
দ্য উইলো ট্রি চলচ্চিত্রের পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
পরম বিস্ময়, প্রভূত আনন্দ ও ক্লান্তিহীন ব্যাকুলতা নিয়ে এমন দৃশ্যাবলির সামনে স্থির দাঁড়িয়ে থাকা যায়। যাতে সারাটা সময়জুড়ে কেবলই এক অতীন্দ্রিয় আবেশ দর্শককে জড়িয়ে রাখে। যা মস্তিষ্ক হয়ে শরীরের প্রতিটি কোষ, শিরা-উপশিরা ছাপিয়ে গ্রন্থিত এক ভাবালুতায় স্তব্ধ করে দেয়। আসলে জীবনমুখী কিংবা মিস্টিসিজম চলচ্চিত্রে দর্শন, শিল্প, জীবনবোধ, জরা, আনন্দ, স্থবিরতা, অধ্যাত্মবাদ এসবের সংশ্লেষ থাকেই। বিগত এক-দেড় শতকে এজাতীয় সিনেমার প্রাচুর্য না থাকলেও, উল্লেখযোগ্য বেশকিছু সিনেমা আছেই। কিন্তু ‘দ্য উইলো ট্রি’ (বেদ-ঈ-মাজনুন) বোধকরি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। মাত্র নব্বই মিনিটের একটি সিনেমা। অথচ এর আবেদন, ঘটমান দৃশ্যপট, অঘটনীয় বিষয়াদির অস্পষ্ট ইঙ্গিত, সংগীত, প্রকৃতিসহ এমনকি একটি পতঙ্গেরও এমন জীবন্ত চিত্রায়ণ!- কেন যেন অনিবার্য পরিণতির দিকে যেতে অবাধ্য করতে চায়। ইচ্ছে করে সন্ধের মতো নিবিড় হয়ে এর বিস্তৃতির মাঝে ঢুকে যেতে। একটি অণুর মতো প্রতিটি দৃশ্যের মাঝে প্রবেশ করে এর গভীরতা হাতড়ে দেখতে। যেখানে পরিচালক মাজিদ মাজিদি এমন সব চিত্র ও চরিত্রের অবতারণা করেছেন, যা শিল্পকে আরও শিল্পিত আরও প্রগাঢ় করে তুলেছে। এর প্রতিটি দৃশ্য এমনই কাব্যিক, এমনই বর্ণনামুখর, বুঝি সমস্ত সময় ধরে কানে কানে কিছু গুনগুন করে। যা দেখছি আর যা দেখছি না, যা ভাবছি আর যা ভাবছি না- সবকিছুই যেন অধ্যাত্মবাদের মতো স্নিগ্ধ, শান্ত, একীভূত ও প্রাঞ্জল হয়ে ওঠে।
ক্রমলঘু ভাবসমন্বিত ফরমুলা আর মেটাফর, একেবারে গাঁথুনির মতো মিশে গিয়েছে তাতে। ফলে ছবিতে দৃশ্যায়িত একটি পিঁপড়া, কাঠ, আখরোট এমনকি স্নো-ও সুসঙ্গত এক দ্যোতনায় বেজে উঠেছে। কারণ শুধু ইরানি চলচ্চিত্র কেন, বরং পুরো বিশ্ব চলচ্চিত্রেই জীবনের এই রূপ ফুটিয়ে তুলতে পারা মাজিদির কাছে যে ‘everything must mean something’ (সমস্ত কিছুরই কিছু না কিছু মানে হবে)। যে বিশ্বাস, বোধ ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিনি নির্মাণ করলেন ‘দ্য উইলো ট্রি’। তাতে ঢেলে দিলেন সন্ধ্যারাগের মতো নিজের সবটুকু আলো। প্রতিটি চরিত্র থেকে বের করে আনলেন সে আলোর দ্যুতি। সে দ্যুতি এমন উজ্জ্বল, এমনই বিভাময়- বহুদূর থেকে যা চেনা যায়। যা দেখে নিশ্চয় তার পূর্বসূরি মাসউদ কিমিয়াই, দারিউশ মেহেরযুই আলিঙ্গনের জন্য দুবাহু প্রশস্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মহান আব্বাস কিয়ারোস্তামি সানন্দে তার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিলেন। কেউ কেউ মুচকি হেসে উঠোনে ফুটে থাকা একটা ছোট্ট ফুল তুলে তার কোটপকেটে গুঁজে দিচ্ছেন।
