Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

পার্সোনালিটি

Icon

শেখ লুৎফর

প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১১:৫২

পার্সোনালিটি

গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল

শীতকালে সবুজে সবুজে সয়লাব হাওরে ঘুরে বেড়ানো আমার পুরনো বাতিক। একটু সুযোগ পেলেই দম নেবার জন্য সংসার থেকে পালাই। সে-বার শুধু নিজের জন্য আস্ত একটা দিন হাতে নিয়ে পালিয়েছিলাম। সারাটা সপ্তাহ মানুষের মুখের জটিল আঁকিবুঁকি দেখতে দেখতে যখন নিজের নফছ্ বিগড়ে যায়, পেট আর চেটের জন্য ছুটতে ছুটতে নিজেকে মানুষ ভাবতে ঘেন্না লাগে, তখন এই হদ্দ সংসারের বেড়া-জাল ছিঁড়ে কে-না চোরের মতো একা হতে চায়?

বাস-রিকশা বদল করে চিলাউড়া পয়েন্টে সিএনজি চালিত একটা অটোতে উঠে বসি। গন্তব্য নলুয়ার হাওর। হঠাৎ উজান থেকে ছুটে আসা ঢল কিংবা অতি বৃষ্টিতে নলুয়ার বোরো ধান তলিয়ে গেলে এলাকার মানুষজনকে বহুবার আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি, ‘বাংলাদেশের একদিনের খোরাকি, নওল্ল্যার হাওর মারাখাইছে !’       

তাদের অন্ধবিশ্বাস, নলুয়া-হাওরের সব ধান কৃষকের গোলায় তুলতে পারলে বাংলাদেশের সতেরো কোটি মানুষের একদিনের খোরাকি হয়।             

হাওরের মাঝবরাবর সাবমার্সেবল সড়ক ধরে সিএনজি চালিত অটোটা টানা বিশ মিনিট ছুটে চলার পর কামারখাল নদীর পাড়ে আমি নেমে পড়ি। দশ-বারো বছর আগেও হাওরে ধান কাটার জন্য টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ থেকে কামলারা বড় বড় নাও নিয়ে, বৈশাখে এই কামারখাল নদী দিয়ে একদম হাওরের বুকের কাছে চলে আসত। তাবাদে ফসল রক্ষা-প্রকল্পের নামে অপরিকল্পিত, অপরিণামদর্শী একটা স্লুইস গেট হলো। আর পলি জমে জমে এখন কার্তিকের পরেই নদীটা মরে যায়। 

অটো থেকে নেমে, করুণ চোখে মরা নদীর ফাটাফাটা বুকের দিকে তাকিয়ে থাকি। একটু দূরে হিজল বনের সারি। সুন্দরী নারীর ভুরুর মতো বাঁক খেয়ে চলে গেছে দাসনাগাঁওয়ের দিকে। সেই দিকে তৃষ্ণিত নয়নে তাকিয়ে  থাকি। পরম শান্তিতে নড়তেও ভুলে গেছি। প্রজাপতির পুঞ্জাক্ষি ঘুরানোর মতো ধীরে ধীরে মাথাটা ঘুরিয়ে হাওরটা দেখছি : উত্তরের গ্রামগুলো এখনো নজরের বাইরে। দক্ষিণ দিকটাও আবছা আবছা কালচে-সবুজ। পশ্চিম-দক্ষিণ কোনার দিকে একটা বিশাল চারণভূমি ছিল। সরকার সেখানকার একটা বড় অংশ যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খয়রাত করেছে। তাই ধানের জমি বাড়লেও উজ্জ্বল চন্দ্রপৃষ্ঠের মতো অর্ধবৃত্তাকার তৃণভূমিটা এখন আর আগের মতো নজর কাড়ে না। পুব দিকের ওই গ্রামটা গত দশ-বারো বছর ধরে রূপকথার রাক্ষসের মতো চুপি চুপি হাওরটা গিলতে গিলতে এবার একেবারে আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। গত বছর এলজিইডি হাওর ঘেঁষে যাওয়া গ্রামের সড়কটা পাকা করে দিয়েছে। আর এই সড়কটাই এখন বাজিকরের মতো ঘন বসতি থেকে লোকজনকে ডেকে ডেকে হাওরের দিকে নিয়ে আসছে।

অনেক উঁচু উঁচু অন্তত দশটা ভিটাতে এ বছর ঘর উঠেছে। এখনো দুটি মেশিন গমগম শব্দে তুমুল বেগে মাটি কাটছে। নতুন বাড়িগুলোর অধিকাংশই টিনশেড হাফবিল্ডিং। বিদ্যুতের বিশাল বিশাল খাম্বা, নীল আকাশের পটভূমিতে তেত্রিশ হাজার ভোল্টেজের হাবিজাবি, ডিশ-লাইনের কালো ক্যাবল, হাগু-মুতোর টাট্টিফাট্টি আরও কত কিছু যে খাটাশ-পিশাচের মতো বসতিটা ঘিরে হাওরের দিকে দাঁত-ধরাচ্ছে!

