ফটোগ্রাফি
চোখের দেখায় মনের অনুধাবন

রিয়াসাত হাসান জ্যোতি
প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:২৬

ইনসেটে ফটোগ্রাফার- আনি নুনেজ ও ডিয়ানা মেজেনসাভিচেনে।
প্রতিটি মানুষেরই কোনো না কোনো শখ থাকে। জীবনের ব্যস্ততার পাশাপাশি সবাই সেই শখগুলোর পেছনেও সময় দিয়ে থাকে। তেমনই একটি শখ ফটোগ্রাফি। আবার অনেকের জন্য ফটোগ্রাফি জীবিকাও বটে। জীবনের সুন্দর মুহূর্ত ও স্মৃতিগুলোকে ফ্রেমে আবদ্ধ করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে সহায়তা করাই ফটোগ্রাফির মূল উদ্দেশ্য। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ফটোগ্রাফি বন্দি ছিল সীমাবদ্ধ পরিসরে। আর ফটোগ্রাফি শেখা আগের দিনে বর্তমানের মতো সহজ ছিল না মোটেও। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই পরিসর সবার জন্য উন্মুক্ত ও সহজলভ্য।

আমার ফটোগ্রাফির হাতেখড়ি এসএলআর ক্যামেরা দিয়ে ১৯৯৬/১৯৯৭ সালের দিকে যখন আমি সবার কাছে নিতান্তই বাচ্চা মানুষ। বাবার নিয়ে আসা অফিসিয়াল ক্যামেরা দিয়ে প্রথম ছবি তোলা শেখা। এরপর নিজের প্রথম ক্যামেরা ছিল কোডাকের ৩৫ এমএম ফিল্ম ক্যামেরা। অনেক ছবি তুলেছিলাম, নষ্ট করেছিলাম অনেক ফিল্ম। একসময় ইয়াশিকা ক্যামেরা, ক্যানন ও নাইকনের ফিল্ম ক্যামেরাও হাতে ঘুরেছে। তারপর প্রবেশ ডিজিটাল ক্যামেরার যুগে। অলিম্পাস, কনিকা-মিনোলটা এবং আরও কিছু ব্র্যান্ডের ক্যামেরা পার করে একসময় কিনলাম ক্যাননের সেমি-ডিএসএলআর ক্যামেরা। পরবর্তী সংযোজন নিকন ডিএসএলআর, ক্রপ ফ্রেম। সেই দিয়েই আমার আরও সামনে এগোনো।

ট্যুরিজমে কাজ করার সুবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছবি তোলার পাশাপাশি ছবি তুলেছি বিদেশেও। কাজের সূত্রে ভ্রমণ করেছি নেপাল, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্যক্তিগত ভ্রমণ ছিল ভারতের কলকাতায়। সেই সুবাদে ছবি তুলেছি এসব দেশেও। এছাড়া সম্প্রতি আমি নাইজেরিয়ান স্ট্রিট ফটোগ্রাফি TAPE by Street এবং Benin City Film Festival-এর যৌথ উদ্যোগে যোগ দিয়েছিলাম মাস্টারক্লাস ইন ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপে, যেখানে আমি অনলাইনে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের ফটোগ্রাফি নিয়ে আলোচনা করেছি। আর সুইডেনের বিসকপ্স আর্নো ফোক স্কুলে সাত দিনের একটি ফটোগ্রাফি ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেছি। সামনে যুক্ত হতে যাচ্ছি Benin City Film Festival -এর জুড়ি হিসেবে।

ছবি তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দেশের পরিমণ্ডলে থাকে ভিন্নতা, ভিন্নতা উঠে আসে তাদের সংস্কৃতিরও। ভৌগোলিক দিক থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া প্রায় একই রকমের, তবে সংস্কৃতির পার্থক্য আছে। আর ছবি তোলার ক্ষেত্রে সাগর পাড়ে একরকম তো সমতল ভূমিতে আরেকরকম আবার পাহাড়ি এলাকায় একদমই ভিন্ন। নেপালের বিষয়টা আবার অন্যরকম, পুরোপুরি না হলেও আমাদের সাজেক ভ্যালির সঙ্গে সামঞ্জস্য রয়েছে। সবকিছুর ক্ষেত্রে মূল পার্থক্য হলো ভৌগোলিক আর পাশাপাশি সংস্কৃতির পার্থক্য। আরেকটি মূল বিষয় হলো আলোর পার্থক্য।

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আমার ছবি তোলা চলছে এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। যেখানে ভৌগোলিক পার্থক্যের বিষয়টা অনেক বেশি; মানুষ, পোশাক ও রঙের পার্থক্য তো আছেই। ইউরোপের এই অঞ্চলে একটা সময় দিন দীর্ঘ আরেকটা সময় রাত। বিশেষ করে সূর্যের অবস্থান সবসময়ই তির্যক। আর ভাষার পার্থক্য এখানে আরেকটি মূল বিষয়। অন্যান্য দেশে সবাই নিজেদের ভাষার পাশাপাশি ইংরেজিতেও কথা বলে। তবে এখানে সেটা ভিন্ন, সবাই ইংরেজির চেয়ে নিজের ভাষায় কথা বলতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যেটা যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা বলেই প্রতীয়মান।

কথা হচ্ছিল আর্জেন্টাইন-ডেনিশ ফটোগ্রাফার আনি নুনেজের সঙ্গে। ফটোগ্রাফির পাশাপাশি তাকে নিজের সন্তানের খেয়ালও রাখতে হয়। আর্জেন্টিনায় থাকাকালে যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফির কাজ করতেন তা অনেক বড় পরিসরের কাজ হতো। একাধারে যেমন আনন্দ ছিল সেখানে কাজ করায়, পাশাপাশি তা অনেক সময় ক্লান্তিকরও হয়ে যেত; যেহেতু দীর্ঘ সময় ধরে চলত সে ফটোগ্রাফি। আর প্রচুর হইহুল্লোড় হতো এ নিয়ে। তিনি কাজ করেছেন স্পেনেও, সেখানে কাজ দীর্ঘ সময়ের হলেও খুব শান্ত পরিবেশে সব আনুষ্ঠানিকতা হতো। আর ডেনমার্কে বিয়ের অনুষ্ঠানে ফটোগ্রাফি নুনেজের জন্য অনেকটা স্বর্গ হাতে পাওয়ার মতো। খুব অল্প সময়ে শান্ত এবং আন্তরিক পরিবেশে এখানে শেষ করতে পারেন সব কাজ, সঙ্গে সন্তানকেও সময় দিতে পারেন পর্যাপ্ত।

তিনি বললেন, ‘সব কিছুরই ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আছে; যেহেতু আমি আমার নিজ দেশে বাস করছি না। তবে ডেনমার্কের কর্মপদ্ধতি আমার জন্য ইতিবাচক এবং তা এ কারণে যে আমি আমাকে সময় দিতে পারি। হ্যাঁ ইউরোপে ফটোগ্রাফির পেছনে- বিশেষ করে ডেনমার্কে, আমি যেখানে সবচেয়ে অস্বস্তি বোধ করি তা হলো ভাষার পার্থক্য, অন্য ফটোগ্রাফারদের তুলনায় এটি আমার কাছে একটি নেতিবাচক দিক; কারণ তারা ডেনিশ ভাষায় দক্ষ, আমি নই। তবে ভাষার বাধা সাময়িক এবং অতিক্রম করা সম্ভব। এ জন্য কিছুটা সময় ও অধ্যবসায় প্রয়োজন। যদিও স্পেনে থাকাকালে আমার সুযোগ ছিল বেশি। সেখানে লোকজন আমার ফটোগ্রাফি পছন্দ করত। আর আর্জেন্টিনা- নিজ দেশ হিসেবে এটি আমার জন্য আরও সহজ ছিল; কারণ সেখানে সবাই আমাকে চিনত আর সেখানকার অনুষ্ঠানগুলোতে ফটোগ্রাফারদের চাহিদা সবসময়ই বেশি ছিল।’

আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক কিছুই আমার জন্য সহজ ছিল। কিন্তু এখানে ভাষার পার্থক্যের কারণে বেশিরভাগ সময়ই বাধার সম্মুখীন হতে হয়। ডেনমার্কে একবার এক ফটোগ্রাফি গ্রুপের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তারা সপ্তাহের একটা দিন সকল ফটোগ্রাফার এক জায়গায় মিলিত হয়। কিন্তু সেখানে গিয়েও একই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আমাকে। আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কিছুটা কথা বলে পরে তারা নিজেরা ডেনিশ ভাষায় কথা বলতে থাকে, যার অনেক কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হয়নি।

আমার অপর এক সহকর্মী ডিয়ানা মেজেনসাভিচেনে, যিনি ১৯ বছর ধরে ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করছেন, তিনি অনুভূতি জানালেন লিথুয়ানিয়া ও ডেনমার্কে ফটোগ্রাফির ওপর তার বাণিজ্যিক এবং সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো বর্তমান সময়ে প্রযুক্তিগতভাবে তার দেশ অনেক উন্নত, কিছুটা এগিয়েও আছে অন্যান্য দেশের চেয়ে।

