Logo
×

Follow Us

শিল্প-সাহিত্য

গোলাম মুরশিদ: মননশীলতার এক ইতিহাসবেত্তা

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৩৯

গোলাম মুরশিদ: মননশীলতার এক ইতিহাসবেত্তা

গোলাম মুরশিদ। ফাইল ছবি

গোলাম মুরশিদের কণ্ঠ শুনতাম , তখন আমি স্কুলে পড়ি। বাবা সকালে থ্রি ব্যান্ড রেডিও নিয়ে বসতেন বিবিসির খবর শুনতে।  ওয়েব ওঠা-নামার কারণে কখনো জোরে কখনো আস্তে প্রচারিত হতো বিবিসির খবর। সেই খবরে কণ্ঠ দিতেন গোলাম মুরশিদ। গোলাম মুরশিদের নাম কেন লক্ষ্য করে শুনতাম তার একটা বড় কারণ ছিল। তাদের পারিবারিক এস্টেটের ব্যবস্থাপনার কাজ করতেন আমার বোনের ভাসুর প্রয়াত প্রফুল্ল ভট্টাচার্য। পরে আমার ভগ্নিপতি প্রয়াত বিমল ভট্টাচার্যও তার সঙ্গে কাজে যুক্ত হন। সেভাবে গোলাম মুরশিদের নামটা আমাদের পারিবারিকভাবে পরিচিত ছিল। বহুবার আমি তাদের বাড়ি বরিশালের উজিরপুর উপজেলার ধামুরা গ্রামে গিয়েছি। তাদের বাড়িতে থেকেছি। ফলে তার নাম, তার লেখা সম্মন্ধে অল্প-স্বল্প পরিচিত ছিলাম।  ঢাকায় আসার পরে তার লেখা লক্ষ্য করেছিলাম প্রথম আলোতে। আমি তখন দৈনিক সংবাদে কাজ করি। একবার তার লেখা পত্রিকায় দেখে আগ্রহ ভরে যোগযোগ করার চেষ্টা করি। প্রথম আলোতে ফোন করলে পিএবিএক্স থেকে নাম্বার দিতে রাজী হলো না। আমি তখন কবি সোহরাব হাসানের সঙ্গে  যোগাযোগ করলে তিনি নাম্বারটা দেন। সোহরাব ভাই সজ্জন ব্যক্তি। গুণী মানুষ। তিনি সংবাদে থাকা অবস্থায় আমি সেখানে যোগ দিয়েছিলাম। সোহরাব ভাইয়ের নাম্বার দিয়ে তার সম্মন্ধে আমাকে অনেক কথা বলে দিয়েছিলেন। তার কথা মতো আমি ফোন করলে ওপাশ থেকে কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। শুরুতেই আমি তার বাড়ির কথা, আমার আত্মীয় স্বজনের কথা বললে তিনি একদম সহজ হয়ে গেলেন। আমি তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা পোষণ করলে তিনি বললেন, তিনি তার শ্বশুরের বাসায় আছেন। আমি সে বাসায় যেতে পারি বা আজিজ মার্কেটে ওইদিন তিনি যাবেন। তখন আমি আজিজ মার্কেটে যেতে রাজী হই। আজিজ মার্কেটে দেখা হয় গোলাম মুরশিদ স্যারের সঙ্গে।  তাকে দেখে তার বাবার যে ছবিটা আমি তাদের বাড়িতে দেখেছি তার সঙ্গে ব্যাপক সাযুজ্য পেলাম। ধীর, স্থির, বিনয়ী- দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। আমি তাকে  শুরুতেই পিজি মার্কেটের নীচে বাবুল ইলেকট্রনিক্সে (পূর্ন চন্দ্র দাসের সে দোকানটি ওখানে আর নেই) যাওয়ার  কথা বলি। ওখানকার আড্ডায় সরদার ফজলুল করিম, সঙ্গীতজ্ঞ ঢাবি শিক্ষক মৃদুলকান্তি ভট্টাচার্যের থাকার কথা বললে তিনি যেতে রাজী হন। ওখানে পূর্নদা চা-বিস্কুট আপ্যায়নের মধ্য দিয়ে তার কথা শুনছিলাম।



