভুলে যায় বলেই সে মানুষ। নাহিদের বিড়ালটি যে হারিয়ে গেছে, সে কি তা ভুলে গেছে?
“না।”
তাহলে নাহিদ কি মানুষ না?
“ফরহাদ! আপনার কী মনে হয়?”
“অবশ্যই সে মানুষ। ভুলে গেলেও কিছু কিছু ব্যাপার পুরোপুরি ভোলা হয়ে ওঠে না।”
নাহিদ আবার মেয়েটির দিকে তাকায়।
“আপনি কেন দেখা করতে চেয়েছেন আমার সঙ্গে?”
“আপনার বিড়ালটা কোথায় আমি জানি!”
নাহিদের বিড়াল! হারিয়ে গিয়েছিল। আর তার খবর এই তরুণীটি জানে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে নাহিদ আর বিড়ালটিকে দেখতে পায় না। এমন না যে, সে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল বা এমন না যে, বিড়ালটি অদৃশ্য হওয়ার জাদুবিদ্যা শিখে নিয়েছিল। সে কেবল দেখতে পায়নি বিড়ালটিকে। ভেবেছিল ফিরে আসবে। ফিরে আসলে আবার একসঙ্গে এঁকে রাখা বিড়ালমুখটি দেখবে। তবে সে আর ফিরে আসেনি। নাহিদ অপেক্ষা করেছিল। অপেক্ষা করেছিল দিন রাত আর দুপুর। এবং সপ্তাহ মাস আর বছর। আসেনি। এরপর এই তরুণী মেয়েটি এসে বলছে, সে জানে।
“কোথায় আছে সে?”
“বলব। তবে আমার কথা আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
“বিশ্বাস! শব্দটি খুব ক্লিশে নয় কি? আর মুখে বলে ফেললাম কিন্তু আমার আচরণ ভিন্ন কিছু করছে। তখন?”
“সেটা দেখা যাবে। আগে আপনি আমার কথা মন দিয়ে শুনুন।”
মেয়েটা নাহিদের দিকে আরও ঝুঁকে আসে। চোখ দুটো আরও গোল করে, নিচু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, “আমিই সেই বিড়াল।” তারপর আবার তার আসনে ফিরে যায় এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে থাকে। আর এদিকে নাহিদের অবস্থা অনেকটা ব্যাখ্যার অতীত। সে মুহূর্তে হাজার ফুট উচ্চতায় উঠে যায়, আবার নেমে পড়ে মুহূর্তে। গলা শুকিয়ে আসে এবং শুকনো কণ্ঠে বলে, “কী!”
“আমিই সেই হারিয়ে যাওয়া বিড়াল।” মেয়েটি আবার বলে।
“যার আঁকা মুখের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাকিয়ে থাকতাম আমরা। আপনি বলতেন, আঁকা মুখখানি বাস্তবের আমার মুখের থেকেও বেশি সুন্দর।” মেয়েটি বলে চলে।
কথাগুলো বলতে গিয়ে মেয়েটা যেন লজ্জা পাচ্ছে। আর তার ঠোঁটের ডানদিকের কোনাটায় আলতো করে ঝুলে আছে এক টুকরো মৃদুমন্দ হাসি। নাহিদ ভলো করে তাকায় মেয়েটির দিকে। কোমল। আর নিষ্পাপ। দেওতারা ফুলের রঙে গড়ন। দুলছে। বাতাসে। আলুথালু চুল। মনেই হয় না মশকরা করছে মেয়েটি। উল্টো একধরনের পবিত্রভাব জন্মাচ্ছে আত্মায়। ইচ্ছে জাগছে এই মুখটা আঁকি। শর্ষে ফুলের রঙে।
“মশকরা নয়। সত্যিই।” মেয়েটা বলে।
“আমি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছি আপনার সঙ্গে দেখা করব বলে। আমি মানুষ হয়ে ওঠার পর সবকিছু কেমন বদলে যেতে লাগল। যে খাবারে একসময় মুখে জল আসত; তা এখন আবর্জনা মনে হয়। প্রথম প্রথম ঠিকমতো দাঁড়াতে পারতাম না। দাঁড়ানো শেখার পর হাঁটতে পারি না। মুখের মধ্যে শব্দেরা জড়িয়ে যেত। এক মুহূর্তে পরিবারহীন হয়ে গেলাম আমি। না। আমার বন্ধুবান্ধবও কেউ ছিল না। যদিও এসব বিচ্ছেদে বিপন্ন বোধ করিনি। হাহাকার জাগত কেবল আপনার থেকে দূরে আছি বলে। সবকিছুই সয়ে আসছিল। শুধু সয়ে আসছিল না আপনার থেকে দূরে থাকা।
