
অসীম সাহা। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের কবিতায় নতুন চমকের গল্প গত শতকের ষাটের দশকের পর নতুন করে, এসেছে কি? প্রশ্নটা মনের মধ্যে রয়ে যায়। এর কারণ ষাটের পর কবিতায় নতুনত্বের দেখা মেলে না সেভাবে। ষাট দশক নানাভাবে তাৎপর্যময়, মহিমান্বিত অন্তত আজকের বাংলাদেশের জন্য।
সামরিক শাসন, শিক্ষা আন্দোলন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ছয় দফা, এগারো দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের আন্দোলন ষাটের কবিদের শানিত করেছে। এরা এদেশের মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষ করেছেন চেতনায়। আবার অনেকেই ছিলেন যোদ্ধা হিসেবে। এ কারণেই এ সময়ের রাজনীতি, শিক্ষা আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবই গুরুত্বপূর্ণ। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে চাপা ক্ষোভ জন্ম নিয়েছিল এদেশের মানুষের মনে, সেটি চূড়ান্ত রূপ নেয় ষাট দশকে এসে। এই সময়ে কবিতা, গান, নাটক-সাংস্কৃতিক মহড়া, এসব চলছিল রীতিমতো রাজনৈতিক তৎপরতার অভিসাররূপে।
তখন নতুন কবিতার আন্দোলন হচ্ছে কলকাতায়, আর বাংলাদেশে সাহিত্য কাগজগুলোর ফণা তোলার কাল তখন। সদ্যপ্রয়াত অসীম সাহা, এই দশকের একজন কবি। যে নামটি আমার নিজের চেনা বেশ ছোটবেলাতেই। সেই চিনবার একটি বিশেষ কারণ হলো, ‘মানুষের জন্য কবিতা’ শিরোনামে এক বাক্সে ৫টি বইয়ের এক দারুণ সংকলন। যেটির সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। আলাদাভাবে চমৎকার প্রচ্ছদ, মুগ্ধ হওয়ার মতো কাজ ছিল সেটি। বাবার সঙ্গে বটবুনিয়া লঞ্চ ঘাট থেকে খুলনায় যাওয়ার লঞ্চে উঠেই পুঁথি পাঠ শুনতে থাকি। এ অঞ্চলে এই একজন মানুষ ছিলেন, এভাবে পুঁথি বানাতেন আর তা পাঠ করতেন সাম্প্রতিক পছন্দসই বিষয় নিয়ে। নিজের নামটা খবরের কাগজ আর কলকাতা কিংবা বাংলাবাজারের বই-ম্যাগাজিনের নিচে চাপা পড়েছিল, কারণ তাকে পেপার বুড়ো বলতো লোকে। তিনি নিজে পথকবিতা লিখতেন, ‘মানুষের জন্য কবিতা’ নিয়েও তিনি পুঁথি পাঠ করেই কবিতার বই বিক্রি করছিলেন। এই বিষয়টি উচ্চ রুচির প্রকাশ মনে হয় আজকে এসে। সেদিন বাবা কিনে দিয়েছিলেন ওই সিরিজটা। আমি এই সিরিজের কারণেই কিশোর বয়সেই নাজিম হিকমত, ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির কবিতা পাঠের সুযোগ পেয়েছিলাম। ফলে অসীম সাহা মাথার মধ্যে ছিলেন। তারপর সুন্দরবনের জঙ্গলমহল, পাখি-মাছ, নদী-বৃক্ষের ভালোবাসা ছেড়ে যখন এলাম এ শহর ঢাকায়, বুকে স্বপ্ন বোনা শতেক হাজার পাখা মেলবার।
২.
২০০৩ সাল অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমির একটি অনুষ্ঠানে তাকে দেখেছিলাম প্রথম। অসীম সাহার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পূর্ব-পৃথিবীর অস্থির জ্যোৎস্নায়’। সেই ছিল শুরু- শেষ নয়, তারপরের গল্প বেশ মজার, অসীম সাহা যেন নিজের গল্পকার। গল্প করতেন দেখা হলেই, এবারের কারণ হলো উনার প্রতিবেশী হয়ে গিয়েছি ততদিনে আমি। ফ্রি স্কুল স্ট্রিট রোডের ১০৩নং বাসা, একই গেট বাগানবিলাস, রঙিন প্রজাপতির উড়াউড়ি, করমচা বৃক্ষের ডানা বাড়ছে, সবুজ আর সবুজ। এই দরোজায় দেখা হতো, কথা হতো। আমি ওখানটাতে থাকি না অনেক দিন, অসীম সাহাও বোধহয় ছেড়েছিলেন বাড়িটা, শেষদিকে দেখা হতো কনকর্ড এম্পোরিয়ামে। এরপর বাড়ি গেলাম-ঈদ এলো, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে খবর দেখলাম রাসেল ভাইপার ত্রাস সৃষ্টি করছে দেশজুড়ে, একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি অসীম সাহার দিব্যলোক যাত্রা। এভাবেই বুঝি মানুষ হারিয়ে যায়, যেতে হয়-‘স্মৃতির ভাঁড়ার শূন্য করে’।
লেখক : সাহিত্য সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল