Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বিল্লা

Icon

শেখ লুৎফর

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৩, ২০:২৩

বিল্লা

প্রতীকী ছবি

মন-মেজাজের দিক থেকে কামাল ঠান্ডা, চিন্তাশীল ও সন্দেহপ্রবণ। কিন্তু টাকা কামাই করা ও তা ধরে রাখার বিষয়ে তার যুক্তিসঙ্গত স্বপ্নটা খুব স্পষ্ট। তাই সে কৃপণ ও পরিশ্রমী। কিন্তু নারী বিষয়টা তার কাছে জটিল, আঁকাবাঁকা ও পরত পরত অন্ধকার পথে হঠাৎ গর্তে পড়ে যাওয়ার সন্দেহে ঠাসা। এইসব কারণে সে বিষণ্ণতায় ভোগে।

ঘনিষ্ঠজন ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে একটু আলাপ-আলোচনা শুরু করলেই মানুষটা বিষয়ে মনে মনে সে সতর্ক হয়ে ওঠে। নানা রকম সন্দেহ উঁকি মারে। মিনমিনে স্বভাব ও অন্তর্মুখী জটিলতার জন্য সে নিঃসঙ্গ। কিন্তু গভীর। শক্ত-পোক্ত শরীরের কামাল মাছ-গাছ আর সঙ্কর জাতের দশটা গাভী নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে খাটতে খাটতে ফর্সা রঙটা পুড়িয়ে কালচে বাদামি করে ফেলেছে। সুষম খাদ্য বিষয়ে ধারণা রাখে বলে সে রোজ সকালে একটা হাফ-বয়েল ডিম, দুইটা কলা আর নিজের গাইয়ের গরম গরম এক গ্লাস দুধ দিয়ে নাশতা করে। দুপুরে মাত্র এক থালা ভাত, সঙ্গে শাক-সবজি ও এক বাটি ডাল। ছানার ডাল, মাষকলাইয়ের ডাল... মাছের মাথা দিয়ে মাখামাখা মুগডাল তার প্রিয়।

প্রবাসে তার বস ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রসুল সাহেব। তিনি মেধাবী, বিচক্ষণ আর দক্ষ প্রকৌশলী হলেও সাধু টাইপের মানুষ ছিলেন। ভগবান-ঈশ্বর-খোদা, এই তিন নামে একজন, যিনি আলিফ-দাল-মিম এ আদম রূপে জগতে বিরাজ করছেন। একটু সুযোগ পেলেই তিনি এই বিষয়টি যুক্তি দিয়ে বুঝাতে চাইতেন। কথা বলতেন পুরুষের বীর্য ধারণ, শাসন, ভাত-মাছ এবং শরীর...। মাঝেমধ্যে তিনি খুব জোর দিয়ে বলতেন, আমাদের মনে রাখা উচিত, ভাত-চিনি-লবণ এই তিনটি হলো, হোয়াইট পয়জন।

ফোনে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় কামালের চোখ দুটি খুব উজ্জ্বল দেখায়। খাড়া কিন্তু সামনের দিকে একটু বাঁকা নাকটা লাল হয়ে ওঠে। চওড়া কপালে ঘাম দেখা দেয়। এইসব দেখে বলা যায় কামাল শুধু চাপা স্বভাবের না, নাগা মরিচের ঝালের মতো কামনার জ্বালাও আছে তার দোহারা গড়নের দেহটায়। 

কামালের কোনো পিছুটান নাই। মা-বাবা পরলোকে, বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাইরা সব আলাদা আলাদা এবং তার নগদ টাকা, শরীর-স্বাস্থ্য ও উন্নতির সম্ভাবনাসহ গ্রামের অবিবাহিত মেয়েদের মা-বাপের কাছে সে এক আকর্ষণীয় পাত্র। মেয়েঘটিত বিষয়ে তার নামে ছোটখাটো বদনাম আছে। কিন্তু কোনো কলঙ্ক নাই। ঘাম কিংবা মুখের বাজে গন্ধের মতো পুরুষের চরিত্রে একটু একটু দুর্গন্ধ থাকলে খুব সহজেই দুই নম্বর মেয়েদের প্রিয়পাত্র হওয়া যায়। তাই বর্তমানে গ্রামের কিছু কিছু হুরের নেক নজর আছে তার উপর। মেয়ে মহলের অন্দর-বাহির এবং তার আশপাশের সাধারণ মানুষের জীবনে জল-মাটি-আগুনের উপাখ্যান দেখতে দেখতে সে কিছুটা মানসিক দোটানায় ভুগছে।

