
কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। ছবি: সংগৃহীত
একদিন দুপুর বেলা সমুদ্রতীরে একাকী দাঁড়িয়ে নিজেকে নিঃসঙ্গ একাকী অসহায় মনে করে ছুটে পালিয়ে এসেছিলেন এক কবি। সেই কবি বিশাল জীবনের সামনেও নিজেকে নিঃসঙ্গ একাকী অসহায় মনে করে পালিয়ে আসেন যে-আশ্রয়ে, সে-ই হলো কবির গদ্য। শাদা শূন্য একাকী নিঃসঙ্গ ঘন্টাগুলো ভরাতেই ব্যাপক গদ্য লিখেছিলেন কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ।
শূন্যতা ও নিঃসঙ্গতা দূর করতে দীর্ঘ, যত্নশীল, পরিশ্রমসাধ্য গদ্য রচনা করেছেন। চাকরিসূত্রে, বিবাহসূত্রে, পারিবারিক সূত্রে, সামাজিক অসংখ্য, বন্ধনের সূত্রে, সাহিত্যিক খ্যাতি ও অখ্যাতির সূত্রে একটি বিরাট ঊর্ধ্বস্থ জটিলতার মধ্যে প্রবেশ করেও তিনি প্রতি মুহূর্তে একাকীত্বের দুঃসহ চাপ বোধ করেছেন। গদ্য লিখে সেই দুঃসহ চাপ হালকা করেছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ অসামান্য গদ্যকার ও কথাশিল্পী। তাঁর গদ্য আশ্চর্য সুষমায় স্পন্দিত। কবিতার ছন্দবদ্ধ জগৎ থেকে গদ্যের মধুহীন জগতে আশ্রয় নিলেন। ভাঙলেন প্রচলিত গদ্যের সীমানা। নমনীয়, নির্ভার-নির্মেদ গদ্যের সৌধ নির্মাণ করলেন। সমূহ সুন্দরের সম্ভার নিয়ে নির্মিত হলো তার গদ্যের সৌধ। স্নিগ্ধ-সৌকর্যময় সেই সৌধের ইট-সুরকি। মায়াময় ও মখমল সেই গদ্যের শরীর! অন্তহীন সুষমামাখা তার শৈলী। শিশুর কোমল মসৃণ চিবুকের মতো তার অবয়ব। তার কাছে গদ্য দিবস-পুরুষ, কবিতা নারী-রাত্রি। প্রথম থেকে তিনি ভাষাকে বিষয়ের সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রথম গদ্য রচনা প্রকাশের আগ থেকে বাংলা ভাষার বিখ্যাত-অখ্যাত বিভিন্ন লেখকের গদ্যলেখা সামনে রেখে অনুশীলন করতেন। তারপর একটু বড় হয়েই দীর্ঘ অনুশীলনের পর তাঁর প্রথম গদ্য রচনার প্রকাশিত হয়। আত্মা ও আঙ্গিক তার কাছে তুল্যমূল্য। কী বলছেন তার মতোই তাৎপর্যপূর্ণ কীভাবে বলছেন।
গদ্যে তার আরাধ্য সংহতি। সেজন্যে অ-বিকল্প শব্দ ব্যবহার করতেন। অনেক সময় তাঁকে (আপাত) কঠিন শব্দ প্রয়োগ করতে হত। শিথিলতা তাঁর দুচোখের বিষ। সেজন্যে অব্যবহৃত বা অল্প ব্যবহৃত শব্দ অনেক সময় ব্যবহার করতেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শব্দ সৃষ্টি করেও নিয়েছেন। তাঁর গদ্য কোন সময়ই চিন্তাহীন অনর্গল উচ্চারণ ছিল না। চিন্তাকে রূপ দিতে গিয়ে গদ্যেও তিনি কবিতারই ধরনে শব্দ প্রয়োগ করেছেন। শুধু শব্দের অর্থের দিকেই তাকাতেন না; তার রূপ, ধ্বনি, ওজন, আয়তন পাশাপাশি দুই শব্দের সংঘর্ষের দিকেও লক্ষ্য রাখতেন। গদ্যে শুধু অভিধান থেকেই শব্দ চয়ন করেননি অসংহতি এড়িয়ে মুখের কথাকেও গদ্যভাষায় প্রয়োগ করেছেন। সংহতির জন্য মূলত, ধ্বনিসাম্যের জন্যেও, আলাদা হওয়ার জন্যেও তিনি ব্যাপকভাবে সংস্কৃত শব্দ ব্যবহার করেছেন। অনেক সময়ই পরীক্ষামূলকভাবে আরবি ফারসি শব্দও ব্যবহার করেছেন। সৃষ্টির আনন্দে সংস্কৃত ও আরবি ফারসি শব্দও পাশাপাশি স্থান দিয়েছেন ভিন্ন ভাষা থেকেও শব্দ নিয়েছেন। তার ভাষ্যে, ‘বাংলা গদ্যের সংহতির জন্যে সংস্কৃত শব্দ পরিগ্রহণ না করে উপায় নেই। তবুও একথা ভুলিনা যে, বাংলা বাংলাই।’