আর আমার আগের মুখের আঁকা মুখটির দিকে দুজনের একসঙ্গে চেয়ে থাকা। আমার কানে সারাক্ষণই আপনার বাঁশি বাজানোর সুর গুনগুনাত। মনে মনে বলতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। আবার আমি বিড়াল হয়ে যাব। তখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আর বাধবে না আমার।” মেয়েটি বলে চলে।
নাহিদ বিহ্বলতায় ডুবে যায়। এমন অভিজ্ঞতা নাহিদের কেন হচ্ছে? যে অভিজ্ঞতা সামলাতে গিয়ে সে দুভাগ হয়ে হচ্ছে। নাহিদের বারবার বিড়ালমুখটি মনে পড়ছে। কোনো-একটা সাদৃশ্য খোঁজার চেষ্টা করছে। পারছে না। এটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে! বিড়াল... মানুষ... মানুষ/বিড়াল! ধুর্!
“আপনি আসলে কে?”
“বলেছি একবার।”
“আমি সত্যি সত্যিই জানতে চাচ্ছি।”
“আমিও সত্যি সত্যিই বলছি।”
নাহিদ চুপ হয়ে যায়। এই পৃথিবীর সমস্ত চরাচর তার চোখের সামনে ভেসে আসে। বিস্তীর্ণ প্রান্তর। ধীরে ধীরে এই প্রান্তর ভরে উঠছে মানুষে। এই সকল মানুষের ভিড়ে একটি মাত্র তরুণীকেই কেবল নাহিদ চিনতে পারছে, আর সে তার সামনে বসে আছে।
“একবার আপনি আমাকে স্নানের ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তখন আমি বিড়াল। আপনার কোমরের ডানদিকে একটা জন্মদাগ রয়েছে। আর আপনার নাভির পাশে একটা তিল আছে।” মেয়েটি বলে।
নাহিদ চুপচাপ তার কথাগুলো শোনে। কথাগুলো নাহিদকে মেয়েটির দিকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। সে আর কী জানে?
একটা চড়ুই একটু দূরে নড়াচড়া করছিল। খাবার খুঁজছে। মেয়েটি সেদিকে তাকায়। নাহিদ তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে, মেয়েটি চড়ুইয়ের দিকে। এই সঘন তাকিয়ে থাকার মুহূর্তে তরুণী মেয়েটি বলে, “আমরা এক থালাতেই খাবার খেতাম; যখন বিড়াল ছিলাম আমি!”
কথাটা বলতে বলতে সে ঘাড় ঘুরিয়ে নাহিদের দিকে মুখ ফেরায়।
“সে ঠিকই বলছে।” ফরহাদ বলে।
“আমি শুরু থেকেই জানতাম, সে-ই বিড়ালটি। যে এখন তরুণী হয়ে উঠেছে।” ফরহাদ আবার বলে।
নাহিদের মনে হচ্ছে সে জ্ঞান হারাবে। ফরহাদ কি এটা বুঝতে পারছে? নাকি ফরহাদের এটা বুঝার ক্ষমতাই নাই? চায়ের দোকানটা মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায় নাহিদের মাথা থেকে। এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ডভাবে ঘুরতে থাকে সে। এ যেন এক অন্তহীন ঘূর্ণন। নাহিদ ঘুরছে, মেয়েটিও ঘুরছে, প্রবল গতিতে; কেবল ফরহাদকে দেখা যাচ্ছে না। তার কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, “আমি আগে থেকেই জানতাম, সে-ই বিড়াল”, “আমি আগে থেকেই জানতাম, সে-ই বিড়াল”, “আমি আগে থেকেই...”
