
চিত্র প্রদর্শনী। ছবি: সংগৃহীত
পুরান ঢাকায় যাদের বসবাস তাদের মিলেমিশে থাকার রেওয়াজ এখনো অবশিষ্ট আছে। তাদের খাবারদাবারেও আছে নানা বৈচিত্র্যের সমাহার। ঘুড়ি উড়ানোসহ তাদের এমন কতক উৎসব আছে যেগুলো ব্যস্ত ঢাকাবাসীর হৃদয়কে রাঙিয়ে দেয়। প্রসঙ্গের অবতারণা হলো পুরান ঢাকার সন্তান শিল্পী রিপন দাসের জলরঙ চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজনকে কেন্দ্র করে।
চার শতাধিক বছরের পুরনো নগরের ছোট ছোট গলিপথের দুইপাশে রঙবেরঙের পুরনো দরদালানের সারি, বৈদ্যুতিক খুঁটি আর তারের জঞ্জাল, টেলিফোন বিভাগের তারে বসে থাকা অজস্র কাক, নিচে দোকানপাট, রিকশা ও লোকজনের চলাচল। অনেক বছর ধরে এই দৃশ্যগুলো আমরা সরাসরি দেখে আসছি, তেমনই শিল্পীদের তেলরঙ, অ্যাক্রেলিক ও জলরঙ চিত্রেও প্রায় একই রকম বিষয়ের নানারূপের চিত্রায়ণ দেখতে পাচ্ছি। এর একটি কারণ হলো শিক্ষার্থী শিল্পীর অনুশীলনের জন্য পুরান ঢাকার অলিগলি চষে বেড়াতে হয়, পুঁতিগন্ধময় বুড়িগঙ্গার তীরে যেতে হয়। এভাবে অনুশীলনের এক পর্যায়ে গলিপথ ওদের আঁকার অন্যতম বিষয় হয়ে ওঠে। রিপন দাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে সম্মানসহ ২০০০ সালের স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ। শিক্ষার্থী জীবনে জলরঙ ও তেলরঙ মাধ্যমের চিত্র এঁকে চারুকলার বার্ষিক চিত্র প্রদর্শনীতে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জনের কৃতিত্ব জমা হয়েছে তার ঝুলিতে। নিজে ছবি আঁকার পাশাপাশি ঢাকার এক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়াচ্ছেন।
চিত্রশিল্পীদের চোখের সামনে দিনের পর দিন যেসব দৃশ্য ভেসে ওঠে, আশপাশ দিয়ে নানা চরিত্র চলাচল করে সেসব ছবি গেঁথে যায় শিল্পীর চোখ থেকে মনে। পুরান ঢাকায় বেড়ে ওঠা ও বসবাস করায় চিত্রশিল্পী রিপন দাসের আঁকা চিত্রকর্মে আমরা সেসব বৈশিষ্ট্যের সরব উপস্থিতি দেখতে পাই। ফলে তার পটে গ্রামীণ নিসর্গের উপস্থিতি থাকলেও তিনি প্রধানত পুরান ঢাকার অলিগলি, মসজিদ, পুরনো স্থাপনা এবং নানা মানুষের নানা ভঙ্গির বিচিত্র সব অবয়ব চিত্রপটে মেলে ধরেছেন। প্রকৃতির দৃশ্য তার তুলিতে ধরা পড়েছে ভ্রামণিক মেজাজে পাহাড়ি রূপের ডালি নিয়ে। পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বয়স্ক এক পুরুষ অবয়ব এঁকেছেন তার বহন করা বাঁশের কয়েকটি ঝুড়ি সমেত। বুড়িগঙ্গায় দেখা নৌকা এঁকেছেন হঠাৎ, যেন চোখ থেকে সরে যাওয়ার আগে তাকে চিত্রপটে তুলে ধরেছেন দেখার ঝটিতি আনন্দে! কথাটি এলো শিল্পীর আঁকার ধরন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে। রিপন জলরঙে প্রধানত প্রথম ওয়াশেই মূল কাজটি শেষ করেন। ফলে তার কাজ দেখতে ভালো লাগে। আবার তুলির ছোট ছোট স্ট্রোকেও তিনি আঁকেন। স্পেস ছেড়ে দেওয়া ও বর্ণলেপনের চমক দর্শককে মোহাবিষ্ট করার মতো ক্ষমতা রাখে। তার জলরঙ চিত্রপট বিচিত্র বর্ণিল, বর্ণ প্রয়োগ এবং আলোছায়ার ব্যবহারের দক্ষতায় উজ্জ্বল।
ঠিক প্রতিকৃতি বলা যাবে না এমনভাবে দ্রুতলয়ে জলরঙের ছন্দ মেনে চেনা-অচেনা নানা মানুষের অবয়ব এঁকেছেন। রঙ চাপানো ও আলোছায়ার প্রয়োগে তার মুন্সিয়ানা আমাদের দর্শক চোখ আকৃষ্ট করে।
আশার কথা-দেশে সম্প্রতি তরুণ শিল্পীদের মধ্যে জলরঙ চিত্রকলার অধিক চর্চা ও পসার দেখা যাচ্ছে। ঢাকায় আয়োজিত ইদানীংকালের অনেক প্রদর্শনীতেও জলরঙ ছবির আধিক্য ছিল। রিপন দাস নিজেও জলরঙ প্রসারে নিষ্ঠাবান সাধক হতে নিয়মিত নিজের চর্চা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর প্রামাণ্য ঢাকার ধানমন্ডিতে সফিউদ্দিন শিল্পালয়ে তার চিত্র প্রদর্শনীতে দৃশ্যমান। রিপনের আঁকা সহজ, সাবলীল, বর্ণিল, স্বচ্ছন্দ গতিময় জলরঙ ছবিগুলো দর্শকরা নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন।