আবু ইসহাকের ‘মহাপতঙ্গ’ যেভাবে কালোত্তীর্ণ গল্প হয়ে উঠেছে

অলোক আচার্য
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৩, ০৯:৩৬

গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় গল্পকার ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবু ইসহাকের একটি উল্লেখযোগ্য গল্প হলো মহাপতঙ্গ। দেশ কাল পাত্রভেদে যেন গল্পটি সব দেশের, সব মানুষের এবং সময়ের জন্যই প্রাসঙ্গিক। গল্পটি কেন কালজয়ী সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে গল্পটি সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার। গল্পের পটভূমি, গল্পের চরিত্র এবং গল্পের ধারাবর্ণনা গল্পটিকে অমরের স্থান দেয়। মানুষের সভ্য বা অসভ্য আচরণ এবং তার ফলশ্রুতিতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনার একটি রূপক হলো মহাপতঙ্গ গল্পটি। গল্পকারের এ ধরনের রূপক গল্প আরও রয়েছে। আবু ইসহাক বাংলাদেশের একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। তিনি তার লেখনীধারায় বেশ জনপ্রিয়ও।
তিনি ১৯৪৬ সালে, মাত্র বিশ বছর বয়সে রচনা করেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ এবং এটি প্রকাশ করা হয় ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে। এটি একটি সামাজিক উপন্যাস। এখন পর্যন্ত উপন্যাসটি পাঠকের কাছে জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্য রচনাসম্ভার সংখ্যার বিচারে স্বল্প হলেও বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের এক উজ্জ্বলতম নাম আবু ইসহাক। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মৌলভী মোহাম্মদ এবাদুল্লা ও আতহারুন্নিসা দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে আবু ইসহাক ছিলেন পঞ্চম। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের খণ্ড চিত্র যেমন স্থান পেয়েছে তার লেখনীতে তেমনি বাংলার স্বাধীনতাপরবর্তী চিত্রও তুলে ধরেছেন তার সাহিত্যকর্মে।
আবু ইসহাক বাংলা ভাষার নতুন ধরনের অভিধান প্রণেতা হিসেবেও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জোঁক গল্পটি। জোঁকের বৈশিষ্ট্যের সাথে সমাজের কিছু মানুষের বৈশিষ্ট্যের মিল বা তুলনা করে ঘৃণা উগরে দেওয়াই এ গল্পের বিষয়বস্তু। আবার মহাপতঙ্গ গল্পটিও কিন্তু সেরকমই। এখানে সমগ্র মানবজাতিকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে সভ্যতা ধ্বংসের দায় হিসেবে। মূলত সভ্যতা গড়ার কারিগর যদি মানুষ হয় তাহলে সভ্যতা ধ্বংসের দায়ও মানুষেরই হবে! এটাই বাস্তবতা। মহাপতঙ্গ গল্পে লেখক মানুষের যুদ্ধ মনোভাবকে যেমন ব্যক্ত করেছেন, তেমনি মানুষের বুদ্ধির প্রশংসা, মানুষের কর্মদক্ষতারও প্রশংসা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রতি ধিক্কার উঠেছে। কিন্তু কেন এই ধিক্কার! ঠিক এই সময় পৃথিবীতে যুদ্ধ চলছে।
শতাব্দীর অন্যতম যুদ্ধ রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে চলছে। যুদ্ধে মানুষ নিহত হয়েছে, হচ্ছে এবং ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। যুদ্ধের এটাই পরিণতি। কে দোষী বা কে নির্দোষী অথবা কে যুদ্ধ চায় আর কে চায় না সেটা যাচাই করে না। গুলির বা বোমার আঘাতে নির্বিচারে প্রাণ হারায় সকলেই। সে অর্থে আবু ইসহাকের মহাপতঙ্গ গল্পটি মূলত সে কারণেই কালজয়ী একটি গল্প। গল্পটিতে অত্যন্ত কৌতুকপূর্ণ কিন্তু সূচারুভাবে লেখক যুদ্ধের ভয়াবহতার চিত্র ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। গল্পটি ছাত্রজীবনে পাঠ্য একটি গল্প। গল্পের চরিত্রে রয়েছে দুটি চড়ুই পাখি। গল্পটিতে মহাপতঙ্গ বলতে মূলত যুদ্ধ বিমানকে বলা হয়েছে। পাখির ভাষায় এরা মহাপতঙ্গ। তবে পাখিরা যেমন পেটে করে ডিম বহন করে বিপরীতে মহাপতঙ্গ তাদের পেটে বহন করে মারণাস্ত্র বোমা। সেই বোমা মাটিতে পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটায় এবং চারপাশটা ধ্বংস করে দেয়। চড়ুই পাখিগুলো বোঝে না কীভাবে এই বড় বড় পাখির ডিমগুলো এতটা ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে! গল্পে গল্পকার আবু ইসহাক কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন যেগুলো পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে। চড়ুই পাখি যখন তার বাচ্চাদের তাদের শুত্রু সম্পর্কে ধারণা দেয় তখন এই শব্দগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে। তাদের ভাষায় বিড়ালকে বলছে ম্যাও খোক্ষস, সাপকে বলছে কুণ্ডলী ফোঁস ফোঁস, কাককে বলছে কাঁ ভোক্ষুস, আর চিলকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ছোঁ রাক্ষস হিসেবে। এখানেই গল্পের মজা। এভাবে গল্পের ভেতর উপমা টেনে আনা বেশ দক্ষতার সাথে করতে হয়। কারণ গল্পের বর্ণনাকারী মানুষ না, চড়ুই পাখি। গল্পের শুরু চড়ুই পাখির খাবার খুঁটে খাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। ঠিক সেসময় ওরা শব্দ পায় যুদ্ধ বিমান উড়ে আসার। ওদের কাছে অনেক বিপদের মতো পরিচিত শব্দ ছিল সেগুলো। শিশুকালে আমরা যেমন মা-ঠাকুমার মুখে রাক্ষস-খোক্কসের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি, চড়ুই পাখিও তাই। তারাও বিপদের গল্প, রাক্ষসের গল্প, খোক্কসের গল্প শুনে বড় হয়েছে। চড়ুই পাখিরও ধারণা ছিল ওদের গল্পে শোনা সেই রাক্ষসটাক্খস হবে হয়তো! ওদের ধারণা ছিল এসব ছোঁ রাক্ষসের গল্পই ওরা শুনত যে বোঁ বোঁ শব্দ ওরা শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু চড়ুই পাখি দুটো জানতে না এসব ছোঁ রাক্ষস তাদের গল্পে শোনা রাক্ষসের থেকেও ভয়ঙ্কর। বিমানের বোঁ বোঁ শব্দে তখন পুরো পক্ষিরাজ্যই ভীত-সন্ত্রস্ত। এমন ভয়ঙ্কর ছোঁ রাক্ষস তারা কোনোদিন দেখেনি। অনেক পাখিই এই রাক্ষসের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালায়। যেমনটা দেশে যুদ্ধ শুরু হলে প্রাণের ভয়ে মানুষ পালায়, সেরকমভাবে।
এখানে গল্পকার পাখি দিয়েই মানুষের উপমা বুঝিয়েছেন। কিন্তু সেই দুটো চড়ুই পাখি দেশ ছাড়ে না। বিপদের ভয় থাকলেও খাদ্যের পর্যাপ্ততার জন্য সেখানেই সুখের নীড় রচনা করতে থাকে। এর মধ্যেই দেশে বন্যা হয়। সেই বন্যায় পালিয়ে যায় চড়ুইয়ের ভাষায় অনেক দুপেয়ে দৈত্য মানে মানুষ। কিন্তু চড়ুই দুটো পালাতে পারে না। কারণ তাদের যে তত দিনে দুটো সন্তান এসেছে। সন্তান ছেড়ে কীভাবে তারা পালাতে পারে! বন্যায় সাহায্য করার জন্যও এসব মহাপতঙ্গ আসে। বিপদগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে উড়ে যায়, নিরাপদ দূরত্বে রেখে আসে। ওরা মানুষের বুদ্ধির প্রশংসা করে। তারা কীভাবে বিভিন্ন প্রাণীকে পোষ মানিয়ে নিজেদের আয়ত্ত করেছে সেই কথা বলে। আবার যখন তীব্র খরা হয় তখনো এসব মহাপতঙ্গ খাদ্য এনে মানুষকে সাহায্য করেছে। সেই খাদ্যে তারাও খাবার পেয়েছিল পেটপুরে। কী আশ্চর্য মহাপতঙ্গ মানুষ পোষ মানিয়েছে। একসময় মহাপতঙ্গ আবারও আসে। চড়ুই দুটো ভেবেছিল তারা মনে হয় সেবারের মতো খাবার বহন করে এনেছে। বাচ্চাদের আবদারে তারা মহাপতঙ্গ দেখতে ছুটে যায়। কিন্তু না এবার আর তারা খাবার বহন করে আনেনি মহাপতঙ্গ। এবার এনেছে মারণাস্ত্র! বুম বুম শব্দে মহাপতঙ্গের পেট থেকে বোমা বের হয়। যদিও প্রথমটায় চড়ুই ভেবেছিল এগুলো মনে হয় মহাপতঙ্গের ডিম। ওরা জানত না এই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটে না, এই ডিম সব ধ্বংস করে দেয়। হারিয়ে যায় চড়ুই দম্পতির বাচ্চা, সংসার। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ছিঃ ছিঃ ছিঃ। এই ছিঃ বা ধিক্কার আসলে মানবজাতির জন্য। বিজ্ঞান আমাদের অনেক দিয়েছে। দুহাত উজাড় করে দিয়েছে। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছি ভিন্নভাবে। ‘মহাপতঙ্গ’ গল্পে দুভাবে বিজ্ঞানের ব্যবহারকেই চমৎকাররূপে উপস্থাপন করেছেন। আবার মানুষের ধ্বংস করার এবং নিচু মানসিকতারও উল্লেখ করেছেন। এটাই মানুষ। কখনো মানুষের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে যায় আবার কখনো মানুষের প্রাণ নিতে।