যেভাবে একটা ফুল গুঁজে দিয়েছিল এই ছবির নায়ক ইউসেফকে (Parvis Parastui) তার স্ত্রী রয়া (Ro-a Taymourian)। আহা, মাত্র পাঁচ-ছটি প্রধান চরিত্রের উপস্থিতিতে একটা ছবিকে যে এই মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যায়, তা ভাবলেই কেমন একটা শিহরণ জাগে। সেই সাথে প্রতিটি অংশের সঙ্গে পরবর্তী অংশগুলোর এমন যোগসাজশ; প্রতিটি মুহূর্তে যাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ ও চিন্তা একীভূত হয়ে থাকে। যখন এর প্রারম্ভটাই কবিতার শ্লোকের মতো এমন কয়েকটি বাক্য দিয়ে, নির্দ্বিধচিত্ত যা শুনছি ঠিক, কিন্তু কিছু বোঝার আগেই এর বক্তার জন্য হৃদয়টা মোচড় দিয়ে ওঠে। তারপর যখন বুঝতে পারি ইউসেফ তার প্রভুর সঙ্গে কিংবা আপনমনে এই কথোপকথন বা অভিযোগ করছে, তখন পাতার মর্মরধ্বনির মতো তা গুনগুন বাজতে থাকে। তার জীবনের প্রতি প্রগাঢ় এক মমতার সাথে অসংখ্য চিন্তা আগ্রহী হয়ে এসে চোখের উপর ঝুঁকে পড়ে। এই ধারায় কয়েক মিনিট অতিক্রান্ত হতেই জগদ্বিখ্যাত সুফি রুমি আর শামস আত্ তাবরেজির কিঞ্চিৎ উল্লেখের মাধ্যমে যে সংকেত পাওয়া যায়, তাতে ধীরচিত্তের জন্য অবচেতনেই মন তৈরি হয়ে যায়। যেন এরপর যা-কিছুই মঞ্চস্থ হচ্ছে, যা-কিছুই দেখানো হচ্ছে কিংবা যা দেখানো বা বলা হবে- প্রতিটি জিনিসই নির্ধারিত গতির মধ্যে। সমস্ত কিছুই পরিমিত। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। কোনো হৈচৈ নেই। বরং সবকিছু বড় প্রশান্ত, বড় অচঞ্চল এক কায়দায় ঘটে যাচ্ছে। যেখানে মৃদু বাতাসে দোদুল্যমান পাখির নীড়ের মতো প্রথম কম্পনটুকু লাগে চোখের চিকিৎসার জন্য ইউসেফের ফ্রান্সে প্রস্থানের আগের রাতে। যে রাতে নিজের পড়ার টেবিলে বসে খাতায় এই কটি কথা লিখে যে, ‘তোমাকে কিছু বলার আছে আমার? আমার সম্বন্ধে সবকিছু কি একেবারেই ভুলে গেছ তুমি? আমি ইউসেফ। সেই একজন, যাকে তুমি পৃথিবীর এ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত করেছ এবং কখনোই অভিযোগ করেনি যে। আলো এবং উজ্জ্বলতার পরিবর্তে আঁধার ও বেদনার ভেতর বাস করেছি আমি। কিন্তু কোনো আপত্তি বা প্রতিবাদ করিনি। শান্তি ও সুখ বলতে যা, তা এই ছোট্ট স্বর্গেই খুঁজে নিয়েছি। কষ্টের এই এতগুলো যন্ত্রণাকাতর বছরগুলো কি যথেষ্ট নয় যে, এখনো আমায় আরও কষ্ট দিতে চাও? এই যাত্রা থেকে আমি কি আবার আমার প্রিয় পরিবারের কাছে ফিরে আসব? আমার সঙ্গে তুমি যা করেছ, তা কার কাছে অভিযোগ করব? তোমার কাছে আরও ধৈর্য ভিক্ষা চাচ্ছি আমি। আমার জীবনটা কেড়ে নিও না।’ বেদনাব্যঞ্জক এ চিঠিতে স্পষ্টই ইউসেফ আল্লাহর কাছে তার বর্তমান দুর্দশার অভিযোগ করছে। তারপর আবার তা ভাঁজ করে সযতেœ জালালুদ্দিন রুমির মিস্টিক্যাল মাস্টারপিস মসনবী শরিফের ভেতর লুকিয়ে রাখছে। ফলে আক্ষরিক অর্থেই জীবন, স্রষ্টা, ধৈর্য, জগতের সৌন্দর্য- ইত্যাকার বিষয়ে তার যে ভাবনা এখন তা দ্বান্দ্বিকতাপূর্ণ হলেও ক্রমশ বিভিন্ন পর্যায়ে তা পরিবর্তিত হবে। নতুন এক জীবনের প্রতি, বাঁধনহীন এক যাপন ও নতুন প্রেমের প্রতি তার আকাক্সক্ষা জাগবে। যা তার অন্ধত্ব ও পুনরায় দৃষ্টি ফিরে পাওয়া- এ দুটো জীবনের নিগূঢ়তা, অক্ষমতা, আকাঙ্ক্ষা ও পরিহাসকে ফুটিয়ে তোলে। যে দুটো জীবনের পারস্পরিক চরিত্র ইউসেফ তার নিজের ভেতর এমনই বাস্তবিকভাবে ফুটিয়ে তোলেন, যার সামনে সুস্থতা ও একজন সক্ষম মানুষের যাপনকে সম্পূর্ণ অকার্যকর, নিষ্ফল মনে হয়। যেন অভিনয়শিল্পের সমূহ দক্ষতা আত্মস্থ করে, কোনোরূপ আভরণহীন ভণিতা ছাড়াই আমাদের সম্মুখে এমন একটা জীবন তুলে ধরেছেন, যা দেখে আমরা আপন চরিত্র ও আত্মা সম্বন্ধে সজাগ হই।
