Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

আন্ধারপক্ষ

Icon

আরিফুল হাসান

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:১২

আন্ধারপক্ষ

প্রতীকী ছবি

কালো পাহাড়ের চূড়ায় একটি বড় ধস নামবে। তার আগেই পৌঁছে যেতে হবে গন্তব্যে। রাত্রি ছমছম। পথে কত ভয়! তবুও নির্ভীকা পথ চলে। তার বয়সের ভারে ক্লান্ত শরীর কালো কালো পাহাড়ের খাঁজ ধরে সাবধানে পা ফেলে এগোয়। সমস্ত উপত্যকা জুড়ে গাছ বলতে কিছু শুকনো শুকনো চিরল পাতার বাবলা। প্রাণহীন, অথবা প্রাণ ধরে আছে যে তা বোঝা যায় না।

মনে হয়, মহাকালের রুক্ষতা তাদের দেহের অভ্যন্তরের শেষবিন্দু রসটুকু বাঁচিয়ে রেখেছে পরিহাসে। যেন এখনই চাইলে শুষে নিতে পারে সবিশেষ সতেজতা। যেন উষ্ণতার তীব্রতা আরেকটু বাড়লেই নেমে পড়বে গাছের শীর্ষকাণ্ড নুইয়ে আর শেকড়গুলো আপনাআপনি আলগা হয়ে যাবে কালো পাহাড়ের খাঁজ থেকে। কোথাও কোনো আর্দ্রতা নেই। সাড়ে তিন মাইল পাহাড়ের মধ্যে আর্দ্রতা বলতে বৃদ্ধার চোখেই শুধু কিছুমাত্র জল অবশিষ্ট আছে। তার হাতে একটি ব্যাগ। ব্যাগে কিছু পুঁটলির মতো পেঁচিয়ে রাখা আছে। সম্ভবত কোনো খাবার। কোনো আত্মীয়ের বাড়ি থেকে হয়তো নেমন্তন্ন খেয়ে আসার সময় পরিবারের অসুস্থ কারও জন্য একটুখানি নিয়ে এসেছে। আবার অন্যটাও হতে পারে। হয়তো সে তোহফা পৌঁছে দিতে যাচ্ছে পাহাড়ের ও পাড়ে কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে। হয়তো তার আত্মীয়ের বাড়ি এই কালো-কঠিন পাথরের পাহাড়টির ও পাড়েই। বুড়ি ভয়ে ভয়ে পথ চলে। কিন্তু কোনো জন্তু দেখা যায় না সেখানে। না কোনো সরীসৃপ, না কোনো কালো সিংহ। বুড়ি নির্ভীকই পথ চলে বলা যায়। তবু তার ভয়। পায়ের নিচে সরসর করে সরে যাচ্ছে পাথর। প্রতিটা পদক্ষেপ অন্তত বিশবার করে ফেলতে হচ্ছে নানা সাবধানতায়। তবু হরহর করে সরে যাচ্ছে পাথর। পাথর সরে যাচ্ছে পাথরের নিয়মে। আর রাত্রিটা সরে যাচ্ছে ক্রমে উত্তরে।

রাত গভীর হয়ে নামলে বৃদ্ধা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করবে বলে মনে করে। একটি খোঁড়ল বানিয়ে রাখা পাথরের আড়ালে- যাকে মোটামুটি গুহা বানিয়ে সে রাত কাটায়। নিস্তব্ধ প্রকৃতির ভেতর তার ঘুমহীনতা, একেকটি দীর্ঘশ্বাস হাহাকার হয়ে পাহাড়ের বুকে প্রতিধ্বনিত হয়। ফিরে আসে তার দীর্ঘ দুঃখ বেরিয়ে যাওয়া শ্বাসের দহন প্রতিধ্বনি হয়ে আবার বুকের কাছে। বৃদ্ধার রাত কাটে নক্ষত্র দেখে। নক্ষত্রদের অগ্নিসভা আরও যেন রাতের গরমকে বাড়িয়ে দেয়। বৃদ্ধা তার বোরকার আড়ালে হাত দিয়ে মুখ মোছে।