“ফরহাদ! আপনি কোথায়?” নাহিদ চিৎকার করে। “ফরহাদ! আপনি কোথায়? ফরহাদ! আপনি...” নাহিদ চিৎকার করতেই থাকে।
নাহিদ তার বিছানায় শুয়ে আছে। তরুণী মেয়েটি তার পাশে বসা। নাহিদের চোখ এখনো বন্ধ। রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন ছুটে যাচ্ছে। মেয়েটি নাহিদের মুখের দিকে ঝুঁকে আসে। তাকায় সে। মুখের দিকে। আগে কখনো এভাবে তাকায়নি; যখন বিড়াল ছিল। সে তাকিয়ে থেকে দেখে- দেখতেই থাকে। নাহিদের চোখগুলো ছোট। বকুলের শুকনো বীজ যেন। তার ঘুমন্ত চোখের পাপড়ি দুটো কাঁপছে। নাহিদ কি স্বপ্ন দেখছে? কী স্বপ্ন দেখছে সে?
আমরা দেখি নাহিদ বিছানায়। মেয়েটি তার মুখের ওপর ঝুঁকে আছে। আর এদিকে নাহিদ নিজেকে দেখে এক খোলা প্রান্তরে। সে দৌড়াচ্ছে। প্রথমে সে বুঝতে পারে না। তারপর দেখে তার পেছন পেছন আরেকজন দৌড়াচ্ছে।
“দৌড়াচ্ছি কেন আমি?” নিজেকে প্রশ্ন করে নাহিদ।
“আমার পেছনেই-বা দৌড়াচ্ছে কে? কী চায় সে?” আবার প্রশ্ন করে নিজেকে।
হঠাৎ নাহিদের শরীর কেঁপে ওঠে। সে বুঝতে পারে তার পেছনে কে।- মা! তার মা দৌড়াচ্ছে তার পেছন পেছন। সে থামতে চাইছে, পারছে না। তার ভয় বাড়ছে। ভয় পাচ্ছে কেন সে? “মা!” চিৎকার দিতে গিয়ে দেখে তার কণ্ঠ উবে গেছে। কোনো শব্দ তার কণ্ঠ খুঁজে পায় না। সে খুঁজতে থাকে। শব্দদের। পাচ্ছে না। সে এবার মায়ের মুখটা খুঁজতে থাকে, তার চোখের মধ্যে। ঐ তো মায়ের মুখ! হ্যাঁ; মায়ের মুখ। না! মা না। এ তো দেখি ফরহাদ!
“ফরহাদ! আপনি কোত্থেকে?” নাহিদ জিজ্ঞেস করে। এবং বুঝতে পারে তার কণ্ঠে শব্দরা ফিরে এসেছে।
“আমি এখানেই ছিলাম”, ফরহাদ উত্তর দেয়।
“আমি সবসময় এখানেই থাকি”, ফরহাদ আবার উত্তর দেয়।
নাহিদ এখন আর দৌড়াচ্ছে না। সে বসে আছে। একটি জলাশয়ের ধারে। তার বিপরীত দিকে ফরহাদ। সে-ও বসে আছে। মাঝখানে একটি লাল শাপলা ফুটে আছে। জলের মধ্যে। মৃদু হাওয়ায়, কাঁপছে। জল ও শাপলা।
-ফরহাদ! আপনি কীভাবে বুঝলেন, সে-ই বিড়াল?
-বুঝিনি তো! জানতাম। আমি জানতাম, সে-ই বিড়াল।
-কীভাবে জানতেন?
-জানতাম। বলে চোখ বন্ধ করে ফেলে ফরহাদ।
নাহিদ এবার নিজের মধ্যে ডুব দেয়। প্রশ্ন করে নিজেকে। মেয়েটি কি এখন আমার সঙ্গে থাকবে? বিড়াল অবস্থায় যেভাবে থাকত? কিন্তু বিড়াল আর মানুষ কি একই প্রতিবেশে থাকতে পারে? না! আবার যদি সে হয় তরুণী, তাহলে আরও না। কিন্তু কেন? দুটোই প্রাণ। পাশাপাশি দুটো প্রাণ থাকবে, ঝামেলা কোথায়?