তার প্রতিটি কথা আমার কানে বাজে। তিনি বাড়ির স্মৃতিচারণ করছিলেন বার বার। বামরাইল থেকে শৈশবে বাড়ি যাওয়ার কথা বলছিলেন। বিলাতে জীবন যাপন করার পরেও বাস্তৃভিটার প্রতি কতটা মায়া সেটা না দেখলে বুঝতাম না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি কীভাবে ভারতে গিয়ে কাজে যোগ দিয়েছিলেন সেসব স্মৃতিচারণ। তারা বাবার শিক্ষক জীবন। তার বিলেতে দেখা বাঙালি জীবন কত নিবিড়ি করে বলা। আমি তার লেখাআশার ছলনে ভুলিবইটা পড়েছি। এটা শুনে তিনি মাইকেল সম্বন্ধে প্রচলিত কথা নিয়ে কথা বলেছিলেন।  তারপরে তিনি বাঙলা একাডেমিতে যাবেন, রিক্সা ঠিক হলে আমি টিএসসি পর্যন্ত গেলাম। এভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগটা হয়ে গেল। ফোনে বা সাক্ষাতে কথা হয়েছে বহুবার বেশিরভাগ সময় তার বই নিয়ে আমি বলেছি, তিনি শুনে অনেক ভাবনাকে শুধরে দিতেন। অসাধারণ এক শিক্ষক ছিলেন তিনি। মানুষ দার্শনিক প্লেটো তার তত্ত্বেঅর্ধসত্যবলতে যা বুঝিয়েছেন, তিনি যেন সেটাই ছিলেন। কারণ বহু ইতিহাসকে তিনি ভেঙ্গেছেন ইতিহাসের আঙ্গিকের বিনির্মান করে। গোলাম মুরশিদ স্যারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হবে এমন চিন্তা আমার কখনো ছিল না। ভাষা সাহিত্যে এইরকম উঁচু মানের গবেষক খুবই কম রয়েছে। সহজে কোনো বিষয়কে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়া গ্রহন করতেন না। এতো সিদ্ধহস্ত গবেষক খুবই কম। জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়েও গোলাম মুরশিদ নিজের অন্বেষণ চালিয়ে গিয়েছেন। রচনা করেছেন বিরল ঐশ্বর্যময় সব গ্রন্থাবলি। কর্মবিমুখ হননি। গবেষণাবিমুখ হননি। কালি-কলম-মন সজাগ ছিল শেষমেশ। ঋষিদের মতো তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। বহুমুখী প্রতিভাধর এই জ্ঞানতাপস তাঁর প্রতিটি কাজেই প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় তিনি জ্ঞানসাধনায় ব্রতী। এমন মানুষের সংখ্যা কত? নগণ্য, অতি সামান্য বললেই চলে। তাঁর লেখা বিভিন্ন বিষয়ের বইগুলিতে একাগ্র এক গবেষকের স্বাক্ষর মেলে। তাঁর কাজ দেখলে শুধুই বিস্মিত হতেই হয়, এমন নয়। তাঁর কর্মপদ্ধতিটি যেন অনুসরণীয় হয়ে ওঠে আমাদের কাছে। বাঙালির ইতিহাসের গতিধারার এক কালপর্ব ১৯৭১ সাল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাঙালি বর্বর পাকিস্তানীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে। গোলাম মুরশিদ এই মরণপ্রান যুদ্ধ থেকে দূরে থাকেননি। একজন লেখকের দায় নিয়েই তিনি  যোগ দিয়েছিলেন মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে।  তার যোগদানের প্রক্রিয়াটা ভিন্ন থাকলেও জন্মভূমি শত্রুমুক্ত করার  জন্য তিনি ছিলেন মরিয়া। ১৯৭০ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিলবিদ্যাসাগরনামে একটি স্মারকগ্রন্থ।  এই স্মারক গ্রন্থের মধ্যদিয়ে দিয়ে তিনি পরোক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী সময়ে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উস্কে দিতে কাজ করেছিলেন। একাজটা তিনি অনেক সাবধানে করলেও পাকিস্তানী হার্মাদ বাহিনীর কাছে কেউ না কেউ খবর পৌঁছে দিলে পাকিস্তান বাহিনীর তালিকায় তার নাম উঠে যায়। তিনি এটা বুঝতে পেরে এপ্রিল মাসের মধ্যেই  সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় আশ্রয় নেন। পরে জেনেছিলেন যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষকদের তালিকা করা হয়েছে তিনি তার নম্বরে ছিলেন। কলকাতায় গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কাজ করেন এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকাআনন্দবাজারপত্রিকায় কাজ নেন। এখানে যোগদানের পরেবাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি’  তিনি ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন। তখন নিজের নামটি বদলেহাসান মুরশিদনামে লিখতেন। এই লেখাগুলোর একটি সংকলন কলকাতার এসোসিয়েটেড প্রেস থেকে বই আকারে বের হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে। তাতে তার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখাযখন পলাতক: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিগোলাম মুরশিদ তাঁর শরণার্থী জীবন নিয়ে লিখেছেন। গোলাম মুরশিদের স্মৃতিকথা মানেই অন্য দশটি স্মৃতিকথার মতো হবে তা কিন্তু নয়। তার এই বইটিতে তখনকার সময়ের অনেক অজানা তথ্যের সন্নিবেশ ঘটেছে। দেশের আন্তর্জাতিক অনেক ঘটনার অসাধারণ সব বিশ্লেষণে ঋদ্ধ বইটি। বইয়ে ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায়ের সন্নিবেশ ঘটেছে। দলমতের বাইরে থেকে লেখা বইটি মুক্তিসংগ্রামের এক অনন্য দলিল। গোলাম মুরশিদেরহাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিবইটি এক কথায় অনন্য। ২০০৬ সালে বইটি প্রকাশের পর অনেকেই বলেছিলেন নীহাররঞ্জণ রায়েরবাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্বথাকার পরে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? কিন্তু অনেকের কথা শুনেই মনে হয়েছে বইটি না পড়েই সবাই মন্তব্য করছেন। কারণ  নীহাররঞ্জন রায়ের বইটি বাংলাদেশ হওয়ার আগে লেখা। তার গোলাম মুরশিদ তার বইটিতে হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসটা লিখেছিলেন। তার বইটির ভূমিকা(কৈফিয়ত কৃতজ্ঞতা) পড়লে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। তিনি লিখেছেন- ‘বাঙালি সমাজ বহুভাগে বিভক্ত- তার সবচেয়ে বড়ো দুই শরিক হিন্দু আর মুসলমান। ঐতিহাসিকরা হয় হিন্দু বাঙালির ইতিহাস লিখেছেন, নয়তো লিখেছেন মুসলিম বাঙালির ইতিহাস।- সমগ্র বাঙালির নয়। মানুষের ধর্মীয় পরিচয় এতো প্রবল যে, নিরপেক্ষ ইতিহাস লেখাও সহজ নয়। যে-মুষ্টিমেয় লোক সত্যি সত্যি সত্যি অসাম্প্রদায়িক, তাদের কেউ কেউ আবার অন্য সম্প্রদায়ের সম্পর্কে জানলেও, যথেষ্ট ভালো করে জানেন না।  ফলে খণ্ডিত ইতিহাস খণ্ডিতই থেকে যায়। আমার ইতিহাস বিশেষজ্ঞতা নেই: কিন্তু আমি কোন জাতি, ধর্ম , বর্ন  সম্প্রদায় অথবা অঞ্চলের সঙ্গে নিজেকে শনাক্ত করিনে।  বরং আন্তরিকভাবে নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক মানুষ বলে গন্য করি। সেজন্যে সীমানার বাইরে থেকে একটি সমগ্র বাঙালির ইতিহাস লিখতে চেষ্টা করেছি। রাজনীতির ইতিহাস নয়, সংস্কৃতির ইতিহাস। বাঙালি সংস্কৃতির বিচিত্র দিকের কথা লেখার সময় তাদের সমন্বয়, ঐক্য এবং বাঙালিত্বের দিকে নজর রেখেছি। কতটা সফল হয়েছি, পাঠক তা বিচার করবেন। তার মানে তিনি বিনয়াবনত হয়ে একথাটা পরিস্কার জানিয়েছেন যে, নীহাররঞ্জন রায়ের ধার কাছ দিয়ে তিনি হাঁটার চেষ্টা করেননি। এছাড়াও তিনি ইতিহাস বেত্তা নন; কিন্তু বইটি পড়লে মনে হবে এটা হাজার বছরের বাঙালির প্রকৃত ইতিহাস। বইটি প্রসঙ্গে বাংলা ভাষা সাহিত্যের আরেক গবেষক স্বরোচিষ সরকার লিখেছেন, নীহাররঞ্জন রায়ের ইতিহাস যেখানে শেষ, গোলাম মুরশিদের ইতিহাস সেখানে শুরু। সুতরাং গ্রন্থ দুটিকে বরং পরস্পরের পরিপূরক বলা যায়।