একটা সিগারেট ধরিয়ে মাথা নুয়ে নুয়ে হিজল-সারির দিকে হাঁটি। অনুভব করি, এটুকুতেই মনটা মাটি হয়ে গেছে। তাই ইচ্ছা করছিল প্যান্টের চেইন খুলে ওইসব কিছুর মুখে একদফা হাত মেরে দেই। কিন্তু এই বিশাল ঐশ্বর্যময়ীর কাছে নিজেকে আর ছোট করতে সাহস হয় না।

মাকে মনে পড়ে। ব্যাংক লোনের টাকায় যেদিন প্রথম টিভি-ফ্রিজ কিনে নিয়ে আসি মায়ের সেদিনের কথাটাও মনে পড়ে। টিভিটা ঠিক ঠিক জায়গায় সেট করার পর মা আমাকে ডাকলেন। পাশে যেতেই বললেন, ফ্যানডা ছাইড়া আমার কাছে বও।

মায়ের নড়বড়ে শরীর। আমি তার শিরা ওঠা কুঁচকানো চামড়ার একটা হাত হাতে নিয়ে পাশে বসি। মায়ের হাত-পায়ের নখগুলো খুব শক্ত আর পুরু পুরু। ব্লেড দিয়ে কাটতে তাঁর কষ্ট হয়। তাই আমি হর শুক্রবারে পানিতে ভিজিয়ে, নেলকাটার দিয়ে মায়ের নখ কেটে দেই। এইসবের মধ্যে আমি তাঁর শতাব্দী ছুঁই ছুঁই জীবনের ঘ্রাণ পাই। 

মা আমার মাথায় হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ক্যান এইসব আলতু-ফালতু জিনিসের পিছে রক্ত-পানি-করা ট্যাকা খরচ করো?

চকচকে নীল পানির জলাশয়টা সামনে নিয়ে প্রাচীন একটা হিজল গাছের তলে বসে পড়ি। মাঘ মাসে শীতের জোর কমে যায়। দুপুরের দিকে রোদটাও চড়ে। তাই একটু একটু গরম বাতাস আর গম্ভীর-কালচে-সবুজের নির্জনতায় আরেকটা সিগারেট ধরাই। বোরো ধানের এখন যৌবনকাল। সপ্তাখানেকের মধ্যেই শিষ ছাড়বে। ক্ষেতে ক্ষেতে ঘাসবাছা, সার দেওয়া চলছে। বিধাতার এই অপার্থিব ভুবনে আসলে সবার মনই বোধকরি বাউলা হয়ে যায়। নিজেকে তুচ্ছ তুচ্ছ লাগে। তাই এই স্তব্ধ অতুল বৈভবের মাঝে সবাই নীরবে কাজ করছে।

গাছে হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছি। খস খস শব্দে চোখ মেলে তাকাই। খাড়া নেংটিকাছা একজন বুড়ো মানুষ কার্পেটের মতো ঘন-মোলায়েম ঘাসে ঘষে ঘষে হাতের জল-কাদা মুছছে। আমি বোতল থেকে এক চুমুক পানি খাই। দুপুরের মিষ্টি রোদে হাওর তার তাবৎ সৌন্দর্য ও সম্পদের চূড়ান্ত মহিমায় বিকশিত। এখন পুব দিকের ওই উঠতি গ্রামটার হিজিবিজি মুছে দিতে পারলে হাওরটা সেই রকম লাগত! 

আমি এক নজরে গোটা হাওরটা আবার দেখছি। লোকটা ছোট্ট একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, আগুনটা দ্যাইন। 

দেখি, লোকটা একটা বিড়ি ঠোঁটে গুঁজে আগুনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। আমি একটা সিগারেটসহ গ্যাস লাইটারটা তার হাতে তুলে দেই। ভেজা, স্যাঁতসেঁতে-ঠান্ডা একটা আঙুল আমার আঙুলে লাগলে তার ভাঙাচোরা জীবনের নিবুনিবু পরশ পাই। অধিকাংশ হাওরবাসীর মতো এই লোকটাও অকালে বুড়িয়ে গেছে। সামনের তিনটা দাঁত পোকায় কেটে কেটে বারো আনা সাবাড় করে ফেলেছে। গ্যাস ম্যাচটা ফেরত দিতে দিতে বিষণœ মানুষটা আড় চোখে আমাকে আরেকবার দেখে। আমার হৃদয়টা সীমাহীন হাওরে ছড়িয়ে দিয়ে নিজের মাঝে ডুব দিতে চাই। লোকটা সিগারেট শেষ করে আবার গলা খাঁকারি দেয়, অ সাহেব, একটা কথা আছিন।

তার গলার শব্দে আমার ভেতরটা ধড়মড় করে জেগে ওঠে। কেমন একটা দুঃখগন্ধি বহু পুরনো কান্নার রেশ। আমি বাইরে বেরোলেই চেতনে-অবচেতনে গল্প খুঁজি। এখন আমার আত্মা বলছে, লোকটার অলহমে (কণ্ঠনালি) একটা ছোটগল্প বসে উঁকি দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি লোকটাকে আরেকটা সিগারেট দিয়ে নিজেও একটা ধরাই। হাওরের প্রকৃতির মতো লোকটাও সহজেই আমাকে সমঝে নেয়। তাই ঘাসে পাছা ঘষটে ঘষটে, বসে বসেই সে আমার পাশে চলে এসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘পারছনালিটি’ জিনিসটা কী?