আলঙ্করিকভাবে যে সজাগ ও জাগরণের বিষয়টি স্পর্শ করে বলি ‘দ্য উইলো ট্রি’ আসলেই একটি পারমার্থিক মাস্টারপিস। যা সাধু-সন্ত ও সুফিদের হৃদয়ের সুপ্রিয় বিষয়-আশয় এবং রুমির কবিতায় কৃতজ্ঞতা, রূপান্তর ও ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করে। যেখানে ইউসেফের এক জীবন থেকে অন্য জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে তার রূপান্তরের বিষয়টিও উপলব্ধ হয়। অর্থাৎ তার দৃষ্টিহীন অন্ধকার জীবন: যা ইন্দ্রিয় এবং অপরের সাহায্য ও যোগাযোগের ওপর নির্ভর করত, তা থেকে এমন এক আলোর জীবনে যায়, যেখানে সে তার দৃষ্টিশক্তির ওপর নির্ভর করে এবং খুব দ্রুতই স্বার্থপরতা ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে যায়। যে নতুব জীবনে তার মাঝে ক্রুদ্ধতা আসে এবং যা তার অতীতের ছোট্ট স্বর্গের কথা মুছে দেয়। যে স্বর্গে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিল তার স্ত্রী রয়া। কিন্তু দৃষ্টি ফেরার পর এখন তার মাঝে প্রেমের সঞ্চার হয়েছে। অন্য নারীর প্রতি তার ঈষৎ আসক্তি জন্মেছে। যার ফলে এতকাল জীবনের যে বহতা ছিল, এখন তার কাছে তা বিসদৃশ লাগে। যে রয়া সমস্ত জীবন ধরে তাকে আগলে রেখেছে, তাকে তার মাতৃসুলভ আচরণকারী মনে হয়।
এভাবে জীবনের নানা দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবিধ পর্যায়ের খুব অল্প একটা সময় পর আবার যখন সে তার পূর্বাবস্থায় ফিরে যায়, তখনই যেন রহস্যের মতো গল্পটি আরও ঘনীভূত হয়। জীবন সম্বন্ধে ইউসেফ পুনর্বার ভাবে। বুঝতে পারে এমতাবস্থায় তার একমাত্র উপায় ত্যাগ ও আত্মসমর্পণ।
মোটকথা, ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ বিষয়ে দুঃসাধ্য এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাজিদি আমাদের চক্ষু উন্মেষ করেছেন। অতএব এ আশ্চর্য নয় যে, ছবির শেষ দিকেও মসনবীর দ্বিতীয় উপস্থিতি। কেননা সুফিবাদে আত্মসমর্পণকেই সমস্ত কিছুর চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়। যা মাজিদি আর পারভিস পূর্ণাঙ্গরূপে চিত্রিত করেছেন। সেই সাথে মাহমুদ কালারি, বাহরাম বাদাকশানি ও মুহাম্মদ দাউদির সিনেমাটোগ্রাফিতে যে কোমল বিষণ্ণতা আর ভাবাবেগ সমস্ত সিনেমাজুড়ে, তার বৈচিত্র্য ও বেদনাময় সৌকর্য পূর্ণতা পেয়েছে আহমাদ পেজমানের মিউজিকে। যেন প্রতিটি রাগেই, দৃশ্যের পেছনে বেজে ওঠা প্রতিটি টানেই মোজার্টের কথা মনে পড়ে। বুঝি তার সংগীতের সেই আভা, পেজমানের সৃষ্টিতে মেদুর হাওয়ার মতো মিশে যাচ্ছে। তা থেকে বেদনাময় আনন্দরা উইলো গাছের ওপর টুপটাপ ঝরে পড়ছে।