প্রবাসে সে কাজ করেছে ১২ বছর। প্রথমে মালয়েশিয়া, তারপর সিঙ্গাপুর। বাপ অভাবী মানুষ ছিল। লেখাপড়ায় ভালো হয়েও বিএ পরীক্ষা না দিয়ে লেবার ভিসায় সে বিদেশে যেতে বাধ্য হয়। অভাব যে কী জিনিস, তা জানা ছিল বলে প্রথম থেকেই তার চেষ্টা ছিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে। তাই যা রোজগার করেছে তার অর্ধেক দিয়েছে পরিবারকে আর বাকি অর্ধেক তার নামে খুব গোপনে ব্যাংকে মজুদ রেখেছিল। একটা পুকুর আর সঙ্কর জাতের দুইটা গাভী নিয়ে শুরু করেছিল। এখন তো স্থাবর-অস্থাবরে রীতিমতো কোটিপতি।

বর্তমানে তার বয়স সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ। বিয়ের জন্য পাত্রী দেখার সময় সে সবার আগে নিজের স্মার্ট ফোনটা মেয়ের সামনে রেখে বিনয়ের সঙ্গে বলবে, আমার ফোনটা স্লো হয়ে গেছে, দেখেন তো সমস্যাটা কী? কামালের বিবেচনায় স্মার্ট ফোন চালাতে পারা মানে নষ্ট জগতেও সে স্মার্ট। তা বাদে শুরু হবে গোয়েন্দাগিরি। মেয়ের মা-খালা-নানি চৌদ্দ গোষ্ঠীর আমলনামা ঘেঁটে, হাতঝাড়া দিয়ে পাত্রীপক্ষকে মাছির মতো তাড়িয়ে দেবে। তাই সে মাঝে মাঝে রাগ করে বলে, ‘উপরে বোরকা-হিজাব, তলে তলে ভাঙা ডাব।’

দুই বেলা খাওয়া ও চারশ টাকা রোজ-বেতনে একজন আধাবুড়ো আছে তার সংসারে। সে রান্না আর গরুর দেখভাল করে। মানুষটা নপুংসক। সংসারে তার কেউ নাই। সারা জীবন ঢাকার বাসা-বাড়ি আর মেসে মেসে রান্নার কাজ করেছে। শেষ বয়সে এসে ঠেকেছে তার ঘাটে। কামাল একদিন তাকে খুব চেপে ধরেছিল, তুমি বিয়া করলা না কেন?

-আমি গোরমা (নপুংসক), দ্যাখ না আমার দাড়িমোচ নাই। 

-তোমার যন্ত্র দেখাও।

বুড়ো রোবটিক গলায় বলে, এইডা ঠিক না।

কামাল কঠিন গলায় হুকুম দেয়, আগে তলের কাপড় ওঠাও।

নির্বিকার বুড়োটা বলে, দ্যাইখা কী করবা, সব সাদা আর যন্ত্রটা খালি পেশাবের কামে লাগে। 

লোকটা গরুর দেখভাল করে, মিষ্টি আর চায়ের দোকানে দোকানে দুধ পৌঁছে দেয় এবং দুই বেলা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাছের পাঁচটা পুকুর, সবজি ক্ষেত, ফল বাগানসহ গোটা খামারটা তকতকে-ঝকঝকে আর এতটা লাভবান হয়েছে শুধু কামালের শ্রমে-ঘামে। সে দানবের মতো খাটতে পারে, সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা। একজন লেবার মানে দিন শেষে পকেট থেকে হাজার টাকার একটা নোট গায়েব হয়ে যাওয়া!