কোথাও কোনো পাখি ডাকছে না। রাতের যে শব্দ, যেন তাও থেমে গেছে। এই সত্তর বছরের জীবনে, এমন নির্জনতা হয়তো বৃদ্ধার কাম্য ছিল। কিন্তু ক্রমেই কি তা অসহনীয় হয়ে উঠবে? উঠতে পারে, হয়তো তার মনে হবে এ জীবনে নির্জনতা যতই কাম্য হোক, জীবন আসলে কোলাহলের নাম। তার এ ভাবনা আবার ভুলও প্রমাণ হতে পারে তার কাছে। তখন সে উদাস তারাদের দিকে তাকিয়ে শেষে আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে আরও উত্তরের শীর্ষ চূড়াটার দিকে।

চাঁদের আলোর ফিকে জ্যোৎস্না অনেকক্ষণ আগে নিভে গেছে। তারাদের বিচ্ছুরণ এখন কালো পাহাড়ের চূড়াটার উপর বহুমাত্রিক আলো ফেলে যেন বৃদ্ধার অবয়ব ধারণ করেছে। বৃদ্ধা দেখে, চূড়ায় যেন সেই দাঁড়িয়ে আছে। সে আবার দেখে, ভালো করে দেখে। না, তার মতোই মনে হয়। এও কি সম্ভব? জীবনের দ্বৈততায় সে অনেক যাপন কাটিয়েছে। যেমন করেছে নারী সেজে ঘর সাফাই, তেমনি পুরুষ যোদ্ধার রূপ ধরে করেছে বেদুইনদের সাথে যুদ্ধ। তার অস্ত্র ও কোমল হাত এবার সে নক্ষত্রের আলোয় মেলে ধরে। হাত দুটোতে রক্ত লেগে আছে। হাত দুটোতে লেগে আছে গোলাপের সুবাস। বৃদ্ধা আবার দূরে উত্তরের চূড়াটির দিকে চায়। এখান থেকে তাকে আরও নামতে হবে সাতশ মিটার নিচে। সেখানে খাদের কাছে কোনো পথ খুঁজে নিয়ে বুড়ি আবার উঠতে থাকবে উত্তরের পাহাড়ের কোল বেয়ে তার সুউচ্চ শিখরে। সেখান থেকে সে হয়তো ও পাড়ে যাবে, হয়তো যাবে না। কিন্তু বুড়ি আপাতত নিশ্চিত যে সে সেই পাহাড়ের চূড়ায় উঠবেই। কিন্তু এ কী! রাতের অন্ধকারে তারাদের মিলনমেলায় বুড়ির একটি প্রতিবিম্ব যেন দাঁড়িয়ে আছে ঠিক উত্তরের পাহাড়ের শিখরটায়। রোহিতগিরি থেকে যেন দেখছে তাকেই তার বিশিষ্ট তীক্ষ্ণ-তির্যক চোখ দিয়ে রাতের অন্ধকার উড়িয়ে দিয়ে। যেন তারাদের সাথে তার গোপন চোখ দুটো ও পাশ থেকে নয়, দিগন্তছড়ানো তারাদের মতোই দশপাশ থেকে দেখছে তাকে। বুড়ির কিঞ্চিৎ বিভ্রম হয়।

এবার সে হেলানো পাথরটার নিচ থেকে বের হয়ে আসে। চোখের পাতার উপর দু হাতের শেড দিয়ে দূরে দেখার চেষ্টা করে। না, অবিকল তার মতোই। কালো বোরকায় সমস্ত দেহ আবৃত, দুটো চোখ দেখা যাচ্ছে শুধু। তবু ওই চোখের ভাষাতেই বৃথা যাচ্ছে না বুঝতে যে এটি অবিকল নয়, একেবারে সেই বর্তমান সেখানেও। সেসব ভাবতে ভাবতে বুড়ি হয়তো পাহাড়ের কোনো পলকা পাথরে পা দিয়ে পড়ে যাচ্ছিল, হয়তো সে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করেছে পতন। হয়তো আবার সে পড়ে যাচ্ছিল না। তার সত্যি সত্যি ইচ্ছে হয়েছিল লাফ দিতে। যেহেতু সে পৌঁছে যাবার আগেই তার আরেকটি সত্তা পৌঁছে গেছে সেখানে, সুতরাং রাত জাগা বৃথা। রাত জেগে তারাদের সাথে দিগন্তের হিসেব মেলানো বৃথা। আর বৃথা এই সাতশ মিটার ঢাল বেয়ে নিচে নামা এবং তারপর আবার সুউচ্চ শৃঙ্গের দিকে পা বাড়ানো। হয়তো বুড়ি এসবও ভাবে না। তার রাত তখন তার কাছে প্রতারণার প্রতিরূপ হয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে আবার। সে আবার হয়তো হেলে থাকা পাথরটির গুহার মতো জায়গাটিতে আবার ঢুকে পড়ে। এবং নিঃশব্দতার ভেতর নিজের নিঃশ্বাসকেই সশস্ত্র সন্ত্রাস ভেবে সন্তর্পণে ঘুমিয়ে গিয়েছে।

