
সকাল থেকেই আগুন আগুন রোদ ছিল। এখন কমলা রং বিকাল। তার মাথার উপর ছড়িয়ে আছে বাঁশঝাড়, সরু পিচপথে ছায়া ছায়া বুনো শান্তি, ডান দিকে হঠাৎ হঠাৎ একতলা-দোতলার থাইঅ্যালুমিনিয়ামের কাচে সূর্যের সাত রং বুঝি চাগিয়ে উঠতে চায়। তবু সুপারি-নারিকেলের বাগান, মাঝেমধ্যে ঠাসা জঙ্গল। ফুরফুরে বাতাস বিকালটাকে সঙ্গ দিয়ে ধন্য করেছে আর আরমান সাহেবও হাঁটছেন খুব আয়েশ করে। তিনি একটা সরকারি কলেজে ইতিহাস পড়ান। যদিও দেশ থেকে লেখাপড়া প্রায় উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তবু কিছু ছাত্রছাত্রী তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে। পথেঘাটে দেখা হলে সালাম-কালাম বিনিময় করে।
শরীর-স্বাস্থ্যের খবর জানতে চায়, দুই-চার কথার মধ্য দিয়ে আলাপটাকে আরমান সাহেব ইতিহাসের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন।
আরমান সাহেব চারপাশটায় নজর বুলিয়ে দেখেন, রাস্তার বাঁ দিকের কঞ্চিতে বসে আছে একটা মাছরাঙা। পাখিটার চোখ নিচে নদীর দিকে। মানুষের আনাগোনা খুব কম। নগরের অংশ বলে ভাবাই যায় না। মাত্র চল্লিশ টাকা খরচ করে শহরের হৃৎপিণ্ড থেকে এখানে চলে আসা যায়।
নদীপাড়ের প্রকৃতিকে মানুষ ইসরায়েলি দখলদারদের মতো নিষ্ঠুরভাবে তছনছ করছে। তারপরও যে ছিটেফোঁটাটুকু অবশিষ্ট আছে সেটুকুতে মন চলে যায়। বিপন্ন প্রকৃতি লড়াই করে নীরবে। তাই পথের পাশে অচেনা ফুলের গন্ধে আরমান সাহেবের মন উদাস হয়। দুঃখ দুঃখ লাগে। দৃষ্টি নদী পেরিয়ে বহু দূর চলে যেতে চায়; কিন্তু কিছু দূর গিয়ে আটকে যায়। সবুজ টিলার ফাঁকে ঘরবাড়ি, স্কুল, সুউচ্চ মিনার বিশিষ্ট বিশাল বিশাল মসজিদ। ফাঁকে ফাঁকে তরিতরকারির ক্ষেত, লাউ-শিমের মাচা। মাচার ছায়ায় বসে দুই তরুণ স্মার্ট ফোনে তাদের মর্জিমতো বিশ্বে বিরাজ করছে।
দুই
আসসালামু আলাইকুম। হঠাৎ এক নারী-কণ্ঠ তাকে শুভ কামনা জানালে চিন্তামগ্ন আরমান সাহেব হকচকিয়ে ওঠেন। চেয়ে দেখেন সেই মেয়েটি। যার সৌন্দর্য তাকে লুব্ধ করেছে। তার সাথে প্রায়ই সিএনজি স্টেশনে মেয়েটির চোখাচোখি হয়। এখন নিজেদের অচেতনে, চোরা হাসি বিনিময়ের মাধ্যমে তারা পরস্পরের অন্ধকার আচ্ছন্ন মহাদেশে আলো ফেলতে শুরু করেছেন।
মুখে মিটিমিটি হাসি ফুটিয়ে মেয়েটিই প্রথম কথা বলেন, আপনি এখানে?
আরমান সাহেবের দুই কান লাল হয়ে ওঠে, আত্মরক্ষার্থে তিনি মিথ্যা বলেন, সামনেই বন্ধুর বাড়ি।
ঘনিষ্ঠজনের মতো মেয়েটি এবার তার দিকে পূর্ণ চোখে তাকান। এই প্রথম এত কাছ থেকে তাদের দেখাদেখি। মুখমণ্ডলের তুলনায় ছোট কিন্তু গভীর কালো চোখ দুটোতে মেয়েটির মুগ্ধতা ঝলমল করছে। মেয়েটির লাল আর পুরুষ্ট ঠোঁট দুটো এবার নড়ে ওঠে, বড় আপাকে দেখতে এসেছিলাম। একটু পেছনেই তাদের বাড়ি।
আরমান সাহেব মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করে ফেলেন, আপনার সাহেব?