প্রয়োজন ছাড়া কামাল কারও বাড়ি কিংবা কোনো ব্যক্তির কাছে যায় না। পাড়ার অন্য কেউ তার বাড়িতে আসেও না। পায়ের জুতা থেকে বউ, সব-ই এখন পাশের বাজার কিংবা পথে-ঘাটে পাওয়া যায়। এই হলো তাদের গ্রামের বর্তমান সত্য। জীবনের কিছু কিছু মৌলিক সত্যও যে সময় বদলে ফেলে, প্রবাস থেকে দীর্ঘদিন পর ফিরে এসে কামাল তার পরিবার, আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদেরকে দেখে হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করেছে, জীবন বিষয়ে শিখেছে অনেক আচানক আচানক সত্য। এইসব আকাশফোঁড় সত্যের কোনো আলো নাই, সুবাস নাই, আছে শুধু জীবাত্মার হিংস্র-কুটিল রূপ।

সে বসে আছে তার খামার বাড়ির পুকুর পাড়ে বাঁশের মাচায়। মাথার উপর মেহগনি গাছ। পুকুরপাড়ের বাল্বগুলোর সাদা আলোতে তাকে বিষণ্ণ লাগছে। তার সামনে পাঁচটা পুকুর। ডান দিকে ফলবাগান, বাঁ-পাশে ঝিঙা-চিচিঙ্গা আর টমেটোর ক্ষেত। পুকুরের পানি থেকে ফিড আর ভিটামিন ওষুধের বাজে গন্ধ আসছে। তিন বাড়ি উত্তরে জলিলের পোলট্রি থেকে আসছে দমবন্ধ করা বাজে গন্ধ। একটু মুক্ত বাতাসের জন্য মাঝেমধ্যে কামালের বুকটা খাঁখাঁ করে। অবশ্য এখনো রাতে শিয়াল ডাকে, কিন্তু জংলি ফুলের সুবাসের বদলে ইটভাটার ধোঁয়া, পোলট্রি-ফিশারির কু-গন্ধ এখন পদে পদে গ্রামের মানুষকে শুধু টাকা আর মাংসের কথা মনে করিয়ে দেয়। 

রাত ১০টা পেরিয়ে গেলেও গ্রামটা দস্তুর মতো জেগে আছে। ফসলের মাঠ পেরিয়ে পুবের পাকা সড়কের দিক থেকে যানবাহন ছুটে চলার প্যাঁ-পোঁ, ঝনঝন-খনখন শব্দ আসছে। ধানের মাঠ থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙ, পোকা-পতঙ্গদের বিষণ্ণ সুর। হঠাৎ হঠাৎ মকবুলের কলা ক্ষেতের দিক থেকে আসে শিয়ালের ডাক। তবু গ্রামের আঁকাবাঁকা পাকা সড়ক দিয়ে মিনিটে মিনিটে হিস্হিস্ করে ছুটে যাচ্ছে ইজিবাইক। যাত্রী কিংবা চালকের ঠোঁটে জ্বলন্ত সিগারেটের একবিন্দু ভোঁতা আলো... কিন্তু জোনাক পোকার আলো নাই। যে দিকে চোখ যায় শুধু বিদ্যুতের বাতি।

‘বন্ধু আমার হইয়া গ্যাছে ফিশারির পাঙ্গাস,

কই গেলে পাইমু আমি একটুখানি বাতাস।’

কামালের মোবাইল ফোন এই গানে মেতে উঠলে চেয়ে দেখে স্ক্রিনে ঝুমির নাম! ফোনটা সে রিসিভ করে, হ্যালো?

-চিনতে পারছস?

-হ।

-বল তো আমি কে?

-ঝুম্মুর ঝুম্মুর...

-হলো না। ঝুমঝুম বললে আমার ভালো লাগত রে ছাগল।

কামাল হৈ হৈ করে ওঠে, ছাগলা না, ভলভলা পাঁঠা।

মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার সময় কামালের মুখে খৈ ফোটে। ওপাশে ঝুমির গলা হাসিতে খানখান হয়। তারপর তাকে উসকে দিতে ফিসফিস করে বলে, তুই যে পরিমাণ স্টিমরোল চালাস...তুই তো আসলে বাঘা কামাল। তরে আমি স্যাল্যুট...।

কামাল গম্ভীর হয়ে যায়। সে ভাবতে চেষ্টা করে, পুরুষের কাছে নারী আসলে কী চায়?

