
দর্শনার্থীদের সঙ্গে লেটার প্রেস নিয়ে কথা বলছেন শিল্পী সব্যসাচী হাজরা। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
গত শতাব্দীর আশি নব্বই দশকেও আপনি যদি স্কুলে পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই ‘শিশু শিক্ষা’য় পড়েছেন :
‘পাখী-সব করে রব, রাতি পোহাইল
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল ॥
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে ॥’’
নিশ্চয়ই আপনি পড়েছেন সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শ লিপি’। আপনার শৈশবেই মনে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল: ‘অসৎসঙ্গ ত্যাগ কর। আলস্য দোষের আকর। উগ্রভাব ভালো নয়। একতা সুখের মূল’ ইত্যাদি।
কিন্তু আপনার সন্তান হয়তো ‘আদর্শ লিপি’র নামই জানে না। সে যদি কিন্ডারগার্টেন এমনকি সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থীও হয়ে থাকে, তারপরও ‘আদর্শ লিপি’ তার পাঠ্য নয়। নতুন যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসেছে নতুন বই, কারিকুলাম।
অন্যদিকে এখন ঝকঝকে কাগজে রঙিন অক্ষরে ছাপা বইয়ের হরফেও এসেছে পরিবর্তন। লেটার প্রেসের যে ‘বিউটিফুল মিসটেক’-তা এখন কম্পিউটার ও আধুনিক অফসেট প্রেসে ছাপা বইতে নেই। কিন্তু তারপরও লেটার প্রেসে ছাপা নিউজপ্রিন্টের কাগজের সেই আদর্শ লিপি কি এখনো আপনাকে নস্টালজিক করে দেয় না?
সাধারণ মানুষ তো বটেই, শিল্পীর সংবেদনশীল মনে এই নস্টালজিয়া আরও তীব্র। তা ছাড়া যা কিছু অতীত, যা ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে, সেগুলোকে ধরে রাখা বা নতুন করে সামনে নিয়ে আসার তাগিদ ও দায়বোধও শিল্পীর থাকে। সেই দায়বোধে তাড়িত শিল্পী সব্যসাচী হাজরার অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার আদি হরফ ও শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত বইগুলো নতুন করে দেখার সুযোগ পেল দেশর মানুষ।
‘বর্ণমালা : বাংলা বর্ণ পরিচয় (১৮৪৯-১৯৪৮)’ শীর্ষক বাংলা প্রাইমার সংকলন গ্রন্থের প্রকাশনা উপলক্ষে রাজধানীর আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে হয়ে গেল ১৫ দিনব্যাপী (৩ থেকে ১৮ মে ২০২৪) প্রদর্শনী।
সব্যসাচী হাজরা বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান প্রচ্ছদ শিল্পী। অসংখ্য বইয়ের মধ্য থেকে তার প্রচ্ছদকে সহজেই আলাদা করা যায় যেসব কারণে, বাংলা হরফের বৈচিত্র্য তার অন্যতম। বলছেন, বর্ণমালার প্রতি তার যে বিশেষ আগ্রহ, ভালো লাগা, তারই বহিঃপ্রকাশ এই প্রদর্শনী।
একটা সময় পর্যন্ত ধীর গতির লেটার প্রেসে বই, পত্র-পত্রিকা, পোস্টার ইত্যাদি ছাপা হতো। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার ভেতরেও বাংলা হরফের নানারকম চেহারা আমরা দেখেছি। শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় একেকটি অক্ষর পরিণত হতো শিল্পকর্মে। কিন্তু এখন বই ও পত্র-পত্রিকার ছাপায় বর্ণমালার সেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই বললেই চলে।
এই বাস্তবতায় সব্যসাচী বাংলার মানুষকে কিছুটা নস্টালজিক করে দিতে চেয়েছেন। গঠনশৈলী, নান্দনিকতা ও উপস্থাপনার বিশেষত্বের কারণে আটটি প্রাইমারকে তিনি সংকলনের জন্য নির্বাচন করেছেন। সময় ধরে (১৮৪৯ থেকে ১৯৪৮) বিন্যস্ত করেছেন। এগুলো হলো মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়, রামসুন্দর বসাকের বাল্যশিক্ষা, সীতানাথ বসাকের আদর্শ লিপি, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের হাসিখুসি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রাক্ষর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজ পাঠ-যা অলংকৃত করেছেন নন্দলাল বসু এবং সত্যজিৎ রায়ের অলংকরণে হাতেখড়ি, যার রচয়িতা বিমলচন্দ্র ঘোষ।
শুধু বাংলা হরফের এই আদি নিদর্শনগুলোর সঙ্গে এই সময়ের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া বা নতুন করে উপস্থাপনই নয়, বরং এখন জাদুঘরে চলে যাওয়ার অবস্থা হয়েছে যে লেটার প্রেসের, তার সঙ্গেও বর্তমান প্রজন্মের পরিচয় ঘটাতে চেয়েছেন সব্যসাচী। প্রদর্শনীস্থলে তিনি নিয়ে আসেন নীলক্ষেতের মুদ্রণশিল্পী হালিম হোসেন এবং তার লেটার প্রেসটিকেও। প্রদর্শনীতে আসা দর্শকদের তিনি দেখান কী করে লেটার প্রেসে ছাপা হয়। এই সময়ের আধুনিক অফসেট প্রেসের সঙ্গে তার কী দারুণ পার্থক্য, সেটি হোক গতি কিংবা শব্দে; হোক ছাপার মানে, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই এই প্রদর্শনীর একটা বড় উদ্দেশ্য।
মূলত এই প্রেসটাকে ঘিরেই প্রদর্শনী। এতে হরফ মুদ্রণের কৌশল ও কারিগরি দেখে নতুন প্রজন্মের পক্ষে জানার সুযোগ হচ্ছে কেবল বাটন চাপলেই হরফ তৈরি হয়ে যেত না। পুরো আয়োজনটা ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। সব্যসাচীর ভাষায়, ‘একটি ছাপা হওয়া বই এক জীবনের সমান দীর্ঘ। বই তাই যত্নে রাখা হতো, একই বই তিন-চার প্রজন্মের হাত ঘুরত।’
তিনি বলছেন, ‘ছাপার অক্ষরে শিশুতোষ বইয়ের ভেতরে বাংলা বর্ণমালার যে আদি নিদর্শনগুলো আমরা দেখছি, এগুলো হঠাৎ করে আসেনি। আড়াইশ বছর হতে চলল বাংলা হরফগুলো বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে বানান, পাল্টে যাচ্ছে বাক্যের বিন্যাস। স্বরবর্ণে লি বলে হরফ ছিল, বিসর্গ ছিল স্বরবর্ণের অন্তর্ভুক্ত। এই যে পরিবর্তন, সেটিই আমরা ধরতে চেয়েছি।’
প্রদর্শনী দেখতে আসা উম্মে সুলাইমা (৩২) বলেন, ‘আদর্শ লিপি এখন প্রদর্শনীর বিষয়। অথচ আমরাও এটা পড়েছি। এখন তো নিজেকে আদিম যুগের মানুষ মনে হচ্ছে।’