মেয়েটি মুখ নিচু করেন। লজ্জায় আরমান সাহেবের দুই কান আবার লাল হয়। তিনি আধবোজা চোখে সব দেখেন, মেয়েটির দীর্ঘ আর মজবুত দেহ, কিশোরদের মতো ওপরের ঠোঁটে গোঁফের কালো রেখা, সারাটা মুখ জুড়ে গোপন একটা ছায়া যেটা তাকে করেছে দুর্ধর্ষ সুন্দরী আর ব্যক্তিত্বময়ী। অন্তত আরমান সাহেবের চোখে। মনে মনে তিনি ঠিক করেন, যদি কখনো উপন্যাস লেখেন তবে প্রধান চরিত্র হবে এই মেয়েটি: গা-গতর ধবধবে ফর্সা-হলুদ, গড়পড়তা মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা-চওড়া আর দেহের গড়নগাড়নও পুরুষের মতো শক্ত-পোক্ত। মাথার চুল কোমর ছাড়িয়ে গেছে, পুরুষ্ট যৌবন, ভারী নিতম্বের খাঁজ কোমর থেকে উঠে গেছে পিঠ পর্যন্ত। সরকারি প্রাথমিক স্কুলে পড়ান।
ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছরের যৌবন হলুদ চামড়া ফেটে পড়ে যেতে চায়। অথচ তার বিয়ে হচ্ছে না! তিনি বিশালদেহী এক নারী। ঠোঁটের ওপর গোঁফও আছে। তাকে নাড়াচাড়া করবার মতো ‘আগা আব্দুর রহমান’ বঙ্গদেশে কি বিরল?
মেয়েটি আড় চোখে আরমান সাহেবকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আরেকবার দেখে নেন : মোটা মোটা হাড়ের মেদহীন সবল আর দীর্ঘদেহী পুরুষ। একটু লাজুক লাজুক গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, উজ্জ্বল ফর্সা রঙের সাথে চকচকে কালো দাড়ি-গোঁফ তাকে করেছে সুদর্শন। আর কড়া আতরের গন্ধের মতো ঘামের গন্ধ মেয়েটিকে একটু আনমনা করে।
তিন
বুকে একটু চিনচিনে ব্যথা নিয়ে আরমান সাহেব হাঁটতে শুরু করেন। পাশে পাশে মেয়েটি। তার পায়ের গোড়ালিতে ময়লা! মনটা দমে যায়। তিনি ভাবেন মেয়েটি সুন্দরী, সমুদ্র সৈকতের মতো বিশাল ও লোভনীয় কিন্তু অলস ও অপরিচ্ছন্ন। তার ডান হাতের কব্জিতে একটা জন্মদাগ আছে। সাইজে পাঁচ টাকার কয়েনের মতো। কালচে আর স্যাঁতসেঁতে দাগটায় চোখ পড়তেই আরমান সাহেবের দেহমন ঘিনঘিন করে ওঠে।
পেছন দিক থেকে একটা ইজিবাইক আসছে। সরু রাস্তার এক পাশে তারা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। তাদের এক দিকে জঙ্গল, আরেক দিকে রাস্তা পেরিয়ে নদী। মেয়েটি নদী দেখতে দেখতে হঠাৎ আরমান সাহেবকে চোরা চোখে আরেকবার দেখেন : পুরুষ! তবু তার নাকের ডান পাশে একটা তিল আছে! যা তাকে একটুও মানায়নি। কালো টি-শার্টের সাথে সে পড়েছে ছাইরঙ প্যান্ট! মেয়েটির সুন্দর নাকটা একটু কুঁচকে ওঠে।
যাত্রীশূন্য ইজিবাইকটা কাছাকাছি আসতেই তিনি বলেন, ভালোই হয়েছে।
মুখের তুলনায় ছোট চোখ দুটোতে ঝলক দিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করেন, আপনি যাবেন না?
না। বন্ধুর সাথে দেখা হওয়াটা খুব জরুরি।
প্রথমে গুনগুন, তারপর শোঁ শোঁ শব্দ তুলে ইজিবাইকটা চলতে শুরু করে। নদী দিয়ে দুইটা ইঞ্জিন বোট যাচ্ছে, শব্দে কানে তালা লাগে। এর মধ্যেই মেয়েটির করুণ করুণ চোখ আরমান সাহেবের চোখে আটকে যায়।
চার
আরমান সাহেব মন খারাপ করে ঘন ছায়ার নিচে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। চোখের সামনে থেকে ইজিবাইকটা সরে যেতেই বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করে। অসহায়ের মতো একটা চোরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হাতের দাগটা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। একটু কষ্ট হলেও মনে মনে ঠিক করে ফেলেন, আগামীকাল থেকে মুখ নিচু করে সিএনজি স্টপেজটা তাকে পেরুতে হবে। আর কিছুতেই তিনি মেয়েটির চোখে চোখ রাখবেন না।
পাঁচ
আরমান সাহেব একটা সিগারেট ধরান। কিছু ধোঁয়া তার মাথার উপর দিয়ে চিরতরে হারিয়ে যায়। কিছু মুহূর্ত কান্নার মতো রেশ তুলে শুধু শুধু অসীমে মিলায়। তবু সব ফুরায় না। তাই বুনো বুনো প্রকৃতির মধ্যে জনমানবশূন্য রাস্তাটা বুঝি হাই তোলে। পাশের জঙ্গল থেকে এসে যোগ দেয় অচেনা ফুলের গন্ধ...আর তার মন-মগজ, গায়ে-পায়ে কী যেন শেকলের মতো পেঁচিয়ে তাঁকে ধরে রাখে! শত চেষ্টাতেও আরমান সাহেব পা তুলতে পারছেন না! তার চোখে আটকে আছে মেয়েটির সুন্দর কিন্তু জন্মদুঃখীর মতো মুখটা।