Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

‘চালচিত্র এখন’-এ শতবর্ষী মৃণালের স্মৃতি

Icon

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৪, ২০:০৪

‘চালচিত্র এখন’-এ শতবর্ষী মৃণালের স্মৃতি

মৃণাল সেন। ছবি: সংগৃহীত

‘একটু ভালো করে বাঁচবো বলে আর একটু বেশি রোজগার
ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা আমার নীলচে পাহাড়...’

ভালো করে বাঁচবার জন্য মানুষ কত কী না করে, ভালো করে বোঝাবুঝিটা যে মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের ঠিকঠাক মতো হয় না- সে যে সত্যিকার অর্থে একটা দোদুল্যমান অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে থাকে, সে আমরা সকলেই বুঝি এবং জানি। ১৯৮১ সালে যে ‘চালচিত্র’ শুরু হয়েছিল বছর ২৬-এর উঠতি যুবকের জীবনে। সেই সময়ের কলকাতা, তখন ক্ষমতায় থাকা বামপন্থি কমিউনিস্ট সরকার-উচ্ছৃঙ্খল, পুরোদস্তুর অরাজনৈতিক, তার্কিক এক যুবকের সঙ্গে ৫৫ বছর বয়সী নামডাকঅলা পরিচালকের বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে। চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেনের কথা বলছি, সঙ্গে তখনকার তরুণ অঞ্জন দত্ত। অঞ্জন দত্তের সিনেমাযাত্রা শুরু হয়েছিল মৃণাল সেনের মাধ্যমে। তাদের অসম বয়স, তবুও যেন বন্ধুত্বের জন্য দুটি মন প্রস্তুত ছিল। 

এবার আসা যাক অঞ্জন কী কী করেন-প্রথমত, তিনি গায়ক, গীতিকার, সুরকার এবং সিনেমা পরিচালক। এর বাইরেও রয়েছে তার বহুবিধ পরিচয়। তার আড্ডার মতো করে ইন্টারভিউ নেওয়ার রীতি আমার বোধহয় সবচেয়ে অন্যরকম লাগে, ভক্তি এসে যায়। এত কথা যাকে নিয়ে বলছি সেই অঞ্জন সম্পর্কে শুরুতে কেবল গান নিয়েই আগ্রহ ছিল আমার, ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ চলচ্চিত্রটি দেখার আগ অব্দি অঞ্জনকে চলচ্চিত্রকার মানার কোনো আগ্রহ আমার ছিল না। যদিও অনেকের মতে অঞ্জনকে কেউ ওই অর্থে সিনেমার পরিচালক বলবেন না, যারা সিনেমার সিরিয়াস ধারার সঙ্গে নিজেদের মেলান। আমি অবশ্য কোনো ধারার না, তবে সিরিয়াসকে পছন্দ করি-পরীক্ষা-নিরীক্ষা ধাতে সয়, নিতে পারি, গ্রহণে সমস্যা হয় না। চলচ্চিত্রের নতুন বার্তার প্রতি আমার আগ্রহ রয়েছে, ফলে নতুন কিছু ঘটলে একটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করি। 