তার গদ্যভাষায় চিন্তার জটিলতার চেয়ে ভাষার দুরূহতা, দুর্বোধ্যতার প্রশ্নই বেশি উঠেছে। শব্দার্থ জানলে, অন্বয়ের্র কাঠিন্য অতিক্রম করলে, মূল বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হলে তাঁর গদ্যের অর্থ স্পষ্টভাবেই বোধগম্য হবে। অর্থহীন বাক্য প্রণয়ন করেননি; দুরূহ বা দুর্বোধ্য হতে পারেন কিন্তু অবোধ্য কখনো নয়।
যারা বাংলা গদ্যকে জলবৎ তরল করার জন্যে শিথিল ও পুনরাবৃত্তিময় শব্দ-বাক্য অনুচ্ছেদ রচনা করেন, যাদের কাছে প্রকারান্তরে ‘সাংবাদিক গদ্য’ আর ‘সাহিত্যিক গদ্যে’ কোনো তফাৎ নেই, মান্নান সৈয়দের গদ্য তাদের বিরোধী।
তাঁর দাবি, ‘মৌলিক গদ্য আর সাহিত্যিকদের গদ্য কিছুতেই এক জিনিস নয়, মুখের কথা স্বভাবত শিথিল, বিস্তারিত, নানাভাবে ব্যাখ্যাকারী; কিন্তু সাহিত্যের গদ্য একটি শিল্পের আনন ও শরীরের মতো, একটি অখণ্ড শিল্পরূপের প্রচ্ছদের মতো,কিন্তু প্রচ্ছদও নয়-আত্মার অংশ।’
কাব্যভাষার মতো গদ্যভাষাকে শিল্পিত করার একটা প্রয়াস ছিল। প্রথম থেকেই গদ্য ও কবিতার মধ্যে বিনিময়ের ব্যবস্থার চেষ্টা করেছেন। লেখালেখির প্রথম জীবনে টানা গদ্যে কবিতা লিখেছিলেন। আর উল্টো দিকে গদ্যের মধ্যে কবিতার বর্ণালি ও সম্মোহ সঞ্চার করতে চেয়েছেন। প্রবন্ধ ও সমালোচনার গদ্যভাষাতেও শব্দচয়নে, বাক্যগঠনে, অনুচ্ছেদনির্মাণে এবং একটি সমগ্র রচনায় একটি অটুট সংহতি দিতেন। সেই সংহতি গদ্যভাষায় এবং পুরো প্রবন্ধের সংগঠনের পাশাপাশি চিন্তার দিক থেকেও ছিল। কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের মতো পরীক্ষামূলকভাবে গদ্যকাজেও সাধনা করেছেন।
প্রথমাবধি তার অন্যান্য কাজের মতো গদ্যকাজও পরীক্ষাশীল ছিল। এই পরীক্ষাশীলতা তার বানান, শব্দ, বাক্য, এমনকি একটি গদ্যলেখার নির্মাণেও অনেক সময় পাওয়া যাবে।
তাঁর গদ্যে কখনো কখনো প্রকরণকে ঈশ্বর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মুখের কথার মতো যে গদ্য নিছক বক্তব্যই পেশ করে, তিনি তা ভাঙতে চেয়েছেন। অগ্রাহ্য করেছেন। তার কাছে বক্তব্যের নতুনত্ব প্রকরণের নতুনত্বের জনক। গদ্যকাজে প্রকরণ বলতে শব্দ ব্যবহারের ধরন, বাক্য নির্মাণের কৌশল, অনুচ্ছেদ তৈরির পদ্ধতি এক কথায় সম্পূর্ণ রচনাটির গঠনকলাকে বোঝায়। বিষয় ও বক্তব্য যে এই প্রকরণের ছাঁচ ও আত্মা তৈরি করে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এক-একটি রচনায় থাকে এক-একরকম প্রকরণের দাবি। এক একটি প্রবন্ধে তিনি নিজেকে নিঃশেষে দান করতে চেয়েছেন। এভাবেই হয়ে ওঠলেন একজন উপমাবহুল, চলচ্চিত্রময়, দৃশ্যকল্পিত ও কাব্যিক গদ্যের স্রষ্টা।