
স্টালিন বলেছেন, ‘একজন মানুষের মৃত্যু হলো ট্র্যাজেডি। দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু কেবলমাত্র পরিসংখ্যান।’
রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল তা এখনো সর্বজনীন উত্তরাধিকার ঠিক করতে পারেনি। আমাদের ইতিহাসের মহা নায়ক কারা? কাদের আমরা আদর্শ হিসেবে নিচ্ছি-এই বিষয়গুলো বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ নির্ধারণ করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে আজও। এর জন্য হয়তো আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোয় কে বা কারা আসবে সূক্ষ্মভাবে নির্বাচন করতে পারিনি। ফরাসি বিপ্লবে যে মধ্যবিত্ত সমাজ পুরো ইউরোপের সামাজিক, রাজনৈতিক, ক্ষমতার কাঠামো বদলে দিয়েছিল, তা সত্যিই এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
তৃতীয় বিশ্বের মধ্যবিত্ত সমাজ যত দিন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ না হবে, ততদিন জনগণ আশানুরূপ ফলাফল শাসক শ্রেণির কাছ থেকে আদায় করতে ব্যর্থ হবে। এর ফলশ্রুতিতে পুনঃপুন বিদ্রোহ ঘটতে থাকবে। শোষিত শ্রেণির কিছু কিছু বিদ্রোহ সফলতার মুখ দেখলেও তা হবে ক্ষণস্থায়ী। আর সেই সব বিদ্রোহ দমনের জন্য সুযোগসন্ধানী দেশি-বিদেশি গ্রুপ শাসক গোষ্ঠীর কাছ থেকে মোটাদাগে ফায়দা হাসিল করে নেয়। কপাল কুঁচকিয়ে বলতে হয় আমাদের দেশে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হয়েছে তাদের চিন্তা-চেতনা অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জোনাকিপোকার মতো। ‘জাতীয়তাবাদী বা জাতিসত্তাভিত্তিক কিংবা মৌলবাদী মতাদর্শগুলোর কাঁচামাল হলো ইতিহাস, ঠিক যেমন হেরোইনের নেশার কাঁচামাল পোস্তদানা। অতীত এই মতাদর্শগুলোর অত্যাবশ্যক উপাদান। এই মতাদর্শগুলোর পক্ষে উপযোগী অতীতের যদি কোনো অস্তিত্ব না-ও থাকে, তবে তাকে যে কোনো সময়েই উদ্ভাবন করে নেওয়া যায়’-এরিক হবসবউম।
স্বাধীনতার পাঁচ দশকেও রাষ্ট্র সর্বজন স্বীকৃত পাঁচজন পেশাদার ইতিহাসবিদ তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। যার ফলে যে কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে বিভক্ত হয়ে অতীত ইতিহাস নিয়ে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ন্যায্য দাবিগুলো আড়ালেই পড়ে থাকে, কারণ ইতিহাস নিয়ে লুটপাট এখনো শেষ হয়নি! গণতন্ত্রের নামে যে শাসন ব্যবস্থা চালু রয়েছে তা হলো স্বৈরশাসন, কৌলিক বা বংশানুক্রমিক, এর ফলে তারা পূর্বের রীতিনীতি ভঙ্গ না করে শাসন ব্যবস্থা চালু রাখে। আর জনগণ ভোটের নামে অধিকার আদায়ের যে স্বপ্ন দেখে তা শুধুই প্রহসন। কোথায় আমার রাষ্ট্র! কোথায় আমার নগর! কোথায় আমার নাগরিক অধিকার! এই প্রশ্নগুলো ঘড়ির কাঁটায় ঘুরতে থাকে।
ইতিহাস বিকৃত করে যে অপরাজনীতি এই উপমহাদেশে প্রচলন হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। সেই ইতিহাস আফিমের মতো গিলছে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
তুমি যে অন্ধকারে ঘুমাও বন্ধু! আমিও ঘুমাই সেই অন্ধকারে। উপমহাদেশে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে রাজনীতির উত্থান ঘটছে আবার সেই স্বদেশি রাজনীতির হাতেই পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি সাধারণ জনগণ। রাজনীতি, উন্নয়ন, দুর্বৃত্তায়ন একই শ্লোকে গাইছে গুনগুন করে। আমি তো ফুলের আঘাতে মরতে চেয়েছি-গুলির আঘাতে নয়।
‘ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের লড়াই হলো আদতে ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধে স্মৃতির লড়াই’-মিলান কুন্ডেরা। এই যে আমরা বারবার লড়াই সংগ্রাম করছি ক্ষমতার কাঠামো পরিবর্তন না করে, বেহাত বিপ্লব ঘটে ক্ষমতা কাঠামোর কাছে। এখন সময় হয়েছে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তুলবার, জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করার।
তা না হলে পুনঃপুন সংগ্রাম ঘটতেই থাকবে, সাধারণ মানুষের প্রাণহানি, দুর্নীতি, সম্পদ পাচার, হিংসা ও সহিংসতায় হারিয়ে যাবে মানবিক মূল্যবোধ। সবুজের বদলে বিষণœ শহর, নৈঃশব্দ্যের বদলে নৈরাজ্য, মনুষ্যত্বের বদলে পশুত্ব, এই তো আমাদের পুঁজি। বিশেষ প্রার্থনায়-আর যেন জনসাধারণের রক্ত না ঝরে মাতৃভূমিতে, রক্ত নয় শিশির গড়িয়ে পড়ুক পথে প্রান্তরে।