
গ্রাফিক্স: সাম্প্রতিক দেশকাল
বন্দিত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তির আস্বাদ মানুষের আজন্ম আরাধ্য। মানুষ শৃঙ্খলিত হলেও, মুক্ত জীবনপথ পরাশক্তিবাদে দলিত হলেও মুক্তিকামী মানুষেরই শেষপর্যন্ত জয় হয়, গ্রহণ করে স্বাধীনতার স্বাদ। সুদূর প্রাচীনকাল থেকে ঔপনিবেশিক শাসন এবং পরিশেষে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পর্যন্ত বহু শাসক ও শোষক ব-দ্বীপের এই বাংলা ও বাঙালিকে শিকলাবদ্ধ করে রেখেছিল; কিন্তু সংগ্রামী বাঙালি মুক্তির লড়াইয়ে প্রতিবারই ঝরিয়েছে অমিত রক্ত। পরাধীনতার শিকল ভাঙতে অকাতরে দান করে গেছে লাখো প্রাণ। এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হওয়া রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধও ছিল শোষকের চাবুকের কশাঘাত, পরাহতের গ্লানি মুছে ফেলানো। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে আমরা বহু আকাঙ্ক্ষিত মুক্তির স্বাদ পাই। অর্জন করি স্বাধীনতা।
স্বাধীনতাপ্রাপ্তি আমাদের জাতীয় জীবনে এক বড় অর্জন; নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ এবং গৌরবের। এই অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা এবং বহু বছরের অপ্রাপ্তির ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের এই গৌরবান্বিত ইতিহাস মর্যাদার সঙ্গেই আমাদের লেখকরা বাংলা সাহিত্যের সার্বিক ক্ষেত্রে অত্যুজ্জ্বল করে তুলে এনেছেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে সাহিত্যের ক্ষেত্রে অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। অবশ্য ভারত বিভক্তের পর থেকেই বাংলা সাহিত্য স্বাতন্ত্র্য হয়ে উঠতে থাকে। এরই পটভূমিকায় সৃষ্টি হতে থাকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাহিত্য। মুক্তিযুদ্ধ এ ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে থাকে। মূলত এই সাহিত্যে বিধৃত হতে থাকে বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামশীলতা, দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ, বীর্যবত্তা ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্যের মধ্যে সবেচেয়ে বড় পরিসরে কাজ শুরু হয় উপন্যাসে। ঔপন্যাসিকরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বিস্তৃত বিপুল বিষয় নিয়ে লিখতে থাকেন। এসব উপন্যাসে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে পাকিস্তানিদের বর্বরতা, দেশের মানুষের অসহায়ত্ব, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালির বিপুল প্রতিরোধ গড়ে তোলার অসীমতা ইত্যাদি। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক প্রথম উপন্যাস আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’। নায়ক সুদীপ্ত শাহিন তার জীবনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এটাই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানিদের বর্বরতা এই উপন্যাসের পরতে পরতে গাঁথা হয়েছে। শওকত ওসমান লিখেছেন চারটি উপন্যাস- ‘জাহান্নাম হইতে বিদায়’, ‘নেকড়ে অরণ্য’, ‘দুই সৈনিক’, ‘জলাঙ্গী’। শওকত আলীর উপন্যাস ‘যাত্রা’, সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘নীল দংশন, নিষিদ্ধ লোবান’, সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’। সেলিনা হোসেনের ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ উপন্যাস যেন হয়ে উঠেছে একাত্তরে সন্তানহারা হাজার মায়ের প্রতীক। রশীদ হায়দারের উপন্যাস ‘অন্ধ কথামালা’, আহমদ ছফার উপন্যাস ‘ওঙ্কার’, আল মাহমুদের ‘উপমহাদেশ’, শামসুর রাহমানের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’, মাহমুদুল হকের ‘খেলাঘর’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’, রাবেয়া খাতুনের ‘ফেরার সূর্য’, আবু জাফর শামসুদ্দিনের উপন্যাস ‘দেয়াল’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শ্যামল ছায়া’, ‘সৌরভ’, রফিকুর রশীদের ‘দাঁড়াবার সময়’, ‘ছায়ার পুতুল’, আমজাদ হোসেনের ‘অবেলায় অসময়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘ঘেরাও’, হারুন হাবীবের ‘প্রিয়যোদ্ধা’, বরেণ চক্রবর্তীর ‘ক্রান্তিকাল’, ‘মুক্তি উপাখ্যান’, ‘তামস’, তারাশঙ্করের ‘১৯৭১’, শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ উপন্যাসগুলোয় ঔপন্যাসিকরা তাদের যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যক্তি ও সমাজ, ব্যক্তির প্রত্যাশা, অপ্রাপ্তি, সংকট ও যন্ত্রণা, রোমান্টিকতার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতা, দেশপ্রেম, চেতনা ও মূল্যবোধ, গ্রামীণ জীবনকাঠামো, যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ও তার রূপ-রূপান্তর ইত্যাদির প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন। তারাশঙ্করের ‘১৯৭১’ উপন্যাসটি একাত্তরের গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করে রচিত। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র নাজমা। সে খুব কালো। ঔপন্যাসিক এই চরিত্র চিত্রণের মধ্য দিয়ে একাত্তরে হাজার নারীর প্রতীক হিসেবেই তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে সহচরিত্র- রহিম, মি. সেন ও ছায়ার মাধ্যমে সময়ের মুখ খুলে দিয়েছেন তিনি, যাতে রয়েছে হৃদয়স্পর্শী মা-মাটি-মানুষের ভালোবাসা।
মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ছোটগল্পও রচিত হয়েছে প্রচুর এবং এখনো হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্পের ভাণ্ডারও খুব সমৃদ্ধ। তবে লক্ষণীয় যে ছোটগল্প রচয়িতাদের অধিকাংশই ঔপন্যাসিক। কয়েকজন কবির হাতেও ঋদ্ধ হয়েছে সাহিত্যের এ অংশটি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘রেইনকোট’, ‘অপঘাত’, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘দিন ফুরানোর খেলা’, ‘আমৃত্যু আজীবন’, ‘মুক্তিযোদ্ধারা’, আবু রুশদের ‘খালাস’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘স্মৃতি তোকে ভুলবো না’, আবু ইসহাকের ‘ময়না কেন কয় না কথা’, বশীর আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, জাহানারা ইমামের ’রায়বাগিনী’, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ‘মাধবপুরে’, ‘পৌষের আকাশে’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কালিমদ্দি দফাদার’, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের ‘অল্পরী’, আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ব্ল্যাক আউট’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘ফজরালি হেঁটে যায়’, আমজাদ হোসেনের ‘কারবালার পানি’, পূরবী বসুর দুঃসময়ের ‘অ্যালবাম’, বুলবুল চৌধুরীর ‘নদী জানে’, মাহমুদুল হকের ‘বেওয়ারিশ লাশ’, মোহাম্মদ রফিকের ‘গল্প, কিন্তু সত্য নয়’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘লোকটি রাজাকার ছিল’, আবদুশ শাকুরের ‘ইশু’, নাসরীন জাহানের ‘বিশ্বাস খুনি’, ইমতিয়ার শামীমের ‘মৃত্তিকা প্রাক-পুরাতন’ ইত্যাদি।
মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- বশীর আল হেলালের ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’, শওকত ওসমানের ‘জন্ম যদি তবে বঙ্গে’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা’, আবুবকর সিদ্দিকের ‘মরে বাঁচার স্বাধীনতা’, সৈয়দ ইকবালের ‘একদিন বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য গল্প’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘অপঘাত’, রাহাত খানের ‘মধ্যিখানের চর’, সেলিনা হোসেনের ‘আমিনা ও মদিনার গল্প’, হুমায়ূন আহমেদের ‘শীত’, ‘উনিশ শ’ একাত্তর’, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘কেয়া’, ‘আমি এবং জারমান মেজর’, মইনুল আহসান সাবেরের ‘কবেজ লেঠেল’, ‘ভুলবিকাশ’, রশীদ হায়দারের ‘কল্যাণপুর’, ‘এ কোন ঠিকানা’ কায়েস আহমেদের ‘আসন্ন’, মাহমুদুল হকের ‘কালো মাফলার’, জহির রায়হানের ‘সময়ের প্রয়োজনে’, মামুন হুসাইনের ‘মৃত খড় ও বাঙাল একজন’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘পুঁই ডালিমের কাব্য’, আমজাদ হোসেনের ‘উজানে ফেরা’, সত্যেন সেনের ‘পরিবানুর কাহিনী’, মঞ্জু সরকারের ‘শান্তি বর্ষিত হোক’, শওকত আলীর ‘সোজা রাস্তা’, ‘আকাল দর্শন’, কায়েস আহমেদের ‘আসন্ন’, হুমায়ুন আজাদের ‘যাদুকরের মৃত্যু’, সুচরিত চৌধুরীর ‘নিঃসঙ্গ নিরাশ্রিত’, রিজিয়া রহমানের ‘ইজ্জত’ ইত্যাদি।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতাকামী ও সংগ্রামশীল অস্তিত্বের আত্মপ্রকাশ যুগান্তকারী ও বিস্ময়কর এক ঘটনা। মহান মুক্তিযুদ্ধ সাহিত্যোপকরণের ক্ষেত্র ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেছে। আমাদের লেখকরাও তারই আলোকে আন্দোলিত ও আলোড়িত হয়ে ব্যক্তি অভিজ্ঞতা, রুচি, অনুশীলনের মাধ্যমে সমাজজীবনের বহুমুখী সত্য উপন্যাসে, গল্পে, প্রবন্ধে, নাটকে, কবিতায় অর্থাৎ সাহিত্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে যাচ্ছেন, যাবেন যতদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবোধ জাগ্রত থাকবে হৃদয়ে হৃদয়ে।