গোলাম মুরশিদের চিন্তন ছিল বহুমুখী।  মুক্তিযুদ্ধসহ নারী আন্দোলন, মনীষীদের জীবনী থেকে বাংলা সাহিত্যে অনেক দরকারি বই, বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিধান– ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধানতাঁর সম্পাদনায় রচিত হয়েছে। ভাষা-সাহিত্য এবং ইতিহাস তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র। তিনি ইতিহাসের একটি বিশেষ জায়গা নিয়ে গবেষণা করেছেন, তা নারীর আধুনিকায়ন। বইটির নাম ‘Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization, 1849–1905’, ‘Reluctant Debutante’ পরে  সংকোচের বিহ্বলতানামে বের হয়। ‘Reluctant Debutante’ -এর জন্য তিনি ১৯৮৩ সালেবাংলা একাডেমি পুরস্কারলাভ করেন। নারীমুক্তির দীর্ঘ ধারাবাহিকতার ইতিহাস ধরে রেখেছে এই বই। নারীমুক্তির অন্তর্গত বিষয়গুলির ধরা পড়েছে তাঁর লেখায়। গোলাম মুরশিদ সাধারণ সামাজিক ইতিহাসকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন। বর্ণনামূলক ইতিহাস নয়, তিনি লিখেছেন, কী করে তথ্যকে বিশ্লেষণ করে একটা ধারণাগত কাঠামোর মাধ্যমে পরিবেশন করা যায়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মদ্যপানবিরোধী আন্দোলনের বিবরণ না-লিখে লেখা যায় স্থিতিশীল সমাজ গঠনের প্রয়াস। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ আন্দোলন, বহুবিবাহ বাল্যবিবাহ নিবারণ, পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ইত্যাদির বিবরণ না-দিয়ে লেখা যায় স্ত্রীজাতির উন্নতির প্রতি সচেতনতার কথা।