রোদ বাড়লে আবার দেখা যায় বুড়িটিকে। এবার আর পূর্ব পাহাড়ের মাঝামাঝি সেই হেলে পড়া পাথরটির গুহার মতো অন্ধকারে নয়। সে ইতোমধ্যে নেমে এসেছে নিচে। একেবারে সাতশ মিটারের ঢাল সে কীভাবে এত দ্রুত নামল সেটি হয়তো সেও কল্পনা করতে পারে না। তবে মনে হয় রাত না থামতেই বুড়ি পথ চলা শুরু করেছিল। হয়তো উত্তরের চূড়া থেকে তারই প্রতিরূপ তাকে ডাকছিল প্রবলভাবে। সে আকুতির কাছে হয়তো সরসর করে সরে যাওয়া আলগা পাথরগুলো চুম্বকের মতো লেগে গিয়েছিল কালোপাহাড়ের শ্রেণিটার দেহে। বুড়ি সে পথহীন পথ তৈরি করা পথে নেমেছে স্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক গতিতে।

সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছে। তবু কালো পাহাড়ের সারির চূড়াগুলোর মাঝে চকচকানি ছাড়া তেমন কোনো উজ্জ্বলতা প্রকাশ করতে পারেনি। যেন দিনের আলোতেও রাতের কালো লেগে আছে পাথরের পাথরে, পাথরের অভ্যন্তরে। সে অন্ধকার কালোয় কালো বোরকা পড়া বৃদ্ধাটি সাতশ মিটার নেমে এসে খাদের মাঝে পথ খুঁজে পায়। সন্তর্পণে অতিক্রম করে উত্তরের পাহাড়টিতে পা রাখে। এমন সময় চূড়ার পূর্ব অংশের একটি বিশাল পাথর, যেন অর্ধেকটা চূড়া ধসে পড়ে প্রবল শব্দে। বুড়ি একটু থমকে দাঁড়িয়ে আবারও পা বাড়ায়। দশ-বিশ মিটার ওঠার পর সে দেখতে পায় তার মাথার উপর বরাবরই নেমে আসছে আরেকটি দানব আকৃতির পাহাড়খণ্ড। বুড়ি কোনো রকম একটা খাঁজের আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে। তার নাক-মুখ ছুঁয়ে পাহাড়খণ্ডটি গড়িয়ে পড়ে প্রবল বেগে। খাঁজের ভেতর ভেতর বুড়ি কাঁপতে কাঁপতে অনড় হয়ে যায়। যেন সেও পাহাড়।

হঠাৎ করেই দুনিয়াটা যেন কাঁপুনি দিয়ে ওঠে আর কেয়ামতের শিঙার ফুৎকারের শব্দে ভেঙে গুড়ুগুড়ু হয়ে পড়ে কালো পাথরের পর্বতশ্রেণির সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গটা। মাইলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভাঙা পাথরের বিপ্লব। কিন্তু খাদের কয়েক মিটার উঁচুতে বুড়িকে আশ্রয় দেয়া সে খাঁজটি টিকে থাকে অনশ্বর, টিকে থাকে তার ভেতরে পাথর হয়ে থাকা কালো বোরকার বৃদ্ধাটিও।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