
কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
কাজী নজরুল ইসলামের নামটি উদ্ভাসিত হলেই এই সত্য সমুখে আসে-‘বাংলা সাহিত্যের ভুবনে নজরুল ইসলামের মুখ্য পরিচয়-তিনি বিপ্লব-বন্দনার কবি। শত শতাব্দীর কবি-সভায় এই পরিচয়েই তার বিশিষ্ট আসন।’ কাজী নজরুলকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
‘বিদ্রোহী’ কবিতার ব্যঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস ‘ব্যাঙ’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন, যা শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। সেখানে তিনি প্যারোডি করে লেখেন, ‘আমি ব্যাঙ/লম্বা আমার ঠ্যাং/আমি ব্যাঙ/আমি সাপ, আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই/আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।’
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে কোনোভাবেই লুকিয়ে থাকেননি। বরং যুগের প্রয়োজনে লিখে গেছেন অবিরাম। তার দ্রোহ মানুষের মণিকোঠায় ঠাঁই পেয়েছে। কবির জীবৎকালে পৃথিবীর ভাবজগতে দেশে দেশে একটা পরিবর্তন চলছিল। বিশেষত এই অঞ্চলের শিল্প সাহিত্যের মধ্যে যে রোমান্টিক ধারা বহমান ছিল, তাতেও পরিবর্তন আনে। সেই সঙ্গে বলশেভিক বিপ্লব সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে মানুষের প্রচলিত ধ্যানধারণার, চিন্তা চেতনার পরিবর্তন আনে।
নজরুল গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের একটা মত, ‘বাংলা কবিতায় একটা রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল, রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লেখা। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের মতো কেউ কেউ সেই বলয়ের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু পুরোপুরি বাইরে যেতে পারেননি। প্রমথ চৌধুরী চলতি ভাষা চালু করলেন।’
‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।’
বুদ্ধদেব বসুর উদ্ধৃতি দিয়ে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এত সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আরও উল্লেখ করেছেন, ‘আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, রবীন্দ্র ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে তাতে আরও সময় লেগে যেত। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হলো।’
নজরুল তার কবিতার মধ্যে জানান দিয়েছেন তিনি একদিন শান্ত হবেন, যেদিন উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হবে না। তিনি জালিম-মজলুমের লড়াইয়ের ইতিহাসের প্রয়োজনেই একুশ শতকে এসেও তাই বারবার পঠিত হচ্ছেন।
প্রকৃতপক্ষে নজরুল ইসলাম সুন্দরের সাধনার মাধ্যমে সাহিত্যকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। আর তাই তিনি দেশ-কালের সব সীমানাকে এমন নির্দ্বিধায় অস্বীকার করতে পেরেছিলেন। যে কারণে নজরুল স্বগতোক্তি করেন, ‘আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই শুধু এই দেশেরই এই সমাজেরই নই। আমি সকল দেশের সকল মানুষের। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তবগানই আমার উপাসনা, আমার ধর্ম। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি, সে আমার দৈব। আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠতে পেরেছি বলেই কবি।’ (অভিনন্দনের জবাবে : কাজী নজরুল ইসলাম, নজরুল কথা, বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত, পৃ. ৭৯।)