এই প্রশ্নের জবাবে সে চারপাশে ঝুমির মতো পরকীয়াসক্ত অসংখ্য নারী-পুরুষ দেখতে পায়। কামালের দীর্ঘশ্বাসটা খুব করুণ শোনায়। গ্রামের মানুষ বলে, ‘পাট শাকের লগে লাইগা আইছে একটুখানি গু!’ তেমনি প্রবাসীদের পাঠানো টাকার সঙ্গে...।

কামালকে ঘুম থেকে উঠতে হয় সকাল ৬টায়। বিকাল ৫টার আগে সে নিজের দিকে তাকাবার সময় পায় না। দুপুরে খাওয়াবাবদ মাত্র এক ঘণ্টার ছুটি। তা বাদে দুই নম্বর একটা মেয়েলোকের সঙ্গে খামাকা ভগরভগর করার মতো সময় তার আছে কি?

ফোন-কানে কামাল একটু একটু মাথা নাড়িয়ে আলোচনা সংক্ষিপ্ত করতে চায়, আসল কথা কও।

ওপাশ থেকে ঝুমি জানতে চায়, কী করছস?

ঝুমিকে এখন মনে হয়, সত্যিই সে ফিশারির একটা ফালতু পাঙ্গাস। তাকে শ্রদ্ধা করে তুমি সম্বোধন করার কোনো মানেই হয় না। কিন্তু সে অবিবাহিত এবং কামুক। তাই আপাত আমিষের চাহিদা মেটানোর জন্য রহস্য করে বলে, পুকুরে মাছের মাথা গণনা করছি।

-খালি টাকাই গুনবে। 

-আমার যদি টাকা না থাকত তাহলে ফোন দিতে?

-দিতাম।

-বিশ্বাস করি না।

-তর-আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে দুনিয়ার কিছু আসে-যায় না রে বোকা! শুধু দিন চলে যায়, জীবন আরও জটিল হয়। আমার বিষয়টা তলিয়ে দেখ, স্বামী-সন্তান রেখেও চুরি করে তর সঙ্গে কথা কই। জটিল..., জীবনটা ঘোরতর জটিল। আর এই জন্য তর বিয়েটা করে ফেলা উচিত।

কামাল দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে ঝুমির সঙ্গে গলা মিলায় এবং যত দ্রুত সম্ভব। কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়?

ঝুমির মন খাঁখাঁ করে। সে কামালের বিয়েকে উছিলা করে নিজের মনের কথাগুলো বলতে চায়। তার নিজের বলে একটা জিনিস আছে না, রক্ত-মাংসের দুঃখী আত্মাটা পলে পলে তাকে কামালের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে তাকে মনের দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে হয়।

কামাল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, আমি কপালপোড়া।

ওপাশের জন বিষণ্ণ সুরে বলে, ছেলেদের ভাগ্য বলতে কিছু নাই। চেষ্টা করলে তারা সব পায়। যা-ই হোক, আমার কাছে একটা ভালো মেয়ের খবর আছে।

-কে?

-আমার খাল্লাত্ত বোন লিপা।

-গঁয়েশপুর কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ে যে মেয়েটা...।

-হ।

-না। চলবে না।

-কেন?

কামাল অন্ধকারে ঢিল মারে, বর্তমানে লিপা মোবাইলে কয়েকটা প্রেম চলাচ্ছে।

-কেমনে বললি?