বরেণ্য পরিচালক মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষে অঞ্জন দত্ত সম্ভবত নিজের সবচেয়ে সেরা কাজটি করেছেন। মৃণাল সেনকে নিজের গুরুর আসনে বসিয়েছেন অঞ্জন। অনেকেই ভাববেন যে এটা সম্ভবত মৃণালের বায়োগ্রাফিক চলচ্চিত্র, একেবারেই তা নয়। চলচ্চিত্রটি কেবল মৃণাল সেন, অঞ্জন দত্ত এবং সেকালের কলকাতা আর মতাদর্শিক ভাব-ভাবনার যাতায়াত। ছবিতে মৃণাল সেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অঞ্জন নিজেই। এ ছাড়াও যুবক অঞ্জনের ভূমিকায় রয়েছেন শাওন চক্রবর্তী। আছেন বিদীপ্তা চক্রবর্তীও। তাকে দেখা যাবে পরিচালকের স্ত্রী গীতা সেনের চরিত্রে। চলচ্চিত্রের গল্পে মৃণালের চলচ্চিত্র বানানোর কৌশল দেখিয়েছেন কি অঞ্জন? অকপট বাবার জীবনী তুলে ধরবার মতো, ভক্তিও যেমন তেমন রাগী-গোঁয়ার সন্তানের মতো বিরোধও, সে যেন স্ববিরোধী একটি সত্তা। দেখতে পাই এমন প্রতিচ্ছবি। এর মাঝে নাটকের বন্ধুদের সঙ্গে কথোপকথন, আড্ডা, মদ্যপান, স্ত্রীর সঙ্গে কথোপকথন সবই একটা অস্থিরতার মধ্যে ঘটতে থাকে এবং স্থিরতার জন্য হন্যে যুবকের জার্মানি যাওয়ারও তাড়না। কমিউনিস্টদের একটা ঘৃণার চোখে দেখা সেও একটি ভিন্ন ভাবনা। আবার উজ্জল দত্ত নামের যে চরিত্রটি দেখি নাট্যকার রূপে সে তো উৎপল দত্তের ভূমিকা। তারও আড্ডাকে গৌণ করে তোলেননি অঞ্জন, দেখিয়েছেন যেমন মৃণালকে, মৃণালের ভাবনার জগৎকে স্মৃতির ভাঁড়ার হাতড়ে টুকরো টুকরো দৃশ্যে যা জোড়া দিলে পেয়ে যাই মৃণাল সেন। আবার একইভাবে রাগী, উচ্ছৃঙ্খল জীবনের অধিকারী অনেক কিছু না বোঝা-যে যুবক সব কিছুর খোঁজ রাখে-লেনিন থেকে জোসেফ স্তালিন সবকিছু, সেই যুবকের নির্জন লড়াই নিজের সঙ্গে সেটি নতুনভাবে আবিষ্কারের মতোই যেন তুলে ধরেছেন অঞ্জন দত্ত। আশ্চর্য লাগে এমনিই যে তিনি রাখঢাক করেননি, গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, তর্ক-বিতর্ক, ভালোলাগা কোনোটিই লুকোননি। একটি দৃশ্যে বলছেন, ‘কে বলেছে তাকে কমিউনিস্ট হতে?’ তার মানে মানুষ হলেই চলে, যে প্রকৃতার্থে মানুষ, দুঃখ-ব্যথা বোঝে, মানবিকতা যাকে টানে, মানুষের কান্না যাকে ভাবায় সেই মানুষের কথাই তবে বলতে চেয়েছিলেন কি মৃণাল? কয়েকটি দৃশ্যে দেখা যায় বইয়ের তাকের কাছে দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে, তারপর বই পাঠের নেশা যে যুবকের রয়েছে তা মৃণাল জানেন। ফলে যখন তাক থেকে যুবক লাল প্রচ্ছদের ‘পাসোলিনি’র বইটি নেয়, তখন মৃণাল সেটি তাকে লিখে উপহার দেয়। আচ্ছা, একটি বিষয় দুইবারে বা তিনবারে এসে থাকবে-তা হলো সিগারেট খাওয়ার কথা; কিন্তু মৃণাল পরিচয় করিয়ে দেয়-সে গাঁজা খায় বলে। এই যে বিষয়টি আমাকে ভাবায়, এটা কি তাচ্ছিল্য, নাকি স্বাধীনতাকে প্রায়োরিটি দেওয়া, এটা বুঝতে পারি না। পুরো সিনেমার শেষে এসে দেখি-কান্নাভেজা দৃশ্য। গুরু-শিষ্যের আলাপন। যেখানে কুনাল ঘোষ চরিত্র (মৃণাল সেন)-কে যুবক (অঞ্জন দত্ত) বলছেন, সে জার্মানিতে যেতে চায় না, সে কি আর আসতে পারবে অভিনয়ে... 

এই রকম অদ্ভুত আর চমৎকৃত হওয়ার মতো ভালো কিছু স্মৃতি এবং যাপনের মধ্য দিয়ে পরিচালক অঞ্জন দত্ত তুলে এনেছেন তার নিজের সঙ্গে কিংবদন্তি পরিচালক মৃণাল সেনের সম্পর্ক এবং মৃণাল ভাবনা। যেটুকু দেখা গিয়েছে ভাবনার আড়ালে তা কিছুটা আচ্ছন্ন হতে পেরেছি নিজের ভেতর। গল্প টেনে নিয়েছে ভাবনার জগতে, কলকাতা শহর, অসামান্য সব শট, স্থিরচিত্র, গান এবং অলিগলি, মাঝে মাঝে চমকেও দিয়েছে গল্প এবং সেরা অভিনয়টা পেয়েছি অঞ্জনের। সেই জন্য সম্ভবত আমার দৃষ্টিতে এটি অঞ্জন দত্তকে অনেকটা পথ এগিয়ে রাখল সমালোচকের ক্ষুর-কাঁচির থেকে বেশ দূরে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