আমি বুড়ো মানুষটাকে আরেকবার দেখি: তার জল-কাদায় মাখামাখি ভাঙাচোরা শরীর, সাদা রুক্ষ চুল-দাড়িতে শুকনা কাদার ছিট ছিট দাগ এবং বারো আনা খাওয়া তিনটা দাঁতের কালো গর্তে মানুষটার আটআনা জীবনের জ্যান্ত সাক্ষাৎ পেয়ে যাই। তাই একটু সতর্ক হয়েই বলি, একটা শব্দ দিয়া তো কিছু হয় না। প্রত্যেক শব্দের সামনে-পিছে আরও কিছু কিছু কথা থাকে, সেইসব জানতে পারলে আসল অর্থ উদ্ধার করা সহজ হয়।

লোকটা কী বুঝল আল্লাহ জানেন! সে নীরবে মাটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তাবাদে বলতে শুরু করে, আমার নিজের কোনো সন্তান নাই। ছোট ভাইয়ের একটা ছেলেরে নিজের কৈয়া মানুষ করছি। বাজান আমার শহরে থাইক্যা বিএ পাস করছিল। তে শহর থাইক্যাই তার বিয়ার একটা পরস্তাব আসে। কৈন্যাও শহরের কলেজে পড়ে। পাত্রীপক্ষ পাত্র আর বাড়িঘর দেখতে আইল...। 

এইভাবে লোকটা বলতে থাকে যে তার পালকপুত্র দেখতে রাজপুত্র। বাড়ির সবাই অশিক্ষিত, তাই সে নিজেই তদারক করে মেহমানদেরকে শরবত-চা-পান খাওয়ায়। দুপুরে খেতে বসে সে শোনে মেয়ের বড় ভাই তার চাচাকে বলছে, সবকিছু ঠিক আছে, শুধু ছেলেটার পার্সোনালিটি নাই। 

এই কথা শুনে তার মুখের ভাত গলায় আটকে যায় : সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাইলে পারছনালিটি ঠিক থাকত না ক্যা? এইডা এমন কী জিনিস?

তার তালু চিনচিন করে জ্বলছে...হঠাৎ গজার মাছ ঘাই মারার মতো তার মনের মধ্যে একটা কথা ভুস করে ওঠে : গৈ-গেরামে কত মাইয়া বিয়ার আড়াইদিন বাদে বাপের বাড়ি আইসা ‘জামাইয়ের হেইডা নাই’ এই কতা কৈয়া বিয়া খারিজ কৈরা দ্যায়। তাইলে কি পাত্রীর বড় ভাই হেই কথাই কৈবার চায়? 

আগ-পাছ বিচার না-করে সে মেয়ের চাচাকে বলেই ফেলে, কী যেন কথা, মাঝে মাঝে হে যহন পুকুর ঘাডে গামছা পিইন্দ্যা গোসল করে তহন দেখছি, বিরাট তার পারছনালিটি।

তার কথা শুনে পাত্রীপক্ষের সবাই একেবারে বোবা হয়ে যায়। গপ্সপ্ কিংবা খানাখাদ্যে আর কারো মন বসে না। তিন দিন পর পাত্রীপক্ষ বিয়া দিবে না বলে খবর পাঠায়। অবশ্য এই কথা আগেই মুখে মুখে রটে গেছিল। তাই সন্ধ্যার পর তার ছেলেও ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়ে। সেইটাই তার শেষ যাওয়া।

এইসব বলতে বলতে লোকটা ধরাগলায় আমার কাছে আরেকবার লাইটারটা চায়। শেষ সিগারেটটাসহ আমি লাইটারটা তার দিকে এগিয়ে দেই। সে কিরিচ কিরিচ শব্দ তুলে সিগারেট ধরায়। খকখক কাশে। এবং মনের ভুলে পার্সোনালিটি শব্দটার অর্থ না-জেনেই কাশতে কাশতে জমিনে নেমে যায়। 

আমার আবার ঝিমানি আসে। ঝিমুতে ঝিমুতে দেখি মা আমার চোখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বলছেন, লোকটা শব্দটার মানে না-জাইন্যা ভালাই করছে। চৌপাশে মত্ত হাতির লাহান ধুন্ধুমার উন্নয়ন, অনাচার আর বস্তা বস্তা লুটের ট্যাকায় সয়লাব দেশে মানুষের কোনো পার্সোনালিটি থাক্তা পারে না রে বাজান...

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