-যেমনে সে চালিয়ে যাচ্ছে।

ঝুমি ফুঁসে ওঠে, তর নাই? তুই সতী? নিজে মেয়েদেরকে নষ্ট করবা আর মনে মনে সতী বউ চাইবা? সেই দিন শেষ। 

কামাল নীরব হয়ে যায়। ঠোঁটে সিগারেট গুঁজে দিয়ে গ্যাস লাইটারে ঘ্যাষঘ্যাষ আওয়াজ তুলে ধরায়। সড়কের পুব দিকের গ্রামগুলোতে এখন লোডশেডিং চলছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে টালমাটাল পৃথিবী। তাই শেখ হাসিনার চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন লোডশেডিংয়ের অন্ধকার ঢেকে ফেলতে চায়। 

অবশ্য এখন অন্ধকার গ্রামগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে কামালের খুব ভালো লাগছে। তার বিবেচনায় নারী মানে এক টুকরো জমাট অন্ধকার। কোনোদিন কোনো পুরুষ যা পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারেনি। কুকুর-কুকুরীর দেখা হলে শুধু গতর শুঁকাশুঁকি করে না মাছিও তাড়ায়। তেমনি অনেকক্ষণ নীরবতার পর ফোনের ওপাশে পানি খাওয়ার শব্দ শোনা যায়। তৃপ্তশ্বাস ফেলার শব্দ হয়। তারপর শীৎকারের ভঙ্গিতে ঝুমি ফিসফিসায়, আসবে?

কামালের কান গরম হয়ে ওঠে। সে সিগারেটে লম্বা দম দেয়। তার ছোট খামারসহ গোটা গ্রামটা বিদ্যুতের আলো আর রাতের অন্ধকার মিলেমিশে ছ্যাঁড়াব্যাড়া, ছন্নছাড়া। সুখটা জমে না। তাই সে আরও গভীর অন্ধকার ভরা পরত পরত জগতের খোঁজে মাঠের দিকে তাকিয়ে ঝুমিকে বলে, হ। আসব।

ওপাশের জন আঠালো গলায় সাবধান করে, খালি হাতে আসবে না।

কামাল উঠে পড়ে। বুড়োটা পুকুরপাড়ের পাহারা ঘরে মরা লাশের মতো চিত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। পুবের বাতাসে তার তলের কাপড় সরে গেছে-লোকটার গোপন জমি সাদা কাশফুলে ছাওয়া বলে মধ্যখানের কালো-কুৎসিত এক খণ্ড মাংসপিণ্ড খুব সহজেই চোখে পড়ে! সে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয়। ওয়াক ওয়াক করে কয়েকবার থুতু ফেলেও মনের ঘিনঘিনে ভাবটা কাটে না। 

একটা বিষণ্ণ, শিরশিরে অনুভব নিয়ে সে পুকুরপাড়, ছোট্ট উঠান পেরিয়ে নির্জন ঘরের বারান্দায় ওঠে। বিষণ্ণ বাড়িটা মানুষের অভাবে খাঁখাঁ করছে। পাশের মেহেদি গাছটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস আসে। বাড়ি করে সবার আগে সে এই গাছটা লাগিয়েছিল। মনে আশা ছিল, ঈদে-চান্দে তার বউ মেহেদি পাতার রঙে হাত রঙিন করবে। 

এক মিনিটের মধ্যে বারান্দা থেকে সে মোটরসাইকেল নামায়, গ্রিলের দরজায় তালা লাগায়। সিঁড়ির পাশের কামিনীগাছ থেকে ভুরভুর করে আসছে পাগলা সুবাস। সে একদম সুঘ্রাণ বুকের মধ্যে ভরে মোটরসাইকেলের চাবি ঘুরায়। তারপর ভম ভম শব্দে পাকা সড়কের দিকে ছুটতে থাকে।

রাত ১১টা হলেও বাজারের অধিকাংশ চা-খানা খোলা। গ্রামের ঘাগু মাতব্বর, পাতি নেতা আর নিশাচর তরুণদের ভিন্ন ভিন্ন এবং ছোট ছোট আসর দেখে সে একটু শান্তি আর মুক্ত বাতাসের আশায় দূরের বোবা প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। মাঠের পরে আলোকিত বাড়িগুলো কত পাশাপাশি তবু ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। বাড়িগুলোর মধ্যখানের আবছা আলো-অন্ধকারকে মনে হয় নো-ম্যান্স-ল্যান্ড। কামালের আরও মনে হয়, আজ মানুষের কোনো দেশ নাই, সমাজ নাই। সে এক নিঃসঙ্গ শিকারি-বিকৃতমনা নিষ্ঠুর। টাকা আর নারী-মাংস তার একমাত্র অভীষ্ট।

বাজারে শুধু জবান ডাক্তারের ওষুধের দোকানটাই খোলা। দুধের সঙ্গে সর খায় বলে গ্রামের অনেকই লোকটাকে ‘দুই নম্বর’ বলে ডাকে। ডাক্তার তাকে দেখেই বিটকেলে হাসি দেয়, এত রাইতে?