-ফরহাদ, আপনার কী মনে হয়?
-ঝামেলা আছে। সমাজ দেবে না।
-কেন দেবে না?
-সমাজ, ঝামেলা পছন্দ করে না।
-সমাজে কি ঝামেলা নেই?
-আছে।
-তাহলে?
-জানি না। তবে সে অনেক কিছু জানতে চাইবে।
-যেমন?
-এই যেমন তার পরিচয় কী? সে কোন ধর্মের? সমাজে তার অর্থনৈতিক অবস্থান কোন পর্যায়ের?-এইসব।
-আমি এর উত্তর দিতে বাধ্য নই!
-আপনার মাকে দিতে হবে। আপনার বাবাকেও।
নাহিদের আবার তার মার কথা মনে পড়ে। তার মা তার পেছন পেছন দৌড়াচ্ছিল। মা কোথায়?
-ফরহাদ, মা কোথায়?
-উনি সমাজেই আছেন।
-আমি?
-আপনিও।
-সে আমার সঙ্গে থাকতে পারবে?
-কে?
-মেয়েটি! যে বিড়াল ছিল।
-পারবে। বিয়ের পর। তবে তাতেও ঝামেলা হবে।
-যেমন?
-সমাজ দিবে না।
-কেন?
-সে অনেক কিছু জানতে চাইবে। যেমন- তার ধর্ম কী?
-সে তো বিড়াল থেকে মানুষ; তার আবার ধর্ম কী?
-না থাকলে ধর্ম গ্রহণ করবে।
-কোন ধর্ম?
-যেটা আপনার!
-তার যদি এটা ভালো না লাগে?
-তারপরও। আপনার সঙ্গে থাকতে চাইলে তাকে এটা করতে হবে।
-ফরহাদ! আপনার সিদ্ধান্ত কী?
-আমি সিদ্ধান্ত দেই না।
-আপনি কি দেন?
-এখানে আমি বিবেচ্য নই।
-তাহলে বিবেচ্য কী?
-সমাজ। সমাজকে আপনার কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনার পরিবারকেও।
-আমি বাধ্য নই!
-আপনার মা জানতে চাইবে।
“মা!”
-ফরহাদ, আপনার মা কোথায়?
-আপনি গুলিয়ে ফেলছেন।
-কী?
-প্রশ্ন। এবং একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করছেন।
-তাহলে আমার কী করা উচিত?
-আপনার চোখ খোলা উচিত।
-চোখ! আমার চোখ তো খোলাই আছে!
-না। আপনি ঘুমোচ্ছেন। আপনি আপনার বিছানায় শোয়া। মেয়েটি আপনার মুখের দিকে চেয়ে আছে।
-আমি কি ঘুমিয়ে আছি ফরহাদ?
-হ্যাঁ।
-মেয়েটি কি আমার দিকে চেয়ে আছে?
-হ্যাঁ। চেয়ে আছে।
-আমার কি এখন চোখ খোলা উচিত?
-হ্যাঁ।
নাহিদ চোখ খোলে। দেখে, মেয়েটি তার দিকে চেয়ে আছে। এই চেয়ে থাকা নাহিদকে আবারও বিহ্বল করে তোলে। মেয়েটির মুখ হেসে ওঠে। আহা! কী চমৎকার। কে বলবে, সে বিড়াল ছিল। নাহিদ মনে মনে তার জন্যে একটা নাম খুঁজতে থাকে। কী নামে ডাকা যায় তাকে? আমেনা, তিলোত্তমা নাকি নূপুর সেন! নাহিদ আসলে জানে না। সে শুধু চায় মেয়েটা থাকুক; আগে যেমন ছিল। নামহীন। ঝামেলাহীন। কিন্তু... না, নাহিদ কেবল ফিসফিসিয়ে জানতে চায়, “তুমি কি আবার বিড়াল হয়ে যেতে পারো?”