এখনও সাগরদাঁড়িতে গেলে মানুষের কাছে রাজনারায়ণ দত্তর যেসব ইতিহাস শোনা যায়, বা যেসব লেখক মাইকেল-জীবনী লিখেছেন, তাঁদের তথ্যের বিভ্রান্তি কাটাতেআশার ছলনে ভুলিসবচেয়ে মার্জিত তথ্যবহুল গ্রন্থ। এখানে উল্লেখ রয়েছে, রাজনারায়ণ দত্তের তৎকালে সেরা উকিলদের তুলনায় অনেক সাধারণ আয় ছিল তাঁর ইংরেজি জানাটাও ছিল জনশ্রুতি। আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর বাবাকে নিয়ে যে কত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সেটাআশার ছলনে বুলিবইটিতে অনেকটাই স্পষ্ট গোলাম মুরশিদের লেখায় সাবঅলটার্ন থিওরির প্রয়োগ স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট।সাবঅলটার্ন’, শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি প্রত্যেকে পরিচিত, যার অর্থ ‘নিম্নবর্গ শ্রেণি’, ইতালিয়ান হিস্ট্রি বইটিতে গ্রামসি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই শ্রমিক শ্রেণিকে বুঝিয়েছিলেন, যারা শাসক শ্রেণির অধিপত্যের অংশ। অর্থাৎ সাবঅল্টার্ন গোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস বিভাজিত খণ্ডিতকারণ তারা সর্বদাই শাসক গোষ্ঠীর কার্যকলাপের অধীনে থাকে। ফলে তাদের সংগ্রামের ইতিহাসের শাসকের চরিত্রের চিত্রায়নের ছায়া থাকে। গোলাম মুরশিদের লেখালিখিতে এই ধারণাগুলি সুস্পষ্ট।