-হ।

-তাইলে বস।

সে হোন্ডাতে বসে বসেই ডাক্তারকে খোঁচায়, এখন অমাবস্যা চলছে না?

-হ।

-আজ রাতে মিরর কার্প মাছ ফিশারিতে ফিশারিতে ডিম ছাড়বে।

-মনোসেক্স তেলাপিয়া ডিম দ্যায়?

সে কথা বলে না। মন খারাপ করে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। বয়স পেরিয়ে গেলেও বিয়ে করছে না বলে ডাক্তার তাকে খোঁচা দিল?

ডাক্তার প্লাস্টিকের টুল এগিয়ে দেয়, বস বস...আরে তোমার লগে কথা বইলা সুখ... তুমি হইলা অরিজিনাল কামেল মানুষ।

ডাক্তার তেল মাখে। সে মনে মনে আঁতকে ওঠে, খচ্চরটা আজ তাকে নিংড়াবে না তো?

কামাল মোটারসাইকেল থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে বোকা বোকা বিষণ্ণ মুখে বসে।

-বিয়া কর, একটা ভালা মেয়ে আছে।

-কে?

-হোসেনের মেয়ে।

বিদ্যুতের আলো, পানির মোটর, মোবাইল-ইন্টারনেট, টিভি, পাকা সড়ক এবং গার্মেন্টস ও প্রবাসীদের টাকায় গ্রাম ও মানুষ যতই বদলে যাক তবু এইসব ফিশারি-পোলট্রির বাজে গন্ধের সঙ্গে, গ্রামের মানুষের কাপড়ের তলের গন্ধও সারা গ্রামে সবার নাকে লাগে। কেউ টুঁ শব্দ করে না। শুধু ফ্যাকফ্যাক করে হাসে। এইরকম দূষিত বাতাস থেকে পাওয়া হাসির শব্দে সে শুনেছে, হোসেন প্রবাসে থাকে ১৭ বছর। জমি, বাড়ি ও নগদ টাকাতে ফেলনা না। তার বড় মেয়ে আনিসা এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। পাশের গ্রামের ইসলামের ছেলে আনিসার ক্লাসমেট। ছেলেটার সঙ্গে মেয়েটা মোবাইল-সেক্স করে।

আনিসার ছোট দুই ভাইয়ের একটা পড়ে স্কুলে, একটা মাদ্রাসায়। ঘরে বুড়ি মা আছে। হোসেন-পরিবারের রোগ-শোক ডাক্তারকে একটু বেশি তটস্থ করে। রাতে বাজার থেকে ফেরার পথে আনিসার মায়ের ঘরে মাঝে মাঝে তাকে বসে থাকতে দেখা যায়। আনিসার মা ডাক্তারের সামনে চা নিয়ে পান-পানি নিয়ে বারবার আসা-যাওয়া করে, মাঝে মাঝে চকচকা চোখে ডাক্তারের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন মহিলা নাকি বুকে ওড়না দিতে ভুলে যায়।

ডাক্তার কামালের দিকে গভীর চোখে তাকায়, হোসেনের মেয়েরে বিয়া করতে অসুবিধা কী?

-আমি নিজ গ্রামে আত্মীয়তা করব না।

-ক্যান?

কামাল প্রাচীন বুড়োদের মতো একটু একটু মাথা দুলিয়ে জবাব দেয়, দূর যত মধু তত।

ডাক্তারও লবণ ছিটিয়ে দুধ-সর খায়, দরকার মতো জটিল প্যাঁচে ফেলে নারীদেহ ভোগ করে। তার অভিযানগুলোর সাফল্যের কথা গ্রামের অপেশাদার লুচ্চাদের মুখে মাঝেমধ্যে শোনা যায়। কেউ কেউ আচানক গলায় রায় দেয়, ডাক্তারের কাছে মা-মেয়ে সমান!

