
শামসুর রাহমান। ছবি- সংগৃহীত
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে প্রগতিশীলতার ধারা সাহিত্যে প্রাণের প্রবাহ অব্যাহত রেখেছিল। শামসুর রাহমান ছিলেন সেই প্রগতিশীল ধারার চেতনায় উজ্জীবিত কবি। সময় সচেতনতায় ঋদ্ধ কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একটি ধারা নির্মাণে তার অবদান অনস্বীকার্য। তার কবিতার বিষয়, প্রকরণ. কাঠামো নির্মানে তিনি ছিলেন একদম আলাদা।
কবিতার ধ্রুপদী বিন্যাসের বুনন একই সঙ্গে দর্শন ও রাজনীতির মিথস্ক্রিয়া তার কবিতাকে করেছিল গতিময় ও দিয়েছিল স্বতন্ত্র অভিধা। তার কবিতার সামগ্রিক কাঠামো নির্মাণে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। তার সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তিনি দিয়েছিলেন কাব্যভাষা। তার অজস্র কবিতায় বাংলার সমাজ-রাজনীতির উত্তাল সময়ের স্বাক্ষর মেলে। তারপরও যদি প্রশ্ন করা হয় শামসুর রাহমান কেন প্রাসঙ্গিক? তাহলে বলতে হবে একজন কবি সমাজের কাছে মানুষের কাছে কতটা দায়বদ্ধ ও সচেতন সেটা শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠে স্পষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত একজন কবির কবিতায় তার সার্বিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তার জীবনদর্শনকে তুলে ধরা খুবই বড় বিষয়। যার মধ্য দিয়ে জানা যায় তিনি কতটা ব্যক্তিক-কতটা নৈর্ব্যক্তিক। এ ছাড়া কবিতায় প্রাতস্বিক ধারা নির্মাণও তার জন্য একটি বড় বিষয়।
যে কারণে তার কবিতার খোলা জানালা দিয়ে তাকে অবলোকন করা যায়, তার সত্তার বিষয়টিকে অনুভব করা যায়। তার অমর কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলার প্রকৃতি, জনজীবনের চিত্র আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্রায়ণ অনবদ্য। একইভাবে ‘আসাদের শার্ট’ কবিতার মধ্য দিয়ে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের চিত্র ইতিহাসের ধারায় নন্দনতত্ত্বের বুনন রচনা করে। ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘বরকতের ফটোগ্রাফ’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ এবং ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ এই ধরনের তার অজস্র কবিতা ভাষা আন্দোলনপরবর্তী স্বাধিকারের জন্য সংঘটিত সব আন্দোলন সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করে। ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাগুলো এখনো পাঠককে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাহিত্যানুরাগীদের ইতিহাস বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। অনাগত যে কবি সাহিত্যের দ্বারে তার অভিষেক করবে তাকে ইতিহাস, দর্শনের বুনটে কাব্যের বিন্যাসী আয়োজনের কবিতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে শামসুর রাহমানের কবিতা অনন্য। কবিতাকর্মীরা কাব্যচর্চার শুরুতে যেমন কাব্যভাষা, রীতি, প্রকরণ আশা করেন শামসুর রাহমানের কবিতা তাদের জন্য আদর্শ পাঠ্য। দেশের যে কোনো দুর্দিনে তিনি সম্মুখ সারিতে থেকে কথা বলেছেন। দেশের প্রয়োজনে ও মানুষের স্বার্থে প্রগতিশীল যে কোনো আন্দোলনে একাত্ম ছিলেন তিনি। তাই কেবল কাব্য সাহিত্য নয়, সামাজিক জীবন, মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাস চর্চার জন্য শামসুর রাহমানের কবিতা একান্ত জরুরি।