সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন
অন্ধকারের উৎস হতে আলোর রেখা

নাহিদা আশরাফী
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১৭:৪৪

সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন বইয়ের প্রচ্ছদ। ছবি: জন মোহাম্মদ
‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’ আর ‘রক্ত পুজো গেঁথে যাওয়া মাছি’ পড়ে আমি এক আকিমুন রহমানকে আবিষ্কার করেছিলাম। যার চোখে জ্বলজ্বল করছিল পুরুষতন্ত্রের ধ্বজাধারী এই সমাজের প্রতি বিদ্রুপ। ক্রূর বর্বরতা, নেতিবাচক আস্ফালন ও নারীর প্রতি অযাচিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় প্রতিবাদী একজন। এখন প্রশ্ন হলো আমি কি এসব আকিমুন রহমানের চোখে দেখেছি নাকি সেই চোখ প্রতিনিধিত্ব করছে আমাদের সবার চোখকে। আমাদের ভেতরে যে সত্যটা ক্ষুধার্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়েছিল তাকে কলমের তাপে উত্তপ্ত করে সামনে আনাটাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।
একজন লেখককে চিনতে হলে তার ব্যক্তিজীবন, পারিপার্শ্বিক প্রভাব, মতাদর্শ এবং এমনকি তার জীবনাচরণকে নিবিড়ভাবে লক্ষ করা প্রয়োজন। এই অল্প পরিসরে কোনোভাবেই একজন আকিমুন রহমানের একটা উপন্যাস নিয়ে পরিপূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। সারসংক্ষেপে যে উপন্যাসটি নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই তার নাম, ‘সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন’।
১৩৩০ বঙ্গাব্দের এক ‘চৈতমাইস্যা দুপুরে’ এক ‘অশৈলী বৃত্তান্ত’ ঘটে যায় ‘নিরিবিলি নীরাছাড়া’ এক গ্রামে। ‘লয়লক্ষ্মী আরে ঢক চেহারার’ মেয়ে জুলেখা হঠাৎই গায়েব হয়ে যায়। উপন্যাসের শুরু এখান থেকে হলেও ঔপন্যাসিক চলে যান কয়েক যুগ আগের গল্পে। একটা মিষ্টি প্রেমের কাহিনি আমাদের লোকজ উপাদান এবং আঞ্চলিক শব্দ সম্ভারে পরিপুষ্ট হয়ে যখন পাঠকের দরবারে হাজির হয় তখন পাঠক তাকে গ্রহণ করে একান্ত নিজের বলে। যুগ যুগ ধরে বহন করা আমাদের শ্লোক ও সংস্কার, আমাদের সাহস ও সংশয়, আমাদের বিশ্বাস ও বিবিধ বিধানক ঔপন্যাসিক তার লেখার মুন্সিয়ানায় যেভাবে তুলে ধরেছেন তাতে আমি নাদান পাঠকও তাকে সংস্কার ভেবে দূরে ঠেলতে পারি না বরং নিজেই নিজেকে বোঝাই ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।’ আর এখানেই লেখকের ক্যারিশমাটিক ইমেজ খুঁজে পাই।
উপন্যাসটির যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো অসংখ্য আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার। এমনকি লেখক তার নিজস্ব বয়ানেও এই আঞ্চলিক শব্দের উজ্জ্বল উপস্থিতি বহাল রেখেছেন। বানবাতাস, পুন্নিমান, পুষ্কুনি, অশৈলী বৃত্তান্ত, হুমহুমা, মুইড়া পিছা, পরস্তাব, মাতারি, তেনে, হাতরথ, ধুছমুছ, সাব্যস্ত, চেত, তরিজুত, সিজিলমিছিল, তুক্ষার, ভরাপুরা, নিরাছাড়া, শান্তিহালে, হাড্ডি, ফাতরামি, ভালা-বুরা, পুরুষপোলা, দূরকাইল্লা দিনে, ডর, আনাজপাতি, চান্দি, তাপোড়া তাপোড়া, বরাবর, রান্ধনঘর, যেসুম, অগ্রাহ্যি, আওভাও-এরকম কতশত শব্দ যে লেখক ব্যবহার করেছেন পুরো উপন্যাসে। তবে তার এই আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কোনোক্রমেই উপন্যাসকে ক্লামজি করে না বরং পাঠককে কোনো এক সুদূর গ্রামের মৃত্তিকার সঙ্গে মিশে যেতে সাহায্য করে। তার অভিনবত্ব মূলত এখানেই।
পাঠকের সঙ্গে কানেক্টিভিটি ও কংক্রিট বেইজমেন্ট তৈরি করার মতো যথেষ্ট মালমসলা এই উপন্যাসে বিদ্যমান এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
সাক্ষী কেবল চৈত্রমাসের দিন : আকিমুন রহমান
প্রচ্ছদ : জন মোহাম্মদ
প্রকাশক : খড়িমাটি
মূল্য : ২৯০ টাকা