Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাওয়া কবি আসাদ চৌধুরী

Icon

কায়েস সৈয়দ

প্রকাশ: ১৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৭

রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাওয়া কবি আসাদ চৌধুরী

কবি আসাদ চৌধুরী। ফাইল ছবি

৫ অক্টোবর ২০২৩। স্থানীয় সময় রাত ৩টা। কানাডার টরন্টোর আসোয়া শহরের লেকরিচ হাসপাতালে পড়ে আছে এক নিথর দেহ। যার শরীর ছড়িয়ে যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের দ্যুতি। তিনি কবি আসাদ চৌধুরী (জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, উলানিয়া, মেহেন্দীগঞ্জ, বরিশাল)। যার প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই-ই (তবক দেওয়া পান, ১৯৭৫) বাংলা সাহিত্যে এনে দেয় তার পরিচিতি। ছিলেন হাস্যোজ্জ্বল এক মানুষ। অসম্ভব উচ্ছ্বাসের প্রাণবন্ত এক নাম। গায়ে দীর্ঘ পাঞ্জাবি আর কাঁধে ঐতিহ্যের ঝোলা। তবক দেওয়া পানের রসে সিক্ত হওয়া আরক্তিম ঠোঁট। মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে মধুমিশ্রিত সব কথা। আর আমরা যেন একদল পিঁপড়েশ্রোতা হাঁ করে খেয়ে যাচ্ছি মধুময় সব কথা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একাই মাতিয়ে রাখতেন আসর। রেডিও ও টেলিভিশনে তার উপস্থাপনা ছিল অসাধারণ। আবৃত্তি ছিল চমৎকার। দুহাত ভরে লিখে গেছেন। দিয়ে গেছেন বাংলা সাহিত্যকে শতাধিক বই। কবিতা, ছড়া, শিশুতোষ রচনা, জীবনীগ্রন্থ, প্রবন্ধ ও অনুবাদসাহিত্য। কঙ্গোর প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বার নিহত হওয়াকে কেন্দ্র করে লেখা আসাদ চৌধুরীর কবিতা রণেশ দাশগুপ্ত প্রথম ছাপান দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগে। পরবর্তী সময় যা অনূদিত হয় আটটি ভাষায়। তার জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজ কী? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি সবসময় বলে এসেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণের কথা। মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তির কথা উঠে এসেছে তার লেখায় ও কবিতায়। তখন পৃথিবীর নদীর জলে, বৃষ্টিতে, বীরাঙ্গনার দৃষ্টিতে, গানের সুরে আর কবিতায় আগুন ছিল। আর এখন এসব উপকথা।

আগুন ছিল মুক্তি সেনার/স্বপ্ন-ঢলের বন্যায়/প্রতিবাদের প্রবল ঝড়ে/কাঁপছিল সব-অন্যায়।/এখন এ-সব স্বপ্নকথা/দূরের শোনা গল্প, তখন সত্যি মানুষ ছিলাম, এখন আছি অল্প। [তখন সত্যি মানুষ ছিলাম]

কবিতায় আসাদ চৌধুরী তার সামগ্রিক জীবন ও ভাবনাকে অঙ্কন করেছেন। তার কবিতায় আছে প্রতিবেশ ও আবেগ। আছে ঐতিহ্য ও মরমি চেতনা। আছে ক্রোধ ও ঘৃণা। আছে প্রেম ও নারী। তবে এ প্রেম একান্ত ব্যক্তিগত নয়। এ প্রেম দ্রোহের। এ প্রেম মুক্তির। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে খোলা চিঠির আদলে লেখা তার নন্দিত কবিতা ‘বারবারা বিডলার-কে’। এ কবিতা আমাদের সংগ্রামের দলিল। নৃশংসতার বিরুদ্ধে ঘৃণার প্রকাশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিশালতার প্রকাশ। তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়- /বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ওটা একটা জল্লাদের ছবি...জর্জ ওয়াশিংটনের ছবিওলা ডাকটিকেটে খোঁজ থাকবে না স্বাধীনতার/আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে এসো। [বারবারা বিডলার-কে]

অনূদিত কবিতার ভা-ারে আসাদ চৌধুরী কাজ খুবই সমৃদ্ধ। দুই হাজার সালে প্রকাশ হয় ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর: বাংলাদেশের উর্দু কবিতা’ বইটি। তার অনুবাদের হাত ধরে জানতে পারি নওশাদ নূরীর কথা। যিনি ছিলেন ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রতিষ্ঠিত প্রগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন বিহার শাখার সেক্রেটারি। যিনি অবাঙালি উর্দুভাষী হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির পক্ষে, বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন ও কলম ধরেছেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকসেনাদের দমন-পীড়নের প্রতিবাদে লিখেছেন ‘ছাব্বিশে মার্চ’ কবিতা। “চারিদিকে রক্তের ফোয়ারা/ঠোঁটগুলো বন্ধ আর মৃত্যুর নিস্তব্ধতা/কাগমারীতে, সন্তোষে, টুঙ্গিপাড়ায়- সবখানে/আহত পরিবেশে কানে-কানে নিচু স্বরে আলাপ।....এখন, এই ঢাকাতে, করাচির কল্পনা দুঃখজনক,/কাগান থেকে রাঙ্গামাটির দূরত্ব আজ/অনেকগুণ বেড়ে গেছে।/সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হওয়াই একমাত্র পথ,/আর কোনো ওষুধ নেই;/ঘৃণার প্রচ- আবেগ ছাড়া এখানে আর কিছুই নেই,/জনগণের প্রচ- বিদ্রোহ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।” আসাদ ভাইয়ের বহুমাত্রিক কাজের ভিড়ে আমরা চাইলেই হয়তো ছুঁতে পারব তাকে তার বইয়ের পাতায় পাতায়, তার লেখনীর চিন্তায়। আসাদ ভাই ওপারে শান্তিতে থাকুক এই প্রার্থনা। আর বারবারার সাথে আমরাও যেন তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে রবিশঙ্করের সুরে সুরে গেয়ে যাই মুমূর্ষু মানবতার গান।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