Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

একজন মাসকারেনহাস ও মুক্তিযুদ্ধ

Icon

জাফর খান

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:২৬

একজন মাসকারেনহাস ও মুক্তিযুদ্ধ

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ও প্রকাশিত জেনোসাইড নিবন্ধ। ছবি: সংগৃহীত

“আব্দুল বারীর ভাগ্য ফুরিয়ে আসছিল। পূর্ব বাংলার হাজার হাজার মানুষের মতো তিনিও ভুল করেছিলেন- মারাত্মক ভুল-পাকিস্তানি টহলদারদের দৃষ্টির গোচরে ধরা পড়ে, ২৪ বছর বয়সী যুবকটি মৃত্যুভয়ে কাঁপছিলেন। কারণ তিনি সৈন্য পরিবেষ্টিত হয়ে গুলিবিদ্ধ হতে চলেছেন বিধায়।”

গত অর্ধ শতাব্দী জুড়ে দক্ষিণ এশীয় সাংবাদিকতার সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখনীর একটি সূচনা এটি। হ্যাঁ বলছিলাম বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় যার ‘জেনোসাইড’ নামের নিবন্ধটি যুক্তরাজ্যের সানডে টাইমসে ১৩ জুন, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয়ে তোলপাড় ফেলে দিয়েছিল সারা বিশ্বে। “কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল। তবে নিশ্চিত বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। গবেষকদের ধারণা, ৩ লক্ষ থেকে ৫ লক্ষ মানুষ যুদ্ধে মারা গেছেন। আর বাংলাদেশ সরকারের হিসাবে সংখ্যাটি তিন মিলিয়ন (৩০ লক্ষ)।”

সন্দেহ নেই যুদ্ধের সময় মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনটি বিশ্ব জনমতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘুরিয়ে দিতে যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ভারতকে সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করেছিল। নিবন্ধটি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের তৎকালীন সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন যে, লেখাটি পড়ে ইন্দিরার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। আর এটি তাকে মস্কো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ইভোন তার স্মৃতিকথায় লেখেন, “যদিও মাসকারেনহাসের উদ্দেশ্য এটা ছিল না। একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে শুধু তিনি তার কাজটি করেছিলেন।”

সাহসী হিসেবে তার সুনাম ছিল। তিনি জানতেন পাকিস্তানে তৎকালীন সময় সামরিক সরকারের শাসন, তাই লেখাটি প্রকাশ হলে তাকে ও তার পরিবারকে দেশছাড়া করা হতে পারে। সে সময়ে কাজটি ছিল দুর্বোধ্য। তার মা সর্বদা তাকে সত্য কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ না করতে উপদেশ দিতেন বলে মাসকারেনহাসের স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে তার বিধবা স্ত্রী ইভোন বলেছিলেন- “তিনি আমাকে বলতেন, আমার সামনে একটি পর্বত রাখুন এবং আমি তাতে আরোহণ করব। ভয় কী জিনিস আমি জানি না।” ইভোনের স্মৃতিকথায় উঠে আসে তাকে নিয়ে। 

১৯৭১ সালের মার্চে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের সময় মাসকারেনহাস দেশটির প্রভাবশালী পশ্চিমাদের প্রধান শহর করাচিতে সাংবাদিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি শহরের গোয়ান খ্রিষ্ট সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন এবং মাসকারেনহাস-ইভোন দম্পতির পাঁচটি সন্তান ছিল।

নির্বাচনের মাধ্যমে সংঘাতের সূচনা। পূর্ব পাকিস্তানের একটি দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জিতে এ অঞ্চলের জন্য বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠদের শাসন চেয়েছিল। ফলে রাজনৈতিক দল এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে সৃষ্টি হয় তর্কের। যদিও অনেক বাঙালি জানতেন পশ্চিম পাকিস্তান স্বেচ্ছায় তাদের আকাক্সক্ষা প্রতিহত করবে। পরিস্থিতি সহিংস হতে থাকে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ, বুদ্ধিজীবী এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি পূর্ব-উদ্দীপক ধর্মঘটের উত্থান ঘটায় পাকসেনারা। তৎকালীন সময় প্রদেশটিতে ছিল ৭৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাস। প্রথমেই পাকসেনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ছাত্র ও অধ্যাপকদের হত্যা করে। সে ধারাবাহিকতায় তাদের নির্মমতার বাতাস গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। 

প্রাথমিকভাবে, পরিকল্পনাটি কাজ করছে বলে মনে হয়েছিল। তখন সেনাবাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় কিছু পাকিস্তানি সাংবাদিককে এই অঞ্চলে আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘মুক্তিযোদ্ধাদের’ দমনের মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করার। ইতোমধ্যে বিদেশি সাংবাদিকদের দেশ থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানও অন্য পক্ষের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা প্রকাশে আগ্রহী ছিল। আওয়ামী সমর্থকরা হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে গণহত্যা করে যুদ্ধাপরাধ করছে বলে সংবাদ প্রকাশে ব্যস্ত সেনাবাহিনী। 

মাসকারেনহাসসহ আট সাংবাদিককে প্রদেশটিতে ১০ দিনের সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সফর শেষে যখন তারা বাড়ি ফিরে তাদের মধ্যে সাতজন পাক শাসকদের ফরমায়েশি লেখা সম্পন্ন করলেও একজন প্রত্যাখ্যান করেন, তিনিই হলেন মাসকারেনহাস। ইভোন মাসকারেনহাসের মনে আছে তিনি বিচলিত হয়ে ফিরে আসেন, “আমি কখনো আমার স্বামীকে এমন অবস্থায় দেখিনি। তিনি একেবারে হতবাক, বিচলিত এবং ভয়ঙ্করভাবে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন।” 

“তিনি আমাকে বলেছিলেন যে তিনি যা দেখে এসেছেন তা লিখতে না পারলে আর কোনো শব্দ লিখতে পারব না।”

স্পষ্টতই এটি পাকিস্তানে করা সম্ভব না, কারণ সমস্ত সংবাদপত্রের নিবন্ধ সামরিক বাহিনীর সেন্সসের পর ছাড়া হচ্ছিল। মাসকারেনহাস তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, শাসক গোষ্ঠীর বাইরে গিয়ে তিনি কিছু লিখলে নিশ্চিত তাকে গুলি করা হবে। তাই তিনি তার অসুস্থ বোনের সঙ্গে দেখা করার ভান করে লন্ডনে যান। সেখানে তিনি সরাসরি সানডে টাইমস সম্পাদকের কার্যালয়ে যান। ইভোনের মনে আছে তার স্বামী ‘একজন সামরিক সদস্যের কথা বলছিলেন যিনি বর্গাকৃতির দেহসর্বস্ব গোঁফযুক্ত, আবেদনময়ী, গভীর বিষাদময় বাতাস ছড়াচ্ছিলেন।” ইভোন লেখেন, “মার্চ মাসে বাঙালির ক্ষোভ দেখে তিনি হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। মাসকারেনহাস একটি বিশাল ও পদ্ধতিগত হত্যাকা-ের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন। এই হত্যাকা-কে ‘চূড়ান্ত সমাধান’ হিসাবে সেনা কর্মকর্তাদের বর্ণনা করতে শুনেছেন।”

ইভোন গল্পটি চালিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তাদের সন্তানসহ করাচি থেকে পালিয়ে যান। তবে তারা এটি নিয়ে লিখতে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে এমন সংকেত হিসেবে মাসকারেনহাসের কাছে একটি টেলিগ্রামের অপেক্ষায় ছিলেন, যাতে লেখা থাকবে, “অ্যানের অপারেশন সফল হয়েছে।”

তার মনে আছে পরদিন ভোর তিনটায় বার্তাটি এসেছিল। ইভোন লেখেন, “আমি আমার জানালায় টেলিগ্রাম বার্তা বহনকারী লোকটির আওয়াজ শুনতে পাই। আমার ছেলেদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললাম। মনে মনে বললাম, “হে ঈশ্বর, আমাদের লন্ডন যেতে হবে। এটা ভয়ঙ্কর ছিল। আমাকে সব পেছনে ফেলে যেতে হয়েছিল।”

“আমরা প্রত্যেকে একটি মাত্র স্যুটকেস সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি পেয়েছিলাম। আমরা এত কাঁদছিলাম যে এটি একটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো অনুভূত হচ্ছিল।” 

সন্দেহ এড়াতে তার পরিবার চলে যাওয়ার আগে মাসকারেনহাসকে পাকিস্তানে ফিরে যেতে হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সময় মাত্র একটি বিদেশি ফ্লাইটের অনুমতি থাকায় তাকে স্থলপথে আফগানিস্তান যেতে হয়। পরে লন্ডনে তাদের নতুন বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ঠিক পরদিন সানডে টাইমসে ‘গণহত্যা’ শিরোনামে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। 

এটি একটি শক্তিশালী প্রতিবেদন ছিল। কারণ মাসকারেনহাস আক্ষরিক অর্থেই পাকিস্তানি অফিসারদের বিশ্বস্ত ছিলেন তাই ভেতর থেকে সব তথ্য তুলে এনে তার কলমের মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছিল। নিবন্ধের এক জায়গায় তিনি  লেখেন, ‘‘আমি ‘কিল অ্যান্ড বার্ন মিশন’-এর নৃশংসতা প্রত্যক্ষ করেছি যখন সেনা ইউনিট বিদ্রোহীদের নির্মূলে শহর ও গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত করে। আমি দেখেছি ‘শাস্তিমূলক পদক্ষেপ’ হিসেবে কীভাবে পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে।”

তিনি লেখেন, “রাতে অফিসারস মেসে অবিশ্বাস্যভাবে শুনেছি সাহসী এবং সম্মানিত লোকদের হত্যার জন্য কীভাবে তারা গর্ব করছে।” তবে তার নিবন্ধটি পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে ছিল একটি বিশাল বিশ্বাসঘাতকতা এবং তাকে শত্রু এজেন্ট বলে অভিহিত করেছিল পাক শাসকরা। 

যা-ই হোক পরবর্তী সময় তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক বজায় রেখে ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সফলতা নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। বাংলাদেশে কিন্তু এই সাংবাদিককে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গেই স্মরণ করা হয়ে থাকে। তার লেখাটি আজও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়ে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, “এটি ছিল যুদ্ধের ওপর লেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিবন্ধগুলোর একটি। এটি আমাদের দেশকে বিচ্ছিন্ন করার সময় প্রকাশিত হয়েছিল এবং এখানে কী ঘটেছিল তা বিশ্বকে জানাতে সাহায্য করেছিল।” পরবর্তীকালে তার পরিবার নতুন একটি শীতপ্রধান দেশে বসতি স্থাপন করে বাস করতে শুরু করেন। ইভোন লেখেন, “লন্ডনের মানুষ অত্যন্ত যান্ত্রিক, কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলত না।” মাসকারেনহাস তার সৃতিকথায় লেখেন, “আমরা একটি সুখী ও হাসিখুশি কিছু মুখ দেখেই দিন কাটাতাম। যদিও করাচির পর এমন জীবন ধারণে কিছুটা পরিবর্তন থাকলেও এতে আমাদের অনুশোচনা ছিল না।”

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