ডাক্তারের ছোট ছোট চোখ দুইটা পিটপিট করে কামালকে এক নজর দেখে, মাসলম্যানদের মতো পেটানো শরীর, কব্জিতে বীর যোদ্ধার জোর আর তরতর করে উপরে উঠতে থাকা কামালকে সে ঘৃণা করে। তাই সে মনে মনে মুখ খারাপ করে, খচ্চরটা নাকি দীর্ঘ দীর্ঘ সান্টিং দিতে পারে!

অন্ধকার যেমন সত্যকে লুকিয়ে রাখতে চায় তেমনি ডাক্তার বিচ্ছিরি দাঁতগুলোর আড়ালে দাঁতাল জন্তুটা লুকিয়ে রেখে হাসে। পাতলা জিবটা ঠিকমতো রস জোগায়, হেহ...হে..., বুঝচ্ছি, অখন কী ওষুধ দিমু?

কামাল সিগারেট ধরিয়ে বলে, কনডম। 

মাঝ বয়সী ফাজিল ডাক্তার মুখ বেজার করে বলে, মাত্র একখান আছে।

বাজারে আর কোনো ফার্মেসি খোলা নাই দেখে টাকা পাগল লটখট চরিত্রের কোয়াকটা কি তাকে শিকার বানাতে চায়?

কামাল মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিছু অন্ধকার জমে আছে ঝুমির ঘরের পেছন দিকে। ছাদের পাশে ছাতির মতো ছড়িয়ে থাকা আম গাছটা তার স্বর্গারোহণের সিঁড়ি। ওটা বেয়ে সে কয়েকদিন পরপর ঝুমির ঘরের ছাদে উঠে যায়। তখন আম গাছের নিচের বাল্বটা অবশ্য চোখ বন্ধ করে রাখে। 

কামালের কান গরম হয়ে গেছে। সে মরিয়া হয়ে ডাক্তারকে বলে, দেন।

-না।

-কেন?

ডাক্তার জানে কামাল এখন গুলি-খাওয়া বাঘ, সে কৃপণ হলেও এই মুহূর্তে মুঠি খুলতে বাধ্য। তাই বলে, অসুবিধা আছে। বাজারে দোকান চালাইতে হইলে কিছু কিছু জিনিস মানা লাগে। মানুষের উপরে মানুষ আছে, লিডারের উপরে লিডার। সেই রকম একজন মানুষ বিকালে কইয়া গ্যাছে, তার জন্য একটা কনডম রাখতে।

শরীরের গোপন অঙ্গে লুকিয়ে রাখা পচা ঘায়ের মতো পাপকে কামাল লালন করে। তাই মাথা নুয়ে নুয়ে হাঁটে এবং পুরুষ মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় তাকে ক্লান্ত, প্রাণহীন ও বোকা বোকা লাগে। এই জন্য গ্রামের মানুষ আড়ালে আড়ালে কামালকে ‘মাছরাঙ্গা’ বলে ডাকে। এর অর্থ হলো, কামাল শরীর না ভিজিয়েই পানির মাছ শিকার করে।

কামাল মিনমিনায়, দশ টাকা বেশি নেন, তবু দেন।

-নাই। সন্ধ্যার পর থাইকা সাতজনে নিছে। তিনজন বিদেশ থেকে আইছে। তাগর বউ আছে। বাকিরা বলদ আর ইস্কুল-কলেজের ষাঁড় বাছুর। সাধে কি আর দূর গেরামের মানুষ এই গেরামটাকে বলে, ‘বউগ্রাম’।

কামাল মরিয়া হয়ে আবার বলে, দিয়া দেন ভাই...।

-দিবার পারি কিন্তুক...।

কামাল রাগে মাথা নুয়ে বসে থাকে। ডাক্তার বলে, ঠিক আছে, যা কইবার আমি কইয়া লিডাররে সামলাইতে পারমু। কিন্তু দুইশ টাকার একখান নোট দিতে হইবো।

