Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: সিনেমায় কবিতা যাপন

Icon

আশিক মাহামুদ

প্রকাশ: ১৯ জুন ২০২৪, ১৬:৫০

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: সিনেমায় কবিতা যাপন

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। ছবি- সংগৃহীত

তিনি একজন স্বপ্নচারী মানুষ। ভালোবাসেন স্বপ্ন দেখতে, স্বপ্নের ছবি আঁকতে। কখনো সেই স্বপ্ন মূর্ত হয় সাদা কাগজের বুকে শব্দের বিন্যাসে, কখনো বা তা রুপালি পর্দার ক্যানভাসে। কিন্তু মাধ্যম কবিতা অথবা চলচ্চিত্র যেটাই হোক না কেন দিন শেষে তিনি এক স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, যিনি নিজেই কেবল স্বপ্নের চাষাবাদ করেন না, তার নিভৃত স্বপ্ন খামারে বরং স্বপ্নের সোনাঝরা রঙকে তিনি গভীর মমতায় ছড়িয়ে দেন তার পাঠক কিংবা মোহগ্রস্ত দর্শকের বোধের স্বপ্নলোকে।

আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্ন বিশ্বাসী এক শিল্পী বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। যার সামনে এসে এলোমেলো হয়ে যায় অবক্ষয় এবং অবদমনের দীর্ঘ মিছিল, বোধের বিপন্ন আকাশ জুড়ে ঢেকে থাকা নিষেধাজ্ঞার কালো মেঘ মুহূর্তেই যিনি উড়িয়ে দেন বিমূর্ত পরাবাস্তবতার কাব্যিক সুষমায়, কিংবা শৃঙ্খলিত মানুষের চির আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা; যে কিনা অহর্নিশ ছুঁতে চায় দিগন্ত রেখার মেঘ। যার বাধাহীন উড়ে চলায় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাঁটাতারের বেড়াজাল, সেখানেও আমরা দেখতে পাই, স্বপ্নচারী বুদ্ধদেবকে যিনি তার দর্শকদের শোনান এক অনাগত পৃথিবীর গল্প, যেখানে মানুষ অনেক মানবিক। পাশবিকতা ও নির্মমতার শিকার হয় না, যেখানে উত্তরাকে নিঃস্ব সর্বস্ব হারানোর যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে হয় না, সে অনেক বেশি স্বাধীন, নিরাপদ।

বুদ্ধদেবের গল্পের চরাচর জুড়ে সেইসব উদ্বাস্তু, আদিবাসী কিংবা নিম্ন বর্গীয় প্রান্তিক মানুষের বসবাস, অভিজাত মধ্যবিত্তের কাছে যারা অপাঙ্ক্তেয়, যাদের অসহায়ত্বের গল্পে অনাগ্রহ শহুরে মিডিয়ার। এই হতভাগ্য, নিপীড়িত মানুষদের গল্পগাথাই মূলত বুদ্ধদেবের উপজীব্য। ‘টোপ’-এর দারিদ্র্য, অসহায় গ্রামীণ শিকারি, ‘চরাচর’-এর পাখি বিক্রেতা লখাই, ‘উড়োজাহাজ’-এর মেকানিক বাচ্চু মন্ডল, ‘লাল দরজা’র গাড়ি চালক অথবা ‘উত্তরা’র সহজ সরল গ্রামের এক মেয়ে উত্তরা-এরাই ফিরে ফিরে এসেছে বুদ্ধদেবের গল্পে, আমাদের বোধের দরজার কড়া নেড়ে তারা যেন বলতে চেয়েছে, এই সমাজটা শুধু সুশীল মধ্যবিত্তেরই নয়, এখানে তাদের মতো নিচু তলার, নিম্নবর্গের মানুষও আছে এবং তাদেরও অধিকার আছে মানুষের মতো এই সমাজ-রাষ্ট্রে বাস করার যদিও দুঃখজনকভাবে প্রায়শই তা হয় না।