ইতিহাসের গভীর থেকে তুলে এনেছেন অজস্র মণি-মুক্তো। প্রচল ধারার ইতিহাসের বিষয়-আশয়কে তিনি পুরোপুরি বদলে দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। গোলাম মুরশিদের প্রতিটি লেখার মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে নিবিষ্টতা একাগ্রতা। শাসক শ্রেণির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখায় তাঁর গবেষণার প্রাতিস্বিকতার বিষয়টি উঠে এসেছে। কোনও তথ্য পরিবেশনে কেবল একটি উৎসের ওপর নির্ভর করেননি তিনি। নানা উৎস অনুসন্ধান করে তথ্যটিকে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, মোহহীনভাবে। আমাদের ইতিহাস লেখার সার্বিক ধারাটিই গড়ে উঠেছে রাজন্যবর্গের চেতনার ধারা থেকে। তাঁর আরও একটি গবেষণালব্ধ বই ঔপনিবেশিক আমলের বাংলা গদ্য, উন্মেষ বিকাশের ইতিহাসপাঠ করলেও গোলাম মুরশিদের চিরাচরিত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।

ইতিহাস চর্চায় তিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেননি। নতুন ইতিহাস তুলে এনেছেন। প্রথম বাংলা বই ছাপার কথাটি আমাদের অধিকাংশ বই-তে লেখা আছে১৮০১ সালে শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকে। অন্যদিকে, বই ছাপানোর প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। ইতিহাস হয়তো ইংরেজরা তাদের তাঁবেদার ঐতিহাসিকদের দিয়ে এভাবেই লিখিয়েছিলেন; কিন্তু গোলাম মুরশিদ এই ধারার বাইরে গিয়ে লিখেছেন, ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হওয়ার ১৬ বছর আগে ১৭৮৪ সালে প্রথম বাংলা বই প্রকাশিত হয়।সেসময় ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদে ইংরেজ অনুবাদকদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অধীনে কর্মরত মুনশিদের ভূমিকার ব্যাপারেও তিনি লিখেছেন। একইসঙ্গে লিখেছেন, বাংলা বই প্রকাশ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একক কৃতিত্ব নয়, বরং ইংরেজ অনুবাদক এবং তাঁদের মুনশিরা লিখিত বাংলাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন।

ঔপনিবেশিক আমলের বাংলা গদ্য উন্মেষ বিকাশের ইতিহাসতার এক অনন্য রচনা। গোলাম মুরশিদের লেখার প্রাণের ভিতরে গেলে যে বিষয়টি পুরোপুরিভাবে অনুভব করা যায় তা হল, সন-তারিখের ইতিহাস নয়, তিনি লিখেছেন, মননশীলতার ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস সর্বোপরি মানুষের সচেতনতার ইতিহাস। তার লেখাআলোকিত মুখচ্ছবিবইটি গুণে মানে সেরা। এই বইটিতে নানা মনীষীর সঙ্গে গোলাম মুরশিদ নিজের বাবার কথাও লিখেছেন। তাঁর পিতামহ সন্তানকে লেখাপড়া না করিয়ে গৃহকর্মে, মূলত চাষাবাদে নিয়োজিত হওয়ার নির্দেশের পর গোলাম মুরশিদের বাবা নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া শেখেন, পরে তিনি গ্রামের সুবিধা-বঞ্চিতদের লেখাপড়া করতে সাহায্য করেছেন। তিনি বাবার আলোকিত দিকের যে প্রশংসা করেন, সেটি তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গোলাম মুরশিদ তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাঠ পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকেই। কিন্তু তাঁর পরিবার অনেক স্বচ্ছল এবং সব ভাইবোনই উচ্চশিক্ষিত। তাঁর বাবাকে নিয়ে লেখাটিতে ভাই-বোনরা মনক্ষুন্ন হতে পারেন জেনেও তিনি তাঁর সত্যবদ্ধ উচ্চারণের ধারার সঙ্গে কখনও আপোষ করেননি। পিতার আদর্শ থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। তাঁর লেখা ইতিহাসের ধারায় নতুন ইতিহাস তৈরি না করে প্রচল ধারা ভেঙে চলে গিয়েছে স্বকীয়তা নিয়ে নিজস্ব ধারায়।

তিনি নেই একথাই সত্যি। কিন্তু মানুষ মরে গিয়েও বেঁচে থাকেন তাঁর কাজের মধ্যে। গোলাম মুরশিদ স্যর, আপনি আমাদের স্মৃতিতে অবিনশ্বর থাকবেন। আপনাকে প্রণাম।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