
বাঁশখালী মালেকা বানু চৌধুরী জামে মসজিদ। ছবি: লেখক
ভালোলাগা, প্রেম কিংবা বিরহ মানব জীবনের এ তিন হৃদয়ঘটিত আবেগময় অনুভূতি নিয়ে রচিত হয়েছে বহু কাব্য, আলেখ্য ও লোকসংগীত। তবে এ দিক থেকে দেখলে প্রণয়ের সফল পরিণয়ের জয়গান খুব কম। বাঙালি হয়তো স্বভাবতই অসফল প্রণয়-বিরহে সুখের অনুভূতি খুঁজে নিতে পছন্দ করে, তাই সাহিত্য-সংগীতেও বারবার উঠে এসেছে বিরহ আর ভগ্ন হৃদয়ের আর্তনাদ। এই হিসেব-নিকেশগুলো তুলে রেখে চট্টগ্রামের একটি প্রাচীন লোকসংগীতের সুরে কান পাতলে শোনা যায়, প্রণয়ের সফল পরিণয়ের জয়গান। সাগরপাড়ের ও-ই জনপদ থেকে ভেসে আসছে, ‘মালকা বানুর দেশে রে/বিয়ার বাইদ্য আল্লা বাজে রে/মালকার বিয়া হইব মনু মিয়ার সাথে রে...।’
এক সময় চট্টগ্রামের গ্রামে-গঞ্জে বিয়ের আসরে নারীরা দলবেঁধে এ গান গেয়ে আসর জমাতেন। কিন্তু কালের স্রোতে আজ ভাটারটান, প্রযুক্তির কল্যাণে আধুনিক মিউজিক সিস্টেম ক্রমশ দখল করে নিয়েছে বিয়ের আসর, মানুষেরও বদলেছে বিনোদনের স্বাদ। তবে আজও মাঝে মাঝে দূর পাড়াগাঁয়ের বিয়ের আসরে নারীদের সম্মিলিত কণ্ঠ উদ্বেলিত করে, ‘মালকা বানুর সাত ভাই, অভাইগ্যা মনু মিয়ার কেহ নাই/মালকার বিয়া হইব মনু মিয়ার সাথে রে...।’
স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই মালকা বানু আর মনু মিয়া? চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে রচিত গ্রন্থ ‘দেয়াঙ পরগণার ইতিহাস’ সূত্রে জানা যায়, মোগল সম্রাট শাহজাহানের দ্বিতীয় পুত্র ও বাংলার সুবাদার শাহ সুজার সেনাপতি ছিলেন শেরমস্ত খাঁ। আর এই শেরমস্ত খাঁর একমাত্র পুত্র জবরদস্ত খাঁ ওরফে মনু মিয়া। কাট্টলীর জমিদার বদিউজ্জামানের বোন খোরসা বানুকে মনু মিয়া বিয়ে করেন, কিন্তু মনু মিয়া ও খোরসা বানুর ঘরে কোনো সন্তান হয়নি। তারপর তিনি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সরল গ্রামের সওদাগর আমির মোহাম্মদ চৌধুরীর কন্যা মালকা বানুকে বিয়ে করেন। মনু মিয়া ও মালকা বানুর এ বিয়ে নিয়ে রয়েছে চমৎকার এক কিংবদন্তি, ‘জমিদার মনু মিয়ার বাড়ি ছিল বর্তমান আনোয়ারা উপজেলায়। কিন্তু বাঁশখালীতেও তার জমিদারি ছিল। জমিদারি দেখভালের কাজে একদিন মনু মিয়া পাইক-পেয়াদার বহর নিয়ে বাঁশখালীর সরল গ্রামে যান, সে গ্রামের মক্তবে কাজির কাছে পাঠরত নয়-দশ বছর বয়সী মালকা বানুকে দেখে তার রূপে মনু মিয়া মুগ্ধ হয়ে যান। পরে মনু মিয়া কাজির মক্তবে আরও একবার যান মালকাকে দেখতে, তারপর থেকে মনু মিয়া মালকার প্রতি ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকেন। শয়নে স্বপনে শুধুই মালকার কথা ভাবতে থাকেন মনু মিয়া। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মনু মিয়া বারবার ছুটে যেতে থাকেন মালকা বানুর বাড়ি। মালকা বানুকে যে মনু মিয়া ভালোবাসেন, এ গল্পটি দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে যায়। একদিন মনু মিয়ার পক্ষ থেকে মক্তবের কাজির মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয় মালকা বানুর বাড়িতে। প্রস্তাব শুনে মালকা বানুর বাবা রাজি হয়ে যান। কিন্তু বাদ সাধলেন মালকা বানু, কারণ তীব্র স্রোতের শঙ্খ নদ নৌকায় পার হতে মালকা ভয় পান। তবে শঙ্খ নদে যদি বাঁধ দিয়ে তাকে পার করার ব্যবস্থা করা হয় তবেই সে মনু মিয়াকে বিয়ে করতে রাজি হবে। এ কথা শোনার পর মনু ঠিক করলেন-নদে বাঁধ দিয়ে সড়ক তৈরি করবেন এবং মালকাকে বিয়ে করে আনবেন। তারপর মনু মিয়া শঙ্খ নদে বাঁধ দেওয়ার প্রস্তুতি নিলেন এবং হাজার শ্রমিক নিয়োগ করেন নদে বাঁধ দেওয়ার জন্য। বাঁধ নির্মাণ শেষ হলে মনু মিয়া মালকা বানুকে বিয়ে করে তার বাড়ি নিয়ে যান। ধীরে ধীরে আশপাশের অঞ্চলে মনু মিয়া ও মালকা বানুর বিয়ের গল্পটি লোকগান আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে এ গান আজও গ্রামে-গঞ্জে মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
মালকা বানু ও মনু মিয়ার পরিণয়ের গল্পটি নিয়ে ১৯৭৪ সালে ফয়েজ চৌধুরীর পরিচালনায় ‘মালকা বানু’ নামে একটি সাদাকালো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং ১৯৯১ সালে কামরুজ্জামানের পরিচালনায় ‘রঙিন মালকা বানু’ নামে চলচ্চিত্রটি পুনর্নির্মিত হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রে মূল গল্পটি হুবহু তুলে ধরা হয়নি। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, গানটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের হলেও গানের কথায় চট্টগ্রামের ভাষার আধিক্য নেই। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য গবেষক শামশুল আরেফীন জানালেন, ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এ গানের কোনো রূপ আলাদা করে পাওয়া যায় না। একটা লোকসংগীত যখন ছড়িয়ে যায় তখন একেক জায়গায় একেক রকমভাবে তা গাওয়া হতে থাকে।’ মালকা বানু ও মনু মিয়ার ঘরেও কোনো সন্তান জন্ম নেয়নি। মনু মিয়ার মৃত্যুর পর তার প্রথম স্ত্রী শশুর বাড়িতেই থেকে যান। কিন্তু মালকা বানু ফিরে যান বাবার বাড়ি, তার মৃত্যুর পর সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয়।