
কবি শহীদ কাদরী। ছবি: সংগৃহীত
‘জানি না/ক্লান্তির আর্তি ছাড়া/অন্য কোন ধ্বনি ছিল কি না/সন্ধ্যার নদীর স্বরে/কে যেন মন্ত্রের মতো/উচ্চারণ করে/কবেকার ভুলে যাওয়া নাম। (গোধূলির গান-শহীদ কাদরী)।’ শহীদ কাদরী কবিতা লিখেছেন কম, কিন্তু কবি হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন অসামান্য। ১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে আধুনিক কবিতার যে নতুন যাত্রা শুরু হয়, সেখানে ছিল তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
জীবনযাপন ও কবিতাকে তিনি একাকার করে দিয়েছিলেন। মানুষ হিসেবে এবং কবিতায় তিনি ছিলেন একই সঙ্গে অকপট ও তির্যক, বুদ্ধিদীপ্ত ও খামখেয়ালি, চৌকস ও নিয়মভাঙা। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার কবিতা ছাপা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায়।
বাংলা কবিতার নতুন রাজধানী ঢাকায় এ ছিল এক পরম স্বীকৃতি। বুদ্ধদেব বসুর হাতে তখন আধুনিক বাংলা কবিতার শাসনদণ্ড। ১৯৭৮ সালে চিরকালের মতো প্রবাসজীবন বরণ করে নেওয়ার আগ পর্যন্ত শহীদ কাদরীর কবিতার বই বেরিয়েছিল মাত্র তিনটি-উত্তরাধিকার (১৯৬৭), আমাদের সাহিত্যে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম অগ্রদূত কবি শহীদ কাদরী। কবিতার মাধ্যমে কবিতাপ্রেমী মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন আজীবন। ‘গোধূলির গান’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা পাঠ জরুরি। গোধূলি বেলাতে মানুষের মাঝে ক্লান্তি এসে ভর করে। জীবনের মধ্যাহ্নে শরীর থাকে ঊর্ধ্ব, প্রতিবাদ থাকে সমস্বরে, কণ্ঠস্বরে থাকে বজ্রতা, মুষ্টি থাকে বজ্র-সমান। গোধূলির সময় হলে হন্তারকরাও সম্মুখ দিয়ে কিলবিল করলেও নতজানু করে থাকতে হয়। কবি তাই লিখতে দ্বিধা করেন না, ‘একটি অচেনা পাখি দ্যুলোক-ভূলোক জুড়ে বারবার রটিয়ে দেয় আমার নতজানু পরিণতি, আমার অন্ধকার পরিণাম।’ গোধূলি সময় যেন হতাশার, নিরাশার, বিষণ্ণতার; কিন্তু কবি নৈরাশ্যবাদী নন। কবি তাই বলেন, ‘জলোচ্ছ্বাসের পরের প্রথম ভোরের আজানের মতো কবি তার উত্থানের গানটি গাইবে অসময় বলো, দুঃসময় বলো, গান থামবে না।’ (এখন সেই সময়); পরিবেশে যত অসঙ্গতি, অত্যাচার, অনাচার, বৈষম্য সব কিছুর বিরুদ্ধে লিখতে চান। নদীর নাব্যতা নেই, উত্তর বাংলা শীতে কাঁপে, বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব, সুশীল সমাজের ভূমিকা কবিকে ভাবিত করে; কিন্তু কেন যেন মুখ খুলতে পারেন না। লিখতে গেলেই খেলার মাঠ কিংবা মহিলাদের চুলের মধ্যেই লেখা সীমাবদ্ধ থাকে, অত্যাচারীর বিরুদ্ধে কলম দাঁড়ায় না। তবুও কবি লেখেন, ‘আমি জানি গুপ্তঘাতকেরা ছড়িয়ে রয়েছে আমার শহরে। তাদের নিধন চেয়ে কবিতাকে অস্ত্রের মতো ব্যবহার করতে চেয়েছি আমি বহুবার।’ (যদি মুখ খুলি); কারোর হারে হাসলে তাকে জিত বলে না। মিত্রের শোকে শোকাহত হয়েও অকাট মূর্খ উপাধি পেলেও তাতে প্রাপ্তি আছে। কবি লেখেন, ‘এখনো যে কারও অধঃপাতের খবর পেলেও বিজ্ঞের মতো হাসতে শিখিনি-সে আমার জিত, জানবো।’ (হারজিত); কবি এমন এক স্থানে গেছেন যেখানে ঘাসের গন্ধ, স্বস্তির শ্বাস, যেখানে জলপাই রঙের ট্যাংকগুলো আসে না হানা দিতে। সেখানে স্বস্তি আর স্বস্তি। কবির কথায়, ‘দোনলা বন্দুকে ট্রিগার না টেপার স্বস্তি, পকেট ভর্তি কার্তুজহীনতার স্বস্তি।’ কিন্তু কবির বন্ধুরা স্পিডবোটে করে কবিকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কবি যাবার সময় হরিণের ছাল নিয়ে যান, যাতে এখন তার অগ্রজ নামাজ পড়েন। (ভ্রাম্যমাণের জার্নাল); চোখের জলে বালিশ ভেজে, আশারা নেভে জ্বলে। তবুও কবি হ্রদের জলে কান পেতে জলকন্যার উচ্ছল কলতান শুনতে ব্যাকুল। কবির কাব্যে, ‘হ্রদের জলে আজও আড়ি পেতে কান, শোনা যায় নাকি জলকন্যার উচ্ছল কলতান?’ (জলকন্যার জন্যে); কবি কোনো কান্না অথবা আর্তনাদ ধ্বনি শুনতে চান না, বন্দুকের গুলি, ভাঙনের শব্দ শুনতে চান না। তাই তো কবি বলতে পেরেছেন, ‘সজল চোখের পল্লবের ছায়ার নিচে একটু দাঁড়াতে দাও। আমাকে নিস্তার দাও ভাঙনের শব্দ থেকে।’ (প্রার্থনা করেছি আমি উত্থান তোমার কণ্ঠস্বরের-গোধূলির গান); কবি শহীদ কাদরী তার দুই বন্ধু জাহাঙ্গীর ও সুকুমারকে কলকাতার গল্প, এয়ারগান দিয়ে চড়ুই আর কাকাতুয়া শিকারের গল্প শোনান। এক মরা শালিককে লাল পিঁপড়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে দেখে কবি লেখেন, ‘এভাবেই আমার বিশ্বাসগুলো পাখির চোখের মতো খুঁটে খুঁটে খেয়ে ফেলেছে দুপুরবেলার সেই লাল পিঁপড়েগুলো।’ (বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প); সাম্প্রদায়িকতার ছবি কবিকে হতবাক করে, দুঃখ দেয়। কবি লেখেন, ‘যদি হতুম কোনো প্রাচীন মসজিদ কিংবা পুরনো মন্দিরগাত্র থেকে খসে পড়া এক টুকরো পাথর সেলাম-পেন্নাম নিয়ে ভালোই থাকতাম।’ (যুদ্ধ-গোধূলির গান); অত্যাচারীর পক্ষে কেউ নেই কেন তার উত্তর জানা নেই। কেন মানুষ লাশকাটা ঘরে যাবে, কেন রাষ্ট্রনায়ক হত্যাযজ্ঞ করবেন। কবির কাব্যে, ‘না। উত্তর জানে না কেউ, না ওই সোনালি সোমত্ত গাছ, না ওই যে অ্যাকুয়ারিয়ামের লাল, নীল রুপালি মাছ।’ (উত্তর নেই); আমাদের ভেতর থেকে মানবতা চলে গেলে মানুষ উপাধি ঘুচে যায়, আমাদের ভেতরের গায়কী মন মারা গেলে আমাদেরও মৃত্যু হয় এই ভাবনা কবির নিজের লেখা শেষ কবিতা ‘মৃত্যু’তে দেখতে পাই। গোধূলির গান কাব্যগ্রন্থের ২২টি কবিতা তার নিজের লেখা এবং বাকি ১৩টি কবিতা কবি বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছেন। বাংলা কবিতায় কবি শহীদ কাদরীর অবদান সম্পর্কে জানতে ও বুঝতে গোধূলির গান কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপ থেকে অংশবিশেষ তুলে ধরলাম, ‘১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে আধুনিক কবিতার যে নতুন যাত্রা শুরু হয়, সেখানে তার অবদান ছিল অসামান্য। জীবনযাপন ও কবিতাকে তিনি একাকার করে দিয়েছিলেন। মানুষ হিসেবে এবং কবিতায় তিনি ছিলেন চৌকস কিন্তু বাউন্ডুলে, অকপট কিন্তু তির্যক, বুদ্ধিদীপ্ত কিন্তু খামখেয়ালি। তার কবিতাপাঠ এক অনন্য অভিজ্ঞতা। কবির মৃত্যুর এক বছর পর প্রকাশ হলো তার নতুন একটি কবিতার বই। এই কবিতাগুলোতেও পাঠক তাদের প্রিয় কবিকে চিনে নিতে পারবেন। এ বই না বেরোলে শহীদ কাদরীর কবিপ্রতিকৃতির কিছু রেখা চিরকালের জন্য অনঙ্কিত রয়ে যেত।’