কামাল লোকটার দিকে ঘৃণাভরা চোখে তাকিয়ে বলে, তুমি ডাকাত।

আবিল হাসিতে ডাক্তারের ময়লা দাঁতগুলো বেরিয়ে আসে, এই জিনিস দিয়া তুমিও তো ডাকাতি করবা।

-ঠিক আছে, দুইশ টাকাই পাইবা। কিন্তু আমার একটা কথার জবাব দিতে হবে।

দুইশ টাকার আরামে ডাক্তারের ঘোলা চোখ চকচক করে। কালো আর মোটা মোটা ঠোঁটের ফাঁকে লুচ্চা লুচ্চা হাসিটা দেখে কামালের ঘিনঘিন করে। ডাক্তার কুৎ করে মুখের লালা গিলে বলে, কী কইবা কও।

ইতর আর নির্লজ্জ ডাক্তারের চোখে চোখ রেখে কামাল জিজ্ঞেস করে, একটা মেয়েলোক যদি চার-পাঁচটা পুরুষকে প্রেম-কাম দেয় তারে কী বলবা?

ডাক্তারের গোল গোল চোখ আরামে আবার ছোট হয়ে আসে। তার নামে বদনাম আছে, সে নাকি মেয়েলোকের জ্বর-প্রেসার মাপতে গিয়ে নরম জায়গায় খামাখা হাত লাগায়। এই সব নিয়ে ছোটখাটো বিচার-সালিশও হয়েছে। তবু গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের সঙ্গে তার খাতির আছে। মেয়েদের চিকিৎসার জন্য মানুষ তাকে বাড়িতে ডেকে নেয়। গ্রামের আউলফাউল, বদমায়েশসহ ছোট-বড় সবার সঙ্গে তলে তলে তার একটা তরল সম্পর্ক আছে। চরিত্র বলতে যার কিছু নাই সেই জবান ডাক্তার মুখটা বিকৃত করে বলে, এইরকম মেয়েলোকরে কয় ‘বিল্লা’।

কামাল মরিয়া হয়ে আবার প্রশ্ন করে, আর যদি একটা ছেলে অনেক মেয়ের সাথে ঘুমায়? 

কোয়াকটা আমুদে-গলায় ঘোষণা করে, বিল্লা বিল্লা...

কামাল জিন্সের পকেটে জিনিসটা রাখতে রাখতে দূরের মাঠের দিকে তাকায়। ঝুমি এখন নরম বিছানায় শুয়ে গরম কুকুরীর মতো তার অপেক্ষা করছে। তবু অবিবাহিত এবং কামুক কামালকে মূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেলা মানুষের মতো বিষাদগ্রস্ত লাগে। পেরেশান পা দুটি টেনে টেনে মোটরসাইকেলে দিকে যেতে থাকে আর মনে মনে হিসাব করতে চেষ্টা করে, এই পর্যন্ত সে কতজন নারীকে বিছানায় পেয়েছে?

কামাল থমকে দাঁড়ায়। পেছনের পাকা সড়ক দিয়ে ছুটে যাচ্ছে একটা ট্রাক, তার হিংস্র দাপটে পায়ের তলার মাটি কাঁপছে, বটতলায় ছাইয়ের গাদায় দুইটা কুকুর দুর্বোধ্য আমুদে কাউলাকাউলি করছে, মাঠের দিক থেকে মুক্ত বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে জল-কাদার ঘ্রাণ। তবু তার আচ্ছন্ন চেতনার মধ্যে ঝলক দিয়ে উঠছে নানা রং-রূপ-জাতি ও বয়সের নারীদের মুখ, আনারের ফুলে লেগে থাকা বৃষ্টির ফোটার মতো মিষ্টি মিষ্টি অনেক নাম, সারিবদ্ধ সেইসব নারীর মধ্যে আছে মালয়, চায়নিজ, ফিলিপিনো আর বঙ্গললনাদের অনেক মুখ।

কামালের দেহটা কেঁপে ওঠে। ঘিনঘিন করে। আর এইভাবেই সে নিজেকে একজন ‘বিল্লা’ মানুষ হিসেবে হঠাৎ আবিষ্কার করে স্তব্ধ হয়ে যায়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