Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

নদী ও জীবনানন্দ দাশ

Icon

সঞ্জয় সরকার

প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২৪, ১৮:২৮

নদী ও জীবনানন্দ দাশ

নদী ও জীবনানন্দ দাশ। ছবি: সংগৃহীত

বর্তমান পৃথিবীতে মানুষের বিধ্বংসী মনোভাবের কারণে প্রকৃতি দারুণভাবে বিপন্ন। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ইতিহাস মানেই সবুজ প্রকৃতির চিত্রায়ণ। জীবনের মধ্যে, বেঁচে থাকার মধ্যে, হতাশার মধ্যে, এমনকি মৃত্যুর মধ্যেও তিনি প্রকৃতিকেই আশ্রয় করেছেন। জীবনানন্দ যেন প্রকৃতির বরপুত্র।

মানবজীবনের ক্ষয়ে যাওয়া, মরে যাওয়া, বিবমিষায় বিষণ্ণ জীবনকে তিনি যেমন প্রকৃতির চিত্রকল্পে এঁকেছেন তেমনি প্রকৃতির হতশ্রী ও ক্রম ক্ষয়িষ্ণু রূপকেও কবিতায় ধারণ করেছেন। কখনো কখনো তার প্রকৃতি হয়ে উঠেছে শত ঝরনার জলধারার মতো শুশ্রুষাময় নদী। রূপসী বাংলায় যে নিখুঁত বৃক্ষ-লতা ও তৃণলতার বর্ণনার পাশাপাশি তিনি নদীকে মোহনীয় করে উপস্থাপন করেছেন। নদী বিধৌত বাংলার পরিবেশ কবিকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি হয়তো জানতেনও যে বাংলার নদীকে একদা বেঁচে থাকার জন্য উজানের রাষ্ট্র-রাজনীতির কবলে পড়তে হবে। তার কাছে নদীর ঢেউয়ের রঙ হয়ে উঠেছে গোলাপি। যে কারণে কবিতায় তিনি বলেন-‘নদীর গোলাপি ঢেউ কথা বলে’। এমন ইন্দ্রিয়াতীত বিষয়কে কবি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলেছেন রঙ ও রূপ বর্ণনার মধ্য দিয়ে। জীবনানন্দ দাশের হাত ধরেই বাংলার নদী কাব্যিক সৌকুমার্য লাভ করেছে। রূপসা, ধানসিড়ি, জলসিঁড়ি, শিপ্রা, ধলেশ্বরী, চিলাই, কালিদহ, কীর্তিনাশা যেন বাংলার প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে কবি জীবনানন্দ দাশের হাত ধরে।

বিশেষ নামে নয় বরং জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় কেবল নদী সর্বনামে অসংখ্যবার নদীর কথা বলেছেন। যদিও তার ধানসিড়ি কাব্য মাধুর্যের কারণে কবিতাপ্রেমীদের নিকট দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তবুও বাংলার যে কোনো নদীই কবির কাছে জীবন্ত প্রাণীর মতো। না-মানুষী এই সত্তাকে জীবনানন্দ দাশ ভারতীয় দর্শনের আলোকে চৈতন্যময় সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ভারতীয় দর্শনে সকল বস্তুর মধ্যে চৈতন্য সত্তার আরোপ করা হয়েছে। আর জীবনানন্দ দাশও তার কবিতায় কখনো নদীকে জীবন্ত সত্তা, অনুভূতিপ্রবণ মানবিক জীবনের প্রতীক, কখনো নদীর ওপর তিনি অনুভূতিসচেতন মানবিক সত্তা আরোপ করেছেন। তবুও নদীর মানে শুশ্রুষার জল;/সূর্য মানে আলো,/এখনো নারী মানে তুমি কত রাধিকা ফুরালো এই কবিতায় নদী যেন কবির প্রেমিক রূপে হাজির হয়েছেন। এমনকি সকল মানবিক সভ্যতার গড়ে ওঠার পেছনে নদীর যে ভূমিকা এবং মানব সমাজ ও সৃষ্টির পেছনে নারী সত্তার যে ভূমিকা তাকে কবি পাশাপাশি স্থান দিয়েছেন। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় সরস্বতী নদীর মাহাত্ম্যের কথা জানা যায়। সে শুধু ধর্মীয় কারণে বর্তমানে অনেকখানি আমাদের কাছে দূরবর্তী জীবনের গল্পকথা হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যে চর্যাপদ থেকে শুরু করে মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে ধরে কপোতাক্ষ নদ অনন্য মর্যাদা পেয়েছে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ নদীর কথা শুনতে পেয়েছেন, নদীর হৃদয় দেখতে পেয়েছেন, নদীর কান্না অনুভব করেছেন। রূপসার ঘোলা জল, দিগন্তের জলসিঁড়ি, ধানসিড়ি নদীর তীর, চোখে ঢের নদী এমন বাক্যাংশ নদীকে মানুষের নিকটে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

‘নদী’ শীর্ষক কবিতায় জীবনানন্দ দাশ প্রশ্ন রেখেছেন-নদী, তুমি কোন কথা কও? আবার কবিতার শেষে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে বলেছেন-নদী তুমি কোন কথা কও! কবির কাছে মনে হয়েছে নদী কবির শিশুর মতো মেয়ে যে সারাদিন আনমনে কথা বলে। পৃথিবীর প্রাণসত্তার বিকাশে এই নদী মহাকালের সাক্ষী এ কথা জীবনানন্দ দাশ নিশ্চিত ছিলেন। আর এই অনুভূতির গভীরে ডুব দিয়ে তিনি পদ্মা, যমুনা, মেঘনা বা গঙ্গার মতো আলোচিত নদীর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে গ্রামজীবনের প্রান্তস্পর্শ করা ধানসিড়ি নদীর ধারে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