
শামসুর রাহমান। ফাইল ছবি
শামসুর রাহমান ছিলেন আমাদের সমকালে শ্রেষ্ঠ কবি প্রতিভা। তার সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অঙ্গীকার পালন বাংলাদেশের সমাজ জীবনে শিল্পীর স্বাধীন ও অকুতোভয় অবস্থানকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। আমাদের সুখে ও দুঃসময়ে, আনন্দগানে ও প্রতিরোধ মিছিলে তিনি সাধারণের পাশে ছিলেন আমৃত্যু। কিন্নরকণ্ঠ এই কবিপুরুষ আধুনিক বাংলা কাব্যের সমুন্নত এক ভূখণ্ডের সম্রাট ছিলেন। বাঙালির সৃজনমনীষা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা, সংগ্রাম ও বিজয়ের পরম্পরা সংহত হয়ে তার কাব্যশরীরে ব্রীড়াময় হয়ে আছে- থাকবে। চিরায়ত বাংলা কবিতায় অমরবৃন্দের সঙ্গে তিনিও থাকবেন জ্যোতির্ময় হয়ে। তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার মুকুটহীন সম্রাট।
শামসুর রাহমান কবিতা লেখা শুরু করেন ১৯৪৮ সাল থেকে। তখন তার বয়স ১৯ বছর। প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় নলিনী কিশোর গুহ সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’য়। সেই কবিতার নাম ছিল “উনিশ’শ ঊনপঞ্চাশ”। ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ। বাংলা ১৩৬৬ ফাল্গুন ছিল এই বইয়ের প্রকাশ কাল। ‘বার্ডস এন্ড বুকস’ নামের ঢাকার একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বইটি বের হয়েছিল। ‘প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রকাশিত তার বইয়ের বেশিরভাগ প্রচ্ছদই শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর করা। ‘শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংকলনের প্রচ্ছদ শিল্পীও ছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী।
শামসুর রাহমানের মৃত্যুর পর শহীদ মিনারে শোক সভায় খ্যাতিমান কবি ও কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক বলেছিলেন, “শামসুর রাহমান আমাদের স্বাধীনতার কবি।” বাস্তবিক অর্থেই শামসুর রাহমান আমাদের মুক্তি স্বপ্ন সংগ্রাম ও স্বাধীনতাকে তার কবিতায় ধারণ করেছেন গভীরভাবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনাকালেই সেই ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় লেখা তার ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি হয়ে ওঠে বাঙালির সংগ্রাম ও চেতনার ইশতেহার। আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি লিখছেন, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা; গেরিলা, ‘বন্দী শিবির থেকে’ এইসব কবিতা। মুক্তিযুদ্ধকালে তার কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের হৃদয়ে প্রেরণা সঞ্চার করত। অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ নির্যাতন, ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে আমৃত্যু সংগ্রামী ছিলেন কবি শামসুর রাহমান। অন্যায়ের সাথে অশুভের সাথে কখনো তিনি আপস করেননি। মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষের প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। আর তাই তার ‘স্বাধীনতার কবি’ এই উপাধি- যথার্থই বলেছেন, বাঙালির আরেক অহংকারের কবি ও কথাকার- সৈয়দ শামসুল হক।
রাজনীতি বিমুখ-জীবনবিমুখ শিল্পসম্পন্ন নান্দনিক কবিতা লিখে বিশুদ্ধ কবির ভান করেননি কবি শামসুর রাহমান। এখানেই তার স্বকীয়তা ও মৌলিকত্ব। তিরিশের কবিদের ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ ধারণাকেও বাতিল করে দেন তিনি। বাংলা কবিতায় নতুন এক ধারার প্রবর্তন করেন তিনি। রাজনীতি ও সমাজ পরস্পর হাত ধরে চলেছে তার কবিতার পথে পথে। এই পথ একান্তই তার নিজেরই সৃজন। স্বাধীন বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের প্রথম দ্রোহ ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি লেখেন অমর পঙ্ক্তিমালা- ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। এ অবিনাশী কবিতা ভাষা আন্দোলন তো বটেই, ধারণ করে আছে বাঙালির স্বপ্ন আকাক্সক্ষা উত্থানের ইতিহাসকে। তার ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯; মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে লেখা ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে নিহত আসাদকে নিয়ে লেখা ‘আসাদের শার্ট’, ‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’, ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘ধন্য সেই পুরুষ’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এরকম অসংখ্য রাজনীতি ও সমাজভাবনা বিষয়ক কবিতা শামসুর রাহমান রচনা করেছেন। তার কবিতায় বারবার এসেছে সমাজের অবহেলিত দুঃখী মানুষের জীবন, বৃহত্তর গণমানুষের কল্যাণ চিন্তাও তার লেখায় আমরা দেখতে পাই। শামসুর রাহমান ছিলেন এই বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোর এক নিপুণ চিত্রকর।
শামসুর রাহমান নেই, প্রিয় রাহমান ভাই আপনি নিষ্পাপ নিসর্গে বনানীতে মায়ের কবরস্থলে মায়েরই কোলে বসে অলৌকিক চোখে দেখছেন- হায়! আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশ! রাহমান ভাই আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে আপনি কি এখনো ঈশ্বরের সুন্দরী হুরদের আড্ডায় বসে লিখে যাচ্ছেন কবিতা- ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা...।’