ল্যান্ডস্কেপ ফটোগ্রাফি বুদ্ধদেবের সিনেমার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তার অধিকাংশ ছবিতেই এই ল্যান্ডস্কেপ নিজেই যেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেবের বাবা ছিলেন ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ডাক্তার। বাবার চাকরি সূত্রে  শৈশব কেটেছে কখনো খড়গপুর, কখনো পুরুলিয়া কখনোবা বর্ধমানে। এসব অঞ্চলের নিভৃত নির্জন প্রকৃতি আর এর কোলে বেড়ে ওঠা নিম্নবর্গীয় ভূমিপুত্রদের  জীবনের আখ্যান বারবার মূর্ত হয়েছে তার ক্যানভাসে। হয়তো তাই এক সাক্ষাৎকারে আমরা তাকে বলতে শুনি-

যদি ইমেজ সংকটে ভোগো তাহলে শৈশব এবং স্মৃতির কাছে হাত বাড়াও, তারা তোমাকে ইমেজ দেবে।”

এই সব নিভৃত বিরান প্রান্তরে বুদ্ধদেবের ক্যামেরার Extreme Long Shot কিংবা ট্রলি শটের স্বাপ্নিক কাব্যময়তা ফ্রেমজুড়ে সৃষ্টি করে অপার্থিব নান্দনিকতার। ‘উত্তরা’, ‘চরাচর’, ‘লাল দরজা’, ‘তাহাদের কথা’, ‘টোপ’, ‘উড়োজাহাজ’, ‘স্বপ্নের দিন’ প্রতিটি সৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজেই এই নান্দনিকতার স্বাক্ষর। প্রতিটি চলচ্চিত্রই যেন রুপালি পর্দার অনবদ্য এক একটি কবিতা।

বুদ্ধদেব ভালোবাসেন তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অগ্রজ নির্মাতাদের ট্রিবিউট জানাতে। আজন্ম তারকোভস্কিতে আচ্ছন্ন এই নির্মাতার ফ্রেমগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে ‘আন্দ্রে রুবলেভ’-এর নির্মাতার কথা। ‘উত্তরা’ ছবিতে নির্জন প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাক নিঃসঙ্গ বৃক্ষের শট তারকোভস্কির দর্শকদের অতি চেনা। চার স্বপ্নচারী বৃদ্ধ যারা যেতে চান তাদের স্বপ্নলোক আমেরিকায়, এখানে আপনি পাবেন বুনুয়েলের ‘ভিরিদিয়ানা’র ছায়া। দুই মল্লযোদ্ধাকে খুঁজে পাবেন সত্যজিতের ‘সাতরাঞ্জ কা খিলারী’র মাঝে, আর আদিবাসীদের কোরাসের Extreme Long Shot-এর দুর্দান্ত চিত্রায়ণ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে বার্গম্যানের ‘দ্য সেভেন্থ সীল’ ছবির মৃত্যু নৃত্যের সেই বিখ্যাত শেষ দৃশ্যটিকে।

বুদ্ধদেবের ক্যামেরার ধ্যানমগ্ন চরিত্র, শান্ত সৌম্য রূপটির মাঝে প্রভাব লক্ষ করা যায় তার দুই প্রিয় নির্মাতা মিজোগুচি এবং থিও এনজেলো পুলাসের।

বস্তুত একজন কবিকে গভীরভাবে আরেক কবিই উপলব্ধি করতে পারেন কিংবা শিল্পীকে ধারণ করেন আরেক শিল্পী। আর বুদ্ধদেব তো দিনশেষে চলচ্চিত্রেরই এক বিশুদ্ধ কবি-সিনেমার ক্যানভাসেই তার কবিতা যাপন, কবিতার সংসার।

কর্মজীবনের শুরুতে বুদ্ধদেব অর্থনীতি শাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে শুরু করেছিলেন কলেজে অধ্যাপনা। এক সময় অধ্যাপনা ছেড়ে শুরু করলেন চলচ্চিত্র নির্মাণ। ১৯টি ফিকশনের পাশাপাশি তৈরি করেছেন প্রায় ১৪টি ডকুমেন্টারি এবং বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। নির্মাতা হিসেবে একাধিক বার পেয়েছেন জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

সারা জীবন স্বপ্নভুক এই শিল্পী দেহত্যাগ করেন ২০২১ সালের ১১ জুন। তৃতীয় প্রয়াণবার্ষিকীতে সশ্রদ্ধ প্রণতি রুপালি ক্যানভাসের কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রতি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