তিনি বললেন, ‘চিত্র জগতের গোলক ধাঁধায় আমার যাত্রা শুরু তখন, যখন আমার বয়স ২১ বছর। আর সেটা ছিল ফটোগ্রাফির চেয়েও বেশি কিছু, আর ক্যামেরা ছিল আমার কাছে দৈনন্দিন ব্যবহার্য যন্ত্রের মতো। শুরুতে কিছুটা সময় ছাড়া ল্যান্ডস্কেপের প্রতি আমার তেমন আগ্রহ ছিল না। বিভিন্ন বাণিজ্যিক অনুষ্ঠানে মানুষের পোর্ট্রেট ছবি তোলা এবং সেখানে কাজের মধ্য দিয়ে আমি বিশ্লেষণ করেছি মানুষের চরিত্র, আচরণ, আনুষ্ঠানিকতার মূল, দৃশ্য এবং কৃত্রিম আলোর প্রসঙ্গ। এটা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং যে আলো এবং ছায়ার ব্যবহারে কী ধারণ করা যায় তা বুঝতে পারা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকে ভীতি বোধ করে প্রাকৃতিক আলো আর অন্ধকার নিয়ে। কিন্তু আমার আগ্রহ এর চেয়ে বেশি। আমি সবসময়ই আলো, গ্রেডিয়েন্ট, ছায়া এবং হাফটোন নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করতে পছন্দ করি। দুটি ছবিকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে একটি গল্পের সৃষ্টি করি, যা যার যার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে এবং অভিভূত হয়। আমরা সবসময়ই কাজের মান দেখতে পছন্দ করি, যা শুধু ছন্দ বজায় রাখার মাধ্যমে সৃষ্টি করা সম্ভব। ছবি তোলার ক্ষেত্রে নিজের একাগ্রতা আর মনোবল নিয়ে কাজ করা আমার পছন্দ। আর এ বিষয়ে আমি পছন্দ করি প্রকৃতি, বাতাস, বৃষ্টি ও প্রতিচ্ছবি। অনেকেই বলে যে এই আবহাওয়া ছবি তোলার উপযুক্ত নয়, আদতে তারা আসলে আবহাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে পোশাক পরে না। আমি সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মান, বিষয় বা সাধারণ পথ অনুসরণ করি না।’

বর্তমানে আমি কাজ করছি স্ট্রিট ফটোগ্রাফি, পোর্ট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ আর ন্যাচার ফটোগ্রাফি নিয়ে। আমার নিজের সবচেয়ে পছন্দের হলো ক্যান্ডিড পোর্ট্রটে আর ম্যাক্রো ফটোগ্রাফি। ব্যবহার করছি আমার নিকন ডি৭১০০ ক্রপ ফ্রেম ক্যামেরা আর নতুন সংযোজন করেছি ক্যানন ৫ডি মার্ক-৩ ক্যামেরা। তবে শুধু ডিএসএলআরের মাঝেই আমার ফটোগ্রাফি সীমাবদ্ধ নেই, পাশাপাশি আমি মোবাইলের ক্যামেরা ব্যবহার করেও ফটোগ্রাফি করছি। এই মুহূর্তে আমি ব্যবহার করছি ওয়ান প্লাস-১০ প্রো মোবাইল ফোনের ক্যামেরা, আর আমি সেখানে প্রফেশনাল মোডে ছবি তুলতে বেশি পছন্দ করি। কারণ এই মোডে প্রায় ডিএসএলআরের মতোই ছবি তোলা যায় এবং বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট করা যায়। আর ছবি তোলা আমার কাছে শুধু শখ মিটানো নয় বরং তার মধ্য দিয়ে যেন একটি গল্প বলা যায় তার প্রচেষ্টাও বটে। নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে আমি প্রথমবারের মতো এখানকার খ্রিষ্টান একটি বিয়ের ফটোগ্রাফি করেছি।

ছবি সম্পাদনার ক্ষেত্রে বরাবরের মতোই আমার লাইটরুম আর ফটোশপ পছন্দ। আর মোবাইল ফোনে ব্যবহার করছি স্ন্যাপসিড সফটওয়্যার। সবার প্রশ্ন থাকে মাঝে মাঝেই, ভালো ছবি কীভাবে তুলব? তার জন্য তো ভালো ক্যামেরা লাগবে। উত্তরটা সহজ- ভালো ক্যামেরার প্রয়োজন নেই মোটেও, প্রয়োজন নিজের চোখে দেখা সব কিছুকে সরলভাবে অনুধাবন করা এবং সেটাকে ধারণ করা, তা প্রফেশনাল ক্যামেরা দিয়ে হোক কিংবা মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে।