Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

কী আছে জীবনানন্দের বাড়িতে

Icon

আমীন আল রশীদ

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪, ১৮:৫০

কী আছে জীবনানন্দের বাড়িতে

জীবনানন্দ দাশের বাড়ি। ছবি- সংগৃহীত

দক্ষিণের শহর বরিশালের ব্র্যান্ডিং হয় যেসব ব্যক্তির নামে, ‘প্রকৃতি ও রূপসী বাংলার কবি’ খ্যাত জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) তাদের অন্যতম। কিন্তু তিনি বেড়ে উঠেছেন এবং জীবনের একটা দীর্ঘ সময় যে বাড়িতে থেকেছেন, সেটি এখন কেমন আছে?

বরিশাল শহরে ওই বাড়ির সামনের রাস্তাটির নাম ছিল বগুড়া রোড। তাকে ভালোবেসে বছর কয়েক আগে নগর কর্তৃপক্ষ এর নামকরণ করেছে জীবনানন্দ দাশ সড়ক। কিন্তু ১৯০৭ সালে দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা সেই সর্বানন্দ ভবনে এখন একরাশ হতাশা ছাড়া কিছুই নেই।

প্রসঙ্গত ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কিছু আগে-পরে জীবনানন্দের পরিবারের সদস্যরা বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। এরপর থেকে এ বাড়িতে থাকতেন বরিশাল কালেক্টরেটের কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাক। তার মেয়ে নূরজাহান বেগমের দাবি, ১৯৬০ সালের ১৭ জুন বাড়ির বেশ কিছু অংশ নিলামে কিনে নেন তার বাবা। তারপর জীবনানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাড়িটার নাম পাল্টে দেওয়া হয় ‘ধানসিড়ি’। ১৯৬২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন অধ্যাপক আলী আনোয়ার বরিশালে বেড়াতে এলে তার প্রস্তাবে এই নামকরণ হয়। এখনো বাড়ির প্রবেশমুখে ‘ধানসিড়ি’ লেখা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।

২০০৬ সালে নূরজাহান বেগমের স্বামী আবদুস সোবহানের সঙ্গে যখন কথা হয়, তিনি জানিয়েছিলেন, সর্বানন্দ ভবন ছিল ৯৭ শতাংশ জমির ওপর। পরে সরকার ৪০ শতাংশ অধিগ্রহণ করে নেয় এবং ১৬ শতাংশ জমি জীবনানন্দের পরিবারের কেউ বিক্রি করে দেন বরিশালে থাকাকালে। বাকি ৪১ শতাংশ জমির ওপর এই বাড়িটি অবস্থিত। তিনি জানান, তার শ্বশুর আব্দুর রাজ্জাক যখন বাড়িটি কিনে নেন, তখন শূন্য ভিটার ওপর একটা ভাঙা ঘর এবং দুটি কংক্রিটের পিলার ছাড়া কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। তবে সর্বানন্দ ভবনে পিলার ছিল মোট চারটি। বাকি দুটি কোথায় গেল, সে প্রশ্ন ছিল তারও। যদিও এখন একটি পিলারও অবশিষ্ট নেই। বস্তুত এ বাড়িতে জীবনানন্দের আমলের কিছুই নেই। বহুতল ভবন উঠে গেছে। শুধু একটি একতলা বাড়ি এখনো টিকে আছে। সেটিই জীবনানন্দের আমলের বাড়ি বলে দাবি করা হয়।  

স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবির মুখে ২০০৯ সালে বাড়ির সামনের অংশে জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি মিলনায়তন ও পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে। দোতলা এই ভবনের নিচতলায় লাইব্রেরি এবং দোতলায় মিলনায়তন। মাঝেমধ্যে এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। লাইব্রেরিটি প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা রাখার কথা থাকলেও অধিকাংশ সময়ই বন্ধ থাকে। কারণ এখানে পূর্ণকালীন কোনো কর্মী নেই। লাইব্রেরিতে রয়েছে সাতটি বুকশেলফ, দুটি টেবিল আর গোটা বিশেক চেয়ার। ভবনের প্রবেশমুখে জীবনানন্দের একটি ম্যুরাল এবং তার সম্পর্কে কিছু তথ্য টাইলসে বাঁধাই করা। কিন্তু দেশের নানা প্রান্ত থেকে জীবনানন্দানুরাগীরা এখানে গিয়ে মূলত হতাশ হন। 

জীবনানন্দের ছোট বোন সুচরিতা দাশ এই বাড়ির যে বর্ণনা দিয়েছেন তা এ রকম-প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে মখমলের মতো সবুজ ঘাস। তার ওপর কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম পাপড়ির সুচারু আলপনা আঁকা। সূর্যের জাফরানি আলোর রঙে লতাপাতা পাখ-পাখালির সর্বাঙ্গ মুড়ে থাকে। জানালার সামনে দুটো গন্ধরাজ গাছ আগাগোড়া সাদা ফুলে ছেয়ে গেছে, পাতা দেখা যায় না। পাতার আড়াল থেকে উঁকি দেয় নীলজবা। মাধবীগুচ্ছে রক্তরাগ। কাঁঠালিচাঁপার তীব্র গন্ধে বাতাস ভারাক্রান্ত। কিন্তু এখন এই বাড়ির ভেতরে ঢুকলে জীবনানন্দের কোনো ঘ্রাণ মিলবে না। 

মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন ‘উপমা’র আল মাহমুদ সংখ্যায় (প্রকাশ ২৬ মার্চ ১৯৯৪) আল মাহমুদকে লেখা মঞ্জুশ্রীর তিনটি চিঠি প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯০ সালের ২৯ আগস্টের চিঠিতে মঞ্জুশ্রী লিখেছেন, ‘বরিশালের বাড়ি বিক্রি করা হয়নি। এ বাড়িটি বগুড়া রোডে। অন্যেরা থাকে। বাবার জন্যে এ বাড়িতে কোনো কালচারাল প্রতিষ্ঠান বা আকাদেমি হলে ভাল হতো।’ প্রশ্ন হলো, বাড়িটা কি ষাটের দশকে জীবনানন্দের পরিবারের কাছ থেকে আব্দুর রাজ্জাকের কেনার তথ্যটি মঞ্জুশ্রীর জানা ছিল না, নাকি আদৌ বাড়িটি বিক্রি হয়নি?

বাড়ি বিক্রির জন্য যে দলিলের কথা বলা হয়, তার কার্যকারিতা কতটুকু, তা নিয়ে বরিশালের সংস্কৃতিকর্মীদের মনেই নানা প্রশ্ন। যে কারণে তারা জীবনানন্দের পৈতৃক ভিটা উদ্ধার করে সেখানে একটি আধুনিক মিউজিয়াম গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে। এই দাবিতে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধনও হয়েছে। এমনকি ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর বরিশাল শহরের বান্দ রোডে নির্মাণাধীন জেলা শিল্পকলা একাডেমি পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদও বলেছিলেন, কেউ যদি জীবনানন্দ দাশের পৈতৃক ভিটার মালিকানা নিয়ে থাকেন, তাহলে অধিগ্রহণ করে সেই জমি পুনরুদ্ধার করা হবে। কিন্তু বিষয়টি এরপর আর এগোয়নি।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