Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান ভাবনা

Icon

এস ডি সুব্রত

প্রকাশ: ০৫ মে ২০২৪, ২০:৪৭

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান ভাবনা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি: সংগৃহীত

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের সকল শাখায় তার বিচরণ, প্রেম সৌন্দর্যের এক অনন্য রূপকার তিনি, আবার বিজ্ঞানচিন্তক। রবি ঠাকুরের সমস্ত জীবনকর্মই মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য। ছেলেবেলা থেকেই কবিগুরুর বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ ছিল। মানবতার সাধক সুন্দরের পূজারি রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন, ‘আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য; কিন্তু বাল্যকাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না।’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উনিশের শেষ ভাগে এবং বিশ শতকের প্রথমভাগে বেঁচে ছিলেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগেই ইউরোপে শিল্প বিপ্লব ঘটে যায়। স্টিম ইঞ্জিন ব্যাপকভাবে চালু হলে পৃথিবীর দূরত্ব ঘুচতে শুরু করে, সভ্যতার বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ঠিক আগেই ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ জীববিদ্যার ক্ষেত্রে বিপুল পরিবর্তন ঘটিয়ে বসে। প্রায় একই সময়ে রসায়নবিদ্যায় নানা আবিষ্কার, বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহার, জীবাণুতত্ত্বসহ নানা উদ্ভাবন মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক রূপান্তর ঘটাতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ জন্মের পর শৈশবেই সকল নতুন নতুন উদ্ভাবনার কথা জানতে পারলেন। আমরা জানি বালক রবীন্দ্রনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মনোযোগী ছাত্র না হয়ে উঠতে পারলেও ঠাকুরবাড়ির পাঠশালায় গৃহশিক্ষকদের রুটিন পাঠের হাত থেকে রেহাই পাননি। গণিত, জ্যামিতি, ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যায় পাঠ নিতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের। আর সাহিত্যে পাঠ নিতে হতো মেঘনাদবধ কাব্য থেকে। রবীন্দ্রনাথ তার ‘জীবনস্মৃতি’তে আমাদের জানাচ্ছেন, কঙ্কাল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মানবদেহের খুঁটিনাটি শেখাতেন এক পণ্ডিত। আর মানবদেহের বৈজ্ঞানিক পাঠ নিতে মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে লাশকাটার আদ্যোপান্তও দেখতে যেতে হতো ঠাকুরবাড়ির কিশোর বালকদের। অল্প বয়সে বিজ্ঞানের এসব চর্চায় রবীন্দ্রনাথের কিশোর মন বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। কবি আরও বলেছেন, সপ্তাহে একদিন রবিবার ‘সীতানাথ দত্ত ঘোষ মহাশয় আসিয়া যন্ত্রতন্ত্রযোগে প্রকৃতি বিজ্ঞান শিক্ষা দিতেন।... যে রবিবার সকালে তিনি না আসিতেন, সে রবিবার আমার কাছে রবিবার বলিয়াই মনে হইত না।’ তিনি পিতার সাথে যখন ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে যেতেন সেটা নিছক পাহার দর্শন থাকত না; পাহাড়ে বেড়ানোর প্রতিটি সন্ধ্যা অবলীলায় জ্যোতির্বিদ্যার প্র্যাক্টিক্যাল সেশন হয়ে উঠত। জ্যোতির্বিদ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্রকে পাহাড়ের চূড়া থেকে সন্ধ্যাবেলায় দূরবীক্ষণ যন্ত্রযোগে নক্ষত্রমণ্ডলীর গ্রহ নক্ষত্রদের চিনিয়ে দিতেন। পিতার কাছ থেকে পাওয়া ধারণা নিয়েই কবিগুরু বারো বছর বয়সে ১৮৭৩ সালে লিখেছিলেন প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ‘ভারতবর্ষীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ঠাকুরবাড়ি থেকে শিশু-কিশোরদের জন্য ‘বালক’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। রবীন্দ্রনাথ সে পত্রিকায় পদার্থবিদ্যা, জ্যোর্তিবিদ্যা ও ভূবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান বিষয়ে শিশু-কিশোর উপযোগী লেখা দেবার জন্য নিয়মিত লেখক হিসেবে মনোনীত হন। ‘বালক’ পত্রিকায় বালক কবি প্রায় প্রতি সংখ্যায় লিখতেন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ক এক  প্রবন্ধ লিখে বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশ চন্দ্রকে চমকে দিয়েছিলেন। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহবশেই তিনি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্রের সাহচর্য পেয়েছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্রের গবেষণার বিষয় নিয়ে ‘বঙ্গদর্শন’-এ রবীন্দ্রনাথ ‘জড় কি সজীব?’ এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যেটি ১৯০১ ছাপা হয়েছিল। সেটি পড়ে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু বিস্মিত হয়েছিলেন আর তিনি তার সেই বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে, ‘তুমি যদি কবি না হইতে তো শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হতে পারিতে।’

রবীন্দ্রনাথ বৈজ্ঞানিক হতে চাননি কিন্তু আজীবন বিজ্ঞান চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন মানবকল্যাণের কথা ভেবে। বিজ্ঞানের ক্রম অগ্রগতি তিনি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতেন। তিনি যখন ১৯২৬ সালে ইউরোপের পথে বেরুলেন-গেলেন জার্মানিতে, গেলেন আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করতে। সেখানে আইনস্টাইনের কাছে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথা জানতে পারলেন। ফিরে এসে তিনি অনুজ সত্যেন বোসকে খুঁজে বের করলেন এবং তার সঙ্গে বিজ্ঞান চর্চায় যুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিজ্ঞানবোধের অভাবটি বুঝতে পারেন না; রবীন্দ্রনাথ তার গোটা জীবনের বিজ্ঞান ভাবনাকে পরিণত বয়সে এসে গ্রন্থিত করার কথা ভাবেন। তিনি ১৯৩৭-এ ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে যে প্রবন্ধ সংকলনটি প্রকাশ করেন সেটি মূলত বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ। সহজ বাংলায় বিজ্ঞানের অমন  কঠিন বিষয়গুলো পরিচিতি দিয়েছেন ‘বিশ্বপরিচয়’ নামের গ্রন্থে। জীবনভর এক অসম্ভব বিজ্ঞানভাবনা কবির মনকে প্রভাবিত করেছিল। কুসংস্কার ও জড়তা ত্যাগ করে মানুষের বিজ্ঞানমনস্ক মনোভাবকে এগিয়ে রাখতেন তিনি। মৃত্যুর ৪ বছর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞান বিষয়ক একমাত্র গ্রন্থ ‘বিশ্বপরিচয়’, যেখানে আমরা পাই ভূলোক, নক্ষত্রলোক, পরমাণুলোক নামক প্রবন্ধ তা তার বিজ্ঞান মনস্কতার পরিচয় বহন করে এবং মানুষকে করে তোলে বিজ্ঞান মনস্ক। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন মানুষের মাঝে বিজ্ঞানের অভাববোধ না থাকাটাই মানুষকে পেছনে ফেলে রাখে এবং তিনি বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞানের অগ্রগতিই সভ্যতার ভিত্তি মজবুত করতে পারে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