Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

রবি কি অস্ত যাবে

Icon

এহসান হায়দার

প্রকাশ: ২০ আগস্ট ২০২৪, ১৫:২৯

রবি কি অস্ত যাবে

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পোর্ট্রেট: মামুন হোসাইন

রবীন্দ্রনাথ আমাদের, রবীন্দ্রনাথ বাঙালির, রবীন্দ্রনাথ মানুষের। যারা রবিসুধায় একবার অবগাহন করেছেন তারা আজীবন রবিপ্রেমে মশগুল হয়ে থাকবেন এটা স্বাভাবিক ঘটনা। বাঙালির জাতীয় জীবনে রবীন্দ্রনাথের সেই অবগাহন দৈনন্দিনের, অনায়াসে নিরন্তর যাপন তার। আর অন্তরে তার প্রবেশ ছিল নিঃশব্দ, কিন্তু আড়ম্বরপূর্ণ ছিল না সেই প্রবেশ, এ ছিল যেন এক নীরবযাপন। হ্যাঁ, হয়তো সেই সকল কারণেই আমাদের হৃদয়ের জমিনে তার অত বড় আসন পাতা। হয়তো সে কারণেই সাধারণ থেকে শুরু ক’রে সবখানে রবীন্দ্রনাথের যাপন। আমরা নিজের অজান্তেই তার গান, কবিতা গল্প, শিশুতোষ রচনা, ভ্রমণডায়েরি আর চিঠিপত্র পাঠ করি। মোদ্দাকথা, রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। 

শ্রাবণ কিংবা বৈশাখ মাস দুটি বাঙালির কাছে বিশেষ। এই দুই মাসের দুটি দিন এতটা প্রভাববিস্তারী, হাওয়ায় হাওয়ায় তার স্বর-সুর-গন্ধ ভেসে আসে।

দুই

রবি তার রচনায় যে বিচিত্র অনুভূতিকে ভাষা দিয়েছেন, যে চেতনার রঙে রাঙিয়েছেন-তা সত্যিকার অর্থে অবিস্মরণীয়। রবীন্দ্রনাথ যখন তার সাহিত্যে বেড়ে উঠেছেন তখন ব্রিটিশরা পূর্ণাঙ্গভাবে রাজত্ব করছে ভারতীয় উপমহাদেশে। তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম নিয়েছেন, তবে তার সাহিত্যচর্চার অধিক পরিণত হওয়া দেখতে পাই পূর্ববঙ্গে বসবাসকালে। এদেশে সেকালে তার ভক্ত গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, পরে তাদের অনেকেই আবার রবীন্দ্র-সমালোচকও হয়েছিলেন তীব্রভাবে। যারা সকলেই স্বনামে পরবর্তীকালে বাংলাসাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত নাম। 

আমার রচনার বিষয় ভিন্ন, ছেলেবেলা থেকে শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথ স্মরণীয় হতে হতে অভ্যস্ত আমি দেখি এবারে তিনি যেন উবে গেলেন এদেশে, চর্চা দূরে থাক, রবি এখন ভয়ের নাম, আতঙ্ক! কেন এমন হলো? এই প্রশ্ন গুণীজনেরা কী করবেন নিজেদের? হিপহপ আর পপ কালচারে মজে যাওয়া নতুন প্রজন্মের অভিভাবক দল ভাববেন সন্তান কেন এমন হলো? নিজের সংস্কৃতি না ভুলে চর্চায় রাখা, নতুনকে গ্রহণ করা মানে নিজের 

সংস্কৃতিচর্চাকে সরিয়ে দেওয়া? প্রশ্নটি রয়ে গেল মনে! একে অবক্ষয় না বলে-বলতে হবে কী?  অন্যায়কে অন্যায় বলার যে স্বাধীনতা তা আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম অনেক আগেই, তাই বলে পরিবার থেকে কি কোনো শিক্ষা আমরা পাইনি? সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় পরিবার হলো শিশুর প্রথম শিক্ষায়তন। 

সেদিক থেকে বিচার্য যে পরিবার তার দায়িত্ব পালন করছে না, বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। আধুনিক সমাজে একান্নবর্তী পরিবার হলো অনুন্নত সমাজের উদাহরণ। স্বামী-স্ত্রী, সন্তান এই নিয়ে ছোট ছোট সংসার তৈরি হয়েছে এখন, ফ্ল্যাটসংস্কৃতির মধ্যে থেকে থেকে প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য এবং আচার বিস্মৃত-বিলুপ্তপ্রায়। একান্নবর্তী পরিবার, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি, ফুফু-ফুফা, ভাই-বোন, একদল পড়শি, গ্রামের মুরব্বি, মেঠোপথ, খোলা আকাশ, শ্রাবণ মাস, সঞ্চয়িতা কিংবা সঞ্চিতা, রবীন্দ্রনাথ কিংবা নজরুল ইসলাম মিলেমিশে থাকাটা আধুনিক সমাজের অন্তরায়। ফলে হিপহপ সমাজে রবিবাবু দূরে থাকুন, রবীন্দ্রনাথের মতো অত বড় দার্শনিক আমাদের সমাজের আর কাম্য নয়। তারুণ্যদীপ্ত এই শ্রাবণের প্রজন্ম যখন জেন-জি, তখন রবি বাবু যায় কই?   

তিন

তাহলে রবি কি অস্ত যাবে? রবিপ্রেম এবং রবি বিরোধিতা সব সময়ই ছিল। তখনো যেমন রবীন্দ্রনাথ চর্চিত হয়েছেন, একালেও তাই হবেন। কারও প্রভাব থেকে দূরে রাখা যায় না সময়কে; সত্য ভাষণ হলো-শ্রাবণ নয় কেবল, সব সময়েই রবি আমাদের হয়ে আছেন, কেননা রবি ব্যতীত বাঙালির জীবন একেবারে অপূর্ণ। সমকালের বিচারে সমকালীন লেখকেরা অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকেন বটে; কিন্তু চিরদিনের বিচারে আমরা আজও বুকের মাঝে রবি ঠাকুর-নজরুল ইসলামের ছায়া আবিষ্কার করতে পারি। কেননা এরা আমাদের লোক, আপনার জন, এরা শোষণের বিরুদ্ধে হাতিয়ার, সৃষ্টিতে অনন্য, এরা সুন্দরের পূজারি আর আমরা সুন্দরের যে ধারণা পোষণ করি-যে সুন্দর গানের সুরের মূর্ছনায় মোহিত হই, যে কবিতার পঙ্ক্তিতে ভেসে জারিত হই, যে চিত্রের ভাষায় আমরা ভাবনার জগতে নিমজ্জিত হই, আর নির্মাণ করি নানা স্বপ্ন, চিত্রকল্প তৈরি করি সেখানে এদেরই ছবি আঁকা। 

প্রথম দর্শনের পর রবীন্দ্রনাথের চেহারার বর্ণনায় শেষে রমাঁ রলাঁ লিখেছেন, ‘...প্রচুর ও প্রশান্ত আনন্দ গোটা মুখ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। চেহারা অনেকটা সেই প্রাচ্য ঋষির মতো।’

রবীন্দ্রনাথ ঋষি বটে, নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা, শ্রাবণের এই এমনও ক্ষণে রবিকে কি আর ভোলা যায়, বুকের মাঝে যার জন্য আজ আলোর ছায়া করে খেলা প্রতিক্ষণ, কী করে শুধিবো রবি-তোমার এই প্রেরণার ঋণ?

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