
জুলিয়েটের বাড়ি। ছবি: ইন্টারনেট
“আমার আকাঙ্ক্ষা প্রভূত, সমুদ্রসম
আমার ভালোবাসা আত্মন্তিক গভীর-
আমি আরও উপহার দিতে পারি
আমার আরও আছে যা উভয়ের জন্য অসীম।”- জুলিয়েত্তা (সংলাপ)
ইতালির প্রাদেশিক ভেরোনা শহরের সম্ভ্রান্ত ও সমমর্যাদাসম্পন্ন দুটি পরিবারই হলো ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকের ঘটনার কেন্দ্রে। এক প্রাচীন বিবাদে ও বিদ্বেষে ফেটেপড়া দুটি পরিবার দীর্ঘদিন লিপ্ত এক রক্তক্ষয়ী বিবাদে। এর মাঝেই জন্মগ্রহণ করে ভাগ্যবিড়ম্বিত দুই প্রেমিক-প্রেমিকা, যাদের সকরুণ দুর্ঘটনা এবং অকালমৃত্যু অবসান ঘটায় তাদের সুপ্রাচীন পারিবারিক বিবাদের। অকালমৃত্যুর দ্বারা পরিসমাপ্ত ও পরিচিহ্নিত এই অমর প্রেম আর পরিণতিই হলো এই নাটকের বিষয়বস্তু।
বহু শতাব্দী ধরে এই শহর ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নামের পৌরাণিক প্রেম উপাখ্যানের দ্রষ্টব্য স্থান হিসেবে দুনিয়াখ্যাত।
কাজা দেল্লা জুলিয়েত্তা (জুলিয়েত্তার বাড়ি)
ভেরোনার ‘ভিয়া কাপেল্লো’ সড়কে এই জায়গাটি পর্যটকদের জন্য বিশেষ আকর্ষণের। প্রবেশপথ পেরিয়ে একটি ছোট আঙিনা, মধ্যযুগের ইটের উষ্ণ রং দ্বারা অভ্যর্থিত হয়েই মনে হতে পারে কোথায় সেই গল্পে জানা রোমান্টিকতা? আঙিনা পেরিয়ে প্রথম তলায় একটি অভ্যন্তরীণ চত্বর, কয়েকটি ছোট ছোট জানালা, একটি দেয়াল যা ভালোবাসার (!) বার্তায় পরিপূর্ণ। প্রত্যেকেই তাদের স্মৃতিচিহ্নটুকু এই দেয়ালে রেখে যেতে চাইছিলেন। যাকে ‘ভালোবাসার প্রাচীর’ বলা হয়। খুব নিকটবর্তী না হলে বুঝতে পারবেন না যে এটা লেখায় আঁকিবুঁকিতে আচ্ছাদিত দেয়াল। মনে হতে পারে একটি শিল্পকর্ম, রঙবাহারি বিমূর্ত চিত্রকলা বলেও ভ্রম হতে পারে। সেখানটায় একটা স্বাক্ষর রাখার মতো সামান্য খালি স্থান অবশিষ্ট নেই।
আঙিনার সামনে একটি ছোট প্রাঙ্গণে ব্রোঞ্জ নির্মিত জুলিয়েত্তার ভাস্কর্য স্থাপিত। দেখছিলাম কয়েকজন পর্যটক ভাস্কর্যের নিকটবর্তী হয়ে এক ফাঁকে তার ‘বক্ষচূড়া’ ছুঁয়ে দিচ্ছিল! জর্জিওকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে বলেছিলেন, এটা প্রচলিত জনশ্রুতি যে, জুলিয়েত্তার ডান ‘বক্ষচূড়া’য় সোহাগপূর্ণ স্পর্শ নাকি বিশেষ ভবিষ্যৎ আবেগের জন্য সৌভাগ্যসূচক!
রোমিও-জুলিয়েত্তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না শেক্সপিয়ারের রোমান্টিক রচনার আগে, কিন্তু কীভাবে এটি জুলিয়েত্তার বাড়ি হয়ে উঠল? উত্তর আসে, যেটিকে জুলিয়েত্তার বাড়ি বলা হচ্ছে তা আসলে কাপুলেত্তির ওরফে কাপ্পেল্লোর বাড়ি। কাপ্পেল্লো পরিবার ছিল এর দীর্ঘকালের উত্তরাধিকার। কাকতালীয় হলেও এই প্রায় সমুচ্চারিত নাম সংযোগই হয়তো বাড়িটিকে এই নামে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে সহায়ক হয়েছে। কেননা শেক্সপিয়ারের অমর সৃষ্টির আগে নায়িকা জুলিয়েত্তা ছিল প্রকৃতপক্ষে অস্তিত্ববিহীন! তবে হ্যাঁ, বিশ্বাসযোগ্য আবেগ ছাড়া মোহময় জায়গা হিসেবে তা আর কীভাবেই বা অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম?
প্রশ্নটি সঙ্গত যে, ভেরোনার রোমিও-জুলিয়েত্তা গল্পটি কতটা বাস্তবসম্মত? আসলেই কি সেখানে তাদের অস্তিত্ব ছিল? আজ ভেরোনা গুরুত্বপূর্ণ পর্যটক আকর্ষক স্থান। ফলে কীভাবে জুলিয়েত্তার বাড়ি ও ব্যালকনি প্রদর্শিত হচ্ছে যদি তার সত্যতা না থাকে? তবে কি তা শুধুই গল্প? তবে কি এই পুরনো বাড়ি ও ব্যালকনি বিশেষ উদ্দেশ্যে তার নামে উৎকীর্ণ করা? রোমিওর স্মৃতি ততটা আকর্ষণীয়ভাবে সংগৃহীত নয় কেন? সত্যই বিভ্রান্তিকর!
এই প্রশ্নের উত্তরের মর্মার্থ নিহিত- “এখানে পার্থক্য হলো ‘বাস্তব’ এবং ‘বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে’।” রোমিও-জুলিয়েত্তা এই পৌরাণিক কাহিনি ‘বাস্তবতার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত’ বলে অনুমেয়। শেক্সপিয়ারের নাটক ‘এলবার্ট ব্রুক’-এর ‘রোমিও জুলিয়েট’-এর বিয়োগান্তক ইতিহাস নামক মহাকাব্যিক কবিতার দ্বারা অনুপ্রাণিত, যা শেক্সপিয়ারের রচনার কয়েক দশক আগেই রচিত হয়েছিল। ব্রুক অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, ‘মাত্তেও বানদেল্লো’ রচিত ইতালিয়ান উপন্যাস কর্তৃক। বানদেল্লো নতুনরূপে লুইজি দা পোরতার গল্প অবলম্বনে রচনা করেছিলেন। এসব ‘রোমিও-জুলিয়েট’ কাহিনিকে ১৩ শতকের ভেরোনার ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। ভেরোনা তখন রাজপুত্র বারতোলোমেয়ো কর্তৃক শাসিত, যে কিনা তখন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে বিবাদ নিরসনে চেষ্টারত। দান্তে ঠিক তখন রাজপুত্রের আমন্ত্রণে ভেরোনাতে বসবাস করছিলেন। অন্যদিকে কিংবদন্তি আছে, প্রেমিক যুদ্ধে নিহত হলে প্রেমিকা আত্মহত্যা করে। তবে রচয়িতাদের প্রত্যেকেই এই আত্মঘাতী আত্মত্যাগকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করেছেন। কোনো কোনো কাহিনিতে রোমিও দ-িত হয় বলেও উল্লেখিত।
শেক্সপিয়ারের নাটকে জুলিয়েত্তা বলে, ‘...এখানে এটা কি? আমার প্রিয়তমের হাতে একটা কাপ? দেখছি বিষই তার মৃত্যু ঘটিয়েছে, কিন্তু এক ফোঁটাও কি আমার জন্য ফেলে রাখতে নেই, তা হোক, এখনো তোমার ওষ্ঠাধরে কিছু বিষ লেগে আছে, আমি তোমার অধরোষ্ঠ পান করে আমার জ্বালার অবসান ঘটাব। এখনো উত্তপ্ত তোমার ওষ্ঠ।’
সব ছাপিয়ে ভেরোনার ‘কাজা দেল্লা জুলিয়েত্তা’ বা ‘জুলিয়েত্তার বাড়ি’ আজ সত্যই ‘লটবহরসহ পর্যটক’-এর সার্থক উদাহরণ হতে পারে। এখানে বাড়িটিকে ‘ব্যবসায়িক পুঁজি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে শেক্সপিয়ারের নাটকের সাফল্যের ওপর ভিত্তি করে। যদিও তা যথেষ্ট প্রমাণসিদ্ধ নয় আজও। কাপুলেত্তি ও মোনতেক্কি পরিবারের মধ্যে প্রমাণিত শত্রুতার জের ছিল, যা কিনা ‘দানতে আলিগিয়েরি’ তার ‘ডিভাইন কমেডি’তে উল্লেখ করেছেন (যা শেক্সপিয়ারের জন্মের আগে রচিত), কিন্তু তার প্রেমাংশ ছিল কাল্পনিক। কারও কারও মতে অগ্ন্যুৎসব এবং অদৃশ্য বিয়োগান্ত উপন্যাসের মেটামরফসিস।
‘রোমিও জুলিয়েত্তা’ শেক্সপিয়ার কর্তৃক প্রথম রচিত নয়, বরং তা লুইজি দা পোরতো কর্তৃক ১৫২৪ সালে ‘লা জুলিয়েত্তা’ নামে রচিত হয়েছিল। এই ‘কাজা দেল্লা জুলিয়েত্তা’ বাড়িটি কাপ্পেল্লো পরিবার কর্তৃক ১৩ শতকে নির্মিত, কিন্তু আমরা আজ যে রূপে দেখতে পাই তার নবায়ন শুরু হয়েছিল ১৯ শতকের শেষদিকে বা ২০ শতকের প্রারম্ভে। অভ্যন্তরীণ সজ্জা, গথিক দরজা, ত্রিপত্রাকৃতি জানালা, বিখ্যাত ব্যালকনিসহ যিনি এই বাড়িটিকে জুলিয়েত্তার বাড়ির বৈশিষ্ট্যে রূপদান করেছেন তিনি ‘আন্তনিও আভেনা’। তিনি ভেরোনা জাদুঘরের দায়িত্বশীল পদে কর্মরত ছিলেন ১৯৩৫ সাল অব্দি। বাড়ির আঙিনায় নির্মিত জুলিয়েত্তার ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যের ভাস্কর ‘নেরেও কস্তান তিনি’।